উমোজা: নারীর নিরাপদ স্বর্গ

কেনিয়ার সুন্দর সরল এক গ্রাম উমোজা। আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী যে রূপ দেখা যায়, ঠিক তেমন রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর। কারণ পুরুষসমাজ সেখানে নিষিদ্ধ।

কেনিয়ার সুন্দর সরল এক গ্রাম উমোজা। আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী যে রূপ দেখা যায়, ঠিক তেমন রঙিন বৈচিত্র্যে ভরপুর। কারণ পুরুষসমাজ সেখানে নিষিদ্ধ। নারীদের গ্রাম হিসেবেই উমোজা পরিচিত বিশ্বব্যাপী। সোয়াহিলি ভাষায় ‘উমোজা’ মানে ঐক্য। নাইরোবি থেকে ৬ ঘণ্টার দূরত্বের এই গ্রামটির নাম কেনিয়া ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সবার মুখে মুখে। নর্থ-সেন্ট্রাল কেনিয়ার নারী-সর্বস্ব এই গ্রামের কথা জানে না এমন মানুষ কেনিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য ঠিক নাম মনে থাকার মতো দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন উমোজা’র নারী গোষ্ঠী।

১৯৯০ সালে রেবেকা লোলোসলি নামের এক নারী ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন ও বিভিন্নভাবে অবহেলিত ও নির্যাতিত ১৫ নারী নিয়ে একজোট হয়ে গড়ে তোলেন উমোজা। লোলোসলি স্বামী ও বিভিন্ন পুরুষের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বহুদিন, চেষ্টা করেছেন বিচার চাওয়ার। কিন্তু পরে দেখলেন সেই নির্যাতনকারীরাই ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধে। তাই জেদ থেকেই নারীর এই অভয়ারণ্য উমোজা গড়ে তোলেন যেখানে শুধু হবে নির্যাতিত নারী ও তার সন্তানদের নিরাপদ আবাস। পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ সেখানে। তবে তার মানে এই নয় যে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেখানে।

উমোজার ভিন্ন জীবন ব্যবস্থা, নারীর সংগ্রামের গল্প আর অসাধারণ বৈচিত্র্যে ভরা জীবনধারা সম্পর্কে জানতে, নতুন এক পৃথিবী গড়ার অনুপ্রেরণায় অনেক পর্যটক ভিড় জমান উমোজায়। আর সেটি ঘিরেই উমোজার নারীরা গড়ে তুলেছেন ছোট্ট আয়োজন, যাতে এই গ্রামের অভিজ্ঞতা সবসময় মনে গেঁথে থাকে সবার মনে। কেনিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানে অতিথিদের বরণ করে নেয় উমোজা’র সংগ্রামী নারীরা। তাদের রঙিন ও ঝলমলে পোশাক আর গয়নায় মুগ্ধ হতে হয় প্রথম দেখাতেই। সেই মুগ্ধতাকে পুঁজি করেই চলছে উমোজা’র নারীদের বেঁচে থাকা। উমোজার জীবনধারা, সেখানে নারীদের হাতেই তাদের  সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুল, ইউএসএইডের সাহায্যে নির্মিত উমোজা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আর জাদুঘর সবকিছুতেই নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যাবে উমোজা’র আজকের অবস্থানে উঠে আসার।

উমোজা দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে, তবে কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নয়। নারীর ভেতরকার সাহস যে কতকিছু করতে পারে, কীভাবে এমন একটি সমৃদ্ধ সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারবে সেটিই উমোজার প্রধান দর্শনীয় বৈশিষ্ট্য। নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে ঐতিহ্যবাহী গয়না আর কাপড়কে পুঁজি করে নিজেদের জন্য পৃথিবী গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে এখনো। অসাধারণ সব রঙ ওই ঢঙের গয়না যেমন একদিকে তুলে ধরেছে আফ্রিকান চিরচেনা ঐতিহ্যকে, তেমনি অন্যদিকে প্রতিটি গয়নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে উমোজা নারীদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্পগুলো।

উমোজার স্কুলের চিত্রটিও বেশ মনোরঞ্জক বলা চলে। সেখানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে অহিংস আর নারীর প্রতি নির্যাতনবিহীন একটি সমাজ তৈরি করতে পারে। উমোজা’তে পুরুষের বাস নিষিদ্ধ হলেও গ্রাম থেকে কিছু দূরে এই নারীদের উদ্যোগেই নদীর পাশে ক্যাম্পসাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে করে উমোজাতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারে প্রাণ খুলে। সামান্য টাকায় উমোজাতে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কেনা গয়না ও নারীদের বানানো বিভিন্ন ক্র্যাফট কেনার টাকাই উমোজাতে নারীদের জীবনধারনের মূল চাবিকাঠি।

মূলত ২০০৪ কিংবা ২০০৫ সালের দিকে উমোজার নারীরা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে শুরু করে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য। এরপর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুপ্রেরণার খোঁজে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। এছাড়া উমোজার নারীদের সঙ্গী হয়েছে ইউনিসেফও। তবে এতকিছুর পরও আফ্রিকার পুরুষসমাজের বিভিন্ন অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করে চলেছে তারা। এখনো পুরুষশাসিত সমাজ সঠিকভাবে নিতে পারেনি নারীদের এই বীরত্বগাথা। তবে সবকিছু ছাপিয়েই উমোজার নারীরা এগিয়ে চলছে। সবকিছুর পর পুরুষরাই তাদের সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন উমোজার নারীরা। আর কোনোকিছুকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের সামর্থ্য দিয়েই আয় করে নিচ্ছেন জীবনযাপনের সবকিছু। প্রায় পঞ্চাশ নারী ও ২০০ শিশুর নিরাপদ আবাসস্থল উমোজা এখন ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দারুণ এক গন্তব্য।

ছবি : সংগ্রহ 

 

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

3h ago