বাঙালি মুসলিম সমাজের অগ্রপথিক মওলানা আকরম খাঁ

অবহেলায় অনাগ্রহে পড়ে আছেন উনিশ শতকের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা নাম না জানা বহু গুণী। অনেক সময় দেখা যায়— কেন দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, তার ঠিক কোনো যুক্তিও নেই। এমনি একজন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ।
মওলানা আকরম খাঁ। স্কেচ: সজিব রায়

অবহেলায় অনাগ্রহে পড়ে আছেন উনিশ শতকের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা নাম না জানা বহু গুণী। অনেক সময় দেখা যায়— কেন দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, তার ঠিক কোনো যুক্তিও নেই। এমনি একজন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ।

সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও ইসলামী পণ্ডিত। বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক পত্রিকা দৈনিক আজাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদনা করেছেন বহুল পঠিত মাসিক 'মোহাম্মদী'। ১৯৩৬ সালে 'দৈনিক আজাদ'র পথচলা শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পত্রিকা দুটির অস্তিত্ব ছিল। আকরম খাঁ তার সম্পাদিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার একটা দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনা করেন।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে আকরম খাঁর ভূমিকা তৎকালীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল ঐতিহাসিক। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে 'কিংবদন্তির রাজা' আকরম খাঁ ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং সালাম, জব্বার, রফিক, বরকতসহ কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনিই প্রথম শহীদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

পাকিস্তান হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে মওলানা মুসলিম লীগের নেতা হওয়ার পরও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন। 'বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা'য় লেখেন, 'দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? এই প্রশ্নটা তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলবে, না বেল? বঙ্গে মুসলিম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাদের লেখ্য, কথ্য ও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।'

তিনি মুসলিম লীগের নেতা হলেও নিজস্ব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের বিষয়ে ছিলেন আপসহীন। তার জীবন শুধু বঙ্গীয় মুসলিম রেনেসাঁ নয়, বৃহত্তর বাঙালি চেতনা বিকাশেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৮৬৮ সালের ৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহ তোরাব আলী খাঁ সৈয়দ হাজী নিসার আলী তিতুমীরের সহযোদ্ধা ছিলেন। পূর্বপুরুষরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে পনের শতকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বয়স যখন এক বছর বয়স, তখন একই দিনে কলেরায় তার বাবা-মার মৃত্যু হয়। এরপর তিনি নানির কাছে বড় হন।

তার লেখালেখির শুরু আকবার-ই-মোহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে। সাংবাদিকতা শুরু করেন সাপ্তাহিক আহলে হাদিসে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম থাকলেও খুব অল্প বয়সেই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন এবং সফল হন। 'ছাগল বিক্রয়লব্ধ দশ আনা পয়সা নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে হাকিমপুর হতে কলকাতায় আসেন। আশি বছর বয়সেও তার কর্মদক্ষতা দেখে বিস্মত হয়েছি। ইংরেজিতে Entrepreneur বলে একটি শব্দ আছে। উদ্যোক্তা বললে তার ঠিক অর্থ হয় না। মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন Entrepreneur। কুশাগ্র বুদ্ধিতো ছিলই।' (আত্মস্মৃতি: আবু জাফর শামসুদ্দীন)

নিজ প্রচেষ্টায় ইংরেজিতে প্রচুর জ্ঞান অর্জন এবং বাংলা ভাষার একজন বলিষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ব্রিটিশবিরোধী আজাদি আন্দোলন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মুখ সারির নেতা ছিলেন তিনি।

ফলে নানাবিধ কারণে তৎকালীন মানুষের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি। দাবিদার ছিলেন সমাজ সংস্কারে কৃতিত্বের। মতভেদ থাকত তার চিন্তা নিয়েও। আহলে হাদিসে ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন একসময়। যেমন: প্রখ্যাত ব্যঙ্গ রচয়িতা সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের আয়না গল্পগ্রন্থের মধ্যে দুটি গল্প লিখেন। শিরোনাম রাখেন: 'লিডরে কওম' ও 'মুজাহেদিন' গল্পদ্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন মাজহাবি দ্বন্দ্বকে ব্যঙ্গ করেছেন। 'লিডরে কওম' এ চিত্রায়ন করেন– হানাফি ও আহলে হাদিস দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে একটা পত্রিকার মাধ্যমে ভণ্ড মৌলবির মানসিক বিকাশ!

প্রাবন্ধিক নূরুল আনাম মিঠু এ বিষয়ে বলেন: জনৈক ইসমাইল সাহেব মাদরাসা ও স্কুল উভয় পরীক্ষায় বার বার ফেল করে বিধবা ফুফুর একমাত্র আর অবলম্বন ছাগলটি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদে আশ্রয় নেন। এটি ছিল আহলে হাদিস গোষ্ঠীর। তিনি পূর্বে আহলে হাদিস বিরোধী হলেও এখানে এসে আহলে হাদিসপন্থি হয়ে যান। সহসাই তথাকথিত হানাফিদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় লিপ্ত হয়ে ধনাঢ্য হাজী পরিবারে উঠে আসেন এবং হাজী সাহেবকে বুঝিয়ে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতে সক্ষম হন। তথাকথিত হানাফি বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে এক সময়ে পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারেরও সমালোচনা শুরু করে। পুলিশি হামলার ভয়ে অতঃপর হাজী সাহেব পত্রিকা অফিস স্থানান্তরের পরামর্শ দিনে ইসমাইল সাহেব অন্যত্র চলে গিয়ে পত্রিকার মাথায় লিখতে শুরু করেন। 'মওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল প্রতীক্ষিত' অতঃপর তিনি 'আঞ্জুমান' নামের না সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে হাজার হাজার টাকা চাঁদা তুলতে শুরু করেন। সেই টাকার হিসাব কোনোকালেও পাওয়া যায়নি। মওলানা এবার যোগ দেন খেলাফত আন্দোলন ও রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেসে। পত্রিকার বেশ কাটতি হয় তার। এক সময় তিনি জেলে যান এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যের অজুহাতে মুক্তি ও পান। এরপর তিনি ইসলামী পুস্তক লেখার ঘোষণা দিয়ে অগ্রিম মূল্য পাঠানোর জন্য আবেদন জানান দেশবাসীর কাছে। এখানে ব্যঙ্গ গল্পটির সমাপ্তি।

গল্পটি যখন পাঠ করি তখন থেকেই আমার মনে খানিকটা খটকা লেগে গিয়েছিল। তখনই কেন জানি মনে হয়েছিল এটা মওলানা আকরম খাঁকেই নির্দেশ করছে। কেননা পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে সেই সময় আর তেমন কোনো মুসলিম ব্যক্তিত্বের সন্ধান মেলে না। কিন্তু, তখনও আমার জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ। এ ছাড়া, অন্যকোনো সূত্র থেকে এর স্বপক্ষে কোনো সমর্থন জানা ছিল না। কিন্তু, আগেই উল্লেখিত অন্যান্য লেখকদের বক্তব্যে (আবুল মনসুর বাদে) এর সমর্থন পেতে শুরু করলাম এবং আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ রচনা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারাও প্রায় সবাই এর ইসমাইল সাহেবকে মওলানা আকরম খাঁ হিসেবে শনাক্ত করেছেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক আবু জাফর শামসউদ্দিন তার 'আত্মস্মৃতি'তে যা উল্লেখ করেছেন, তা অনেকটা অবিকল আবুল মনসুর আহমদের উল্লেখিত গল্পের সঙ্গে মিলে যায়।

আবু জাফর শামসউদ্দিনের তুলনায় আবুল মনসুর আহমদ ১০ বছরের বড় হওয়ায় কিছু অগ্রবর্তী তথ্য দিতে পেরেছেন। যেমন: তাবলিগ মিশনের নামে চাঁদা তোলা ও আত্মসাৎ এবং পরবর্তীতে নানান অজুহাতে তা ধামাচাপা দেওয়ার উপচেষ্টা। তবে, খেলাফত আন্দোলনে সম্পর্কিত বিষয়ে উভয়ের মধ্যেই মিল লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও, আবু জাফর শামসুদ্দীন তার সুবিখ্যাত সুবৃহৎ 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' নামক উপন্যাসে আকবর খান নামে যে চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন, তাও অবিকল মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে মিলে যায়।

১৮ আগস্ট ১৯৬৮ সালে বংশালের আহলে হাদিস মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন আকরম খাঁ। কিন্তু, রেখে যান কীর্তিমান জীবন ও লিখিত গ্রন্থাদি। আর সাংবাদিকতার ইতিহাসের নিরিখে গবেষকরা দাবি করেন, মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক খাদেম, দৈনিক আজাদসহ আকরম খাঁ সম্পাদিত সংবাদপত্র নিয়ে আজকের সাংবাদিকদের যেমন অনুপুঙ্খ গবেষণা করা প্রয়োজন, তেমনি তার স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে স্মারক বক্তৃতাও চালুও জরুরি। এ ছাড়া, তার প্রজ্ঞামণ্ডিত রচনাবলীর নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ অত্যন্ত জরুরি।

প্রাসঙ্গিকভাবে মওলানা আকরম খাঁ নিয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর মতামত উল্লেখ করার মতো : 'মওলানা আকরম খাঁ সাহেব বহু বিষয়ে আমাদের বাঙালি মুছলিম সমাজের অগ্রপথিক। পত্রিকা পরিচালনার ব্যাপারে তিনিই প্রথম হিন্দু সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।... কাগজে ছবি ছাপান জায়েজ কি না-জায়েজ, এ নিয়ে যখন আমাদের আলেম সমাজে তুমুল তর্ক চলছিল, তখন তিনি "সমস্যা ও সমাধান" লিখে এ তর্কের সমাধান করেন।... কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু সংস্কৃতির লালন, বিকাশ, বিস্তারের জন্য যে ব্যাপক আয়োজন চলছিল, তার পাশে বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতিকেও স্থান দিতে হবে, এ আন্দোলন মওলানা সাহেবই শুরু করেন বলে মনে পড়ে। বাংলার মুসলমানরা আরবী ও ফারসী ভাষার যেসব শব্দ তাদের কথায় হামেশা ব্যবহার করে থাকেন, সেই সব শব্দকে সাহিত্যে স্থান দেওয়ার জন্য মওলানা সাহেব যে প্রচার করেন, তা নিষ্ফল হয় নাই।... এ দেশে বহু বিষয়ে মওলানা আকরম খাঁ একক। বিশিষ্ট অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এক বক্তব্যে বলেন, "বিভাগ পূর্বকালের বৃহৎ বাংলাকে বুঝতে হলে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁকে অনিবার্যভাবে স্মরণ করতে হবে"।'

Comments

The Daily Star  | English

Protest over students' death: Cuet to reopen on May 12

The Chittagong University of Engineering and Technology (Cuet), which was closed following a student protest over the death of two students in a road accident, will reopen on May 12.

55m ago