মুক্তিযুদ্ধ

১৩ জুলাই ১৯৭১: আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়: ভুট্টো

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তানের করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'তেহরানে আমি স্পষ্টতই বলেছি আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়, আলোচনা হবে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। আমরা সরকারকেও স্পষ্টতই এই বার্তা দিতে চেয়েছি। কিন্তু এই নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার প্রথম থেকেই অবাস্তব মনোভাব পোষণ করে এসেছিলাম। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাতীয় পরিষদকে দুটো কমিটিতে বিভক্ত করার কথা বলেছিলেন তখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে আওয়ামী লীগকে বারবার শোধরানোর সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনার সঙ্গে আমরা বলেছি জাতীয় পরিষদ বলবৎ থাকবে। জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ শুধু তারাই হারিয়েছেন যারা কেবল আওয়ামী লীগ ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত।'   

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৩ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন পাকিস্তানের করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'তেহরানে আমি স্পষ্টতই বলেছি আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়, আলোচনা হবে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। আমরা সরকারকেও স্পষ্টতই এই বার্তা দিতে চেয়েছি। কিন্তু এই নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার প্রথম থেকেই অবাস্তব মনোভাব পোষণ করে এসেছিলাম। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাতীয় পরিষদকে দুটো কমিটিতে বিভক্ত করার কথা বলেছিলেন তখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সুষ্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে আওয়ামী লীগকে বারবার শোধরানোর সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সরকারের সঙ্গে আলোচনার সঙ্গে আমরা বলেছি জাতীয় পরিষদ বলবৎ থাকবে। জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ শুধু তারাই হারিয়েছেন যারা কেবল আওয়ামী লীগ ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত।'   

ভারতে এদিন

১৩ জুলাই দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন আয়ারল্যান্ডের এমপি স্যার অ্যান্থনি চেলস এসমন্ড ও ড. উইলিয়াম লাউনাগে। এসময় তারা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শরণার্থী বিষয়ে আলোচনা করেন। তাদের বৈঠকে একই সঙ্গে পূর্ববঙ্গের বিষয়ে সমঝোতার প্রস্তাবও উঠে আসে।

২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, এখন পর্যন্ত পশ্চিম দিনাজপুরের মালন শিবিরে ৩৩ হাজার ১৫২ জন শরণার্থী কলেরা ও ডায়রিয়ায় রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

১৩ জুলাই কলকাতায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তানি জান্তাদের নির্যাতন ও নিপীড়ন নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। একই সঙ্গে এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী থেকেই শরণার্থী ও নিপীড়িত মানুষের চিত্র উঠে আসবে নতুন একটি আলোকচিত্র বইতে।'

পাকিস্তানে এদিন

১৩ জুলাই পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক জেড এ সুলেরি বলেন, 'পাকিস্তানের সংবিধান তৈরির কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছেন তারা নিপুণ কায়দায় সংবিধান তৈরি করেছেন। সংবিধানে ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ পুনরুদ্ধারে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যার ফলে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে মসলমান প্রার্থীরা যেন অমুসলিম প্রার্থীদের ভোটের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয় এই জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই সংবিধানে মোট দুটো সভার ভিত্তিতে ফেডারেল সরকার গঠিত হবে। তবে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা কমে আসবে এতে।'

১৩ জুলাই পিপিআই এক খবরে বলে, 'অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রচুর চাকরিজীবী এরই মধ্যে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৩ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য আরও অতিরিক্ত ১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করে। কংগ্রেসের এই বিশেষ অধিবেশনে মোট ৪১ জন সিনেটর এক যুক্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'পাকিস্তানকে দেয়া সমস্ত মার্কিন সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে।' এদিন অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। রিচার্ড নিক্সন তার বক্তব্যে বলেন, 'পাকিস্তানকে আর কোনো প্রকার অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হবে না। আমরা পাকিস্তানকে নিষেধাজ্ঞার আগে যে অস্ত্র বিক্রি করেছি সেগুলোই মূলত সরবরাহ করেছি। নিষেধাজ্ঞার পর আর কোনো অস্ত্র বিক্রি করা হয়নি।

১৩ জুলাই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আ্যালেক ডগলাস হোম হাউস অব কমন্সে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় এই পর্যন্ত কতো মানুষ নিহত হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করতে কেউই সমর্থ হয়নি। আমরা ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের কাছেই এই সংখ্যা জানতে চেয়েছি।’

১৩ জুলাই প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন সরকারের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সহায়তা পাঠানো জরুরি। পাকিস্তান তার নিজের দেশের এক অংশের মানুষের প্রয়োজনীয়তার কথা অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সহায়তা না পাঠানো হয় তবে অজস্র নিরীহ মানুষ মারা যাবে।'

১৩ জুলাই ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, ‘পাকিস্তানকে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মার্কিন সরকার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সমাধানের বিষয়ে কোনো ফর্মুলা বাতলে দেবে না। এবং ফর্মুলার বিষয়ে কোনো প্রকার চাপ দেবে না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যদি পাকিস্তানি সেনা না কমানো হয় তবে এই অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে না।’

১৩ জুলাই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থায় ইয়াহিয়া খান যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা যতোদিন বাস্তবায়ন না হবে ততোদিন মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ রাখবে।'

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

১৩ জুলাই বার্তা সংস্থা এজেন্সি ফ্রান্স প্রেস (এএফপি) ও রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলে, সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত সফর শেষে গোপনীয় এক প্রতিবেদনে বলেছে, 'পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে পৈশাচিকতাকেও হার মানিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করা প্রতিটি মানুষ এখন তীব্র আতঙ্কিত। ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী শিবিরগুলোতে এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তবুও মানুষ প্রাণের ভয় এখন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই। যদি পাকিস্তান নিজেদের সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তবেই পূর্ব পাকিস্তানে সমঝোতা ও শরণার্থীদের পক্ষে দেশে ফেরার সম্ভাব্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৩ জুলাই সন্ধ্যা ছয় টার দিকে কুমিল্লার মন্দভাগ বাজার ও নাক্তেরবাজার এলাকায় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা মর্টারের সাহায্যে হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় ১২ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এর ফলশ্রুতিতে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর হামলা চালালে মুক্তিবাহিনীর ৪ বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

১৩ জুলাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দত্তসার দিঘি ও আমতলায়  রাত ১০ টায় ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দুই দল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত ও ১৫ জন আহত হয়।

১৩ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দির উত্তরে গোমতী নদীতে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল হানাদার বাহিনীর একটি টহলদারী স্পিডবোটকে আক্রমণ করে। এই অ্যামবুশে একজন লেফটেন্যান্টসহ ২১ জন হানাদার নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন।

১৩ জুলাই কুষ্টিয়ায় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর দর্শনা ক্যাম্প আক্রমণ করে। এই অভিযানে ১৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১৩ জুলাই মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর শর্শদির রেল সেতুতে পাহারারত রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় চার জন রাজাকার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ফোরক  লাগিয়ে রেল ব্রিজটি ধবংস করে। ফলে ফেনীর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

১৩ জুলাই ফুলবাড়িয়ার লক্ষ্মীপুর গ্রামে ল্যান্সনায়েক মান্নানের নেতৃত্বে ১৩ জন ও স্থানীয় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার দলকে অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে মুক্তিযোদ্ধারা ৪৩টি রাইফেল, ৩টি এলএমজি, ১টি চীনা এলএমজি, ২টি চীনা রাইফেল ও ২টি এসএমজি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

১৩ জুলাই ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদের ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী নিযুক্ত হন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিনের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৩ জুলাই ময়মনসিংহে কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা ও সাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রী ফকরুদ্দিন আহমেদকে আহবায়ক ও এ ই বি রেজাকে সাধারণ সম্পাদক করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র সপ্তম, নবম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান ১৪ জুলাই ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৪ জুলাই ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected] 

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

6h ago