পাট ও চিনিকলে লোকসানের কারণ খুঁজতে গণতদন্ত কমিশন গঠনের দাবি

দেশের পাটকলগুলোতে কেন লোকসান হচ্ছে, চিনিকলগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না তা খুঁজে বের করতে অবিলম্বে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন এবং কমিশনের প্রতিবেদন জনগণের সামনে তুলে ধরার দাবি জানানো হয়েছে। 
ছবি: সংগৃহীত

দেশের পাটকলগুলোতে কেন লোকসান হচ্ছে, চিনিকলগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না তা খুঁজে বের করতে অবিলম্বে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন এবং কমিশনের প্রতিবেদন জনগণের সামনে তুলে ধরার দাবি জানানো হয়েছে। 

শনিবার দুপুর ২টায় ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে পাটকল চিনিকল রক্ষায় শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্যের উদ্যোগে '২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের মৌলিক শিল্প রক্ষায় বন্ধ সকল পাটকল চিনিকল চালু ও তার বিকাশে আমাদের প্রস্তাবনা' শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।  

সেমিনারে বক্তারা বলেন, স্বাধীনতা উত্তর সময় যত বেড়েছে সেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সংখ্যা তত কমেছে এবং শেষ পর্যন্ত গত ২০২০ সালের ৩০ জুন মহামারি করোনার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে অবশিষ্ট থাকা ২৬টি পাটকল একযোগে বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়। হিসাব দেখানো হয় বিগত ৪৯ বছরে এই রাষ্ট্রয়াত্ব পাটকলে লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই সময়ে ক্রমাগত লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে যেখানে সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ঠিক একই সময়, তথা ১৯৮২ সালে গড়ে উঠা বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা তত বেড়েছে। আজ বেসরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৮১টি। 

বক্তারা আরও বলেন, গত ২০২০ সালের ৩০ জুন পাটকল বন্ধের সময় পাটমন্ত্রী ঘোষণা করে ২ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা পরিশোধ করে ৩ মাসের মধ্যে মিল চালু করা হবে। অথচ এখনো পর্যন্ত ৫টি জুটমিলের ৮ হাজার ৪৬৩ জন অস্থায়ী শ্রমিক একটি টাকাও পায়নি। অবশিষ্ট ২০টি জুটমিলের প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিকের বকেয়া এরিয়ার টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় হলেও এখনো শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি। বকেয়া আছে প্রতিটি মিলের ৫-৬ সপ্তাহের পাওনা। ২ মাসের জায়গায় ২ বছর অতিবাহিত হতে চললেও বকেয়া পাওনা না পেয়ে শ্রমিকরা এখনো ঘুরছে পথে পথে। 

অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫টি চিনিকলে ৮২ হাজার টন উৎপাদন হয়েছিল। ৬টি মিল বন্ধের পর ২০২০-২১ অর্থবছরে চিনি উৎপাদন কমে ৪৮ হাজার টন হয়েছে, এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন কমে ২৪ হাজার টনে এসে নেমেছে। অর্থাৎ মিল বন্ধ হবার পর প্রথম বছর বাংলাদেশে চিনি উৎপাদন প্রায় ৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং তার পরের বছর তা আরও ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে যখন চিনি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ভারতে ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় চিনি রপ্তানি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। প্রায় একই ধরনের আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও যখন ভারতের চিনি শিল্পের বিকাশ ঘটছে তখন বাংলাদেশে চিনিশিল্প কেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলো না তা নিশ্চয়ই প্রশ্নের দাবি রাখে।

সেমিনারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ পাটের বিশাল সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরে বলেন, 'এরকম একটি সম্ভাবনাময় এবং কৌশলগত খাত বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে বেসরকারি মালিক নিশ্চিতভাবে মুনাফার দিকেই যাবে। তাই এই খাতকে সরকারি মালিকানাতেই থাকতে হবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সারা পৃথিবীতে পাটজাত শিল্পের চাহিদা দিন দিন বাড়বে। পাটশিল্প শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করালে গার্মেন্টস শিল্পের মতো অন্যদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হতো না। পাটকে জাতীয় শিল্প হিসেবে দেখতে হবে, শিল্পের স্বার্থ, শ্রমিকের স্বার্থের অংশ হিসেবে।'

এ ছাড়া আসন্ন বাজেট তিনি পাটশিল্পকে জাতীয় শিল্প হিসেবে দাঁড় করার পরিপূরক বাজেট বরাদ্দ রাখার দাবি জানান।

উক্ত সেমিনারে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, 'পাটকল চিনিকল চালুসহ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হলে এই সরকারকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে উৎখাত করতে হবে।'

প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, 'প্রথমেই পাটকল এবং চিনিকল বন্ধ করার ক্ষেত্রে এর পরিচালনকারী বিজেএমসিসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি করতে হবে এবং পরবর্তীতে শ্রমিকের চাকরি থাকবে কি থাকবে না সে প্রশ্ন আসবে।'

এ ছাড়া কেন পাটকলগুলোর লোকসান হচ্ছে, শ্রমিকরা ঠিকমতো তাদের পাওনা পাচ্ছে না তা খুঁজে বের করতে অবিলম্বে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন এবং কমিশনের প্রতিবেদন জনসম্মুখে উন্মোচনের দাবি জানান তিনি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমউদ্দিন খান বলেন, 'গত এক যুগে পাটশিল্প থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা রপ্তানিমূলক আয় হয়েছে। এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রকার জবাবদিহিহীতা নেই বরং শেয়ার বাজারে দুর্নীতি করে যারা, তারাই বাণিজ্য উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য হয়। তাই দেখা গিয়েছে, পাটমন্ত্রালয়ের সঙ্গে যুক্ত বেশির ভাগই প্লাস্টিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। পাটকল এবং চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই সমস্যা শ্রমিকের সমস্যা নয়। তাই শ্রমিকের আন্দোলনকে বিশৃংখলা হিসেবে না দেখে এইটিকে সরকারের সংকট এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণ হিসেবে দেখে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সরকার এই শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য ভর্তুকি দিতে বাধ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কৃষি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা দেয়। কিন্তু  আমাদের সরকার বেনিয়াদের দখলে চলে আছে এবং বেনিয়া হয়ে ক্ষমতায় টিকে আছে। মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং কল্যাণকামীতা নেই।' 

লেখক ও গবেষক ড. মাহা মির্জা বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেন, 'বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া দেশের ৭৫টি সরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে আর চালুই করা যায়নি। কাজেই বেসরকারিকরণ করলেই শিল্পের বিকাশ হবে এবং প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হবে- বাংলাদেশের বেসরকারিকরণের ইতিহাস তা বলে না।'

তিনি আরও বলেন, 'গণমাধ্যমে পাটকল-চিনিকলের ভর্তুকির বিষয়টি বারবার সামনে আনা হয়, অথচ রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকি পাওয়ার ইতিহাস দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলোর চেয়ে বহুগুণ বেশি।'

এ ছাড়া বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিল্পের বিকাশের পেছনে থাকে রাষ্টের বিপুল প্রণোদনা। নিয়মিত রাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতা না পেলে পশ্চিমা বিশ্বের বিপুল সংখক শিল্প প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করে টিকে থাকাই সম্ভব হতো না।'

চিনিকল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, 'রাষ্ট্রীয় ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির জন্য। এবং এই উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বড় কারণ ছিল পুঞ্জীভূত ঋণ। এ ছাড়া আরও অন্য কারণে উৎপাদনের খরচ বেশি ছিল। যেমন: আখের দাম নিয়মিত পরিশোধ না করার কারণে আখ চাষে অনীহা, পর্যাপ্ত আখের সরবরাহ না থাকা, বিলম্বে আখ মাড়াইয়ের কারণে আখের সুক্রোজ কমে যাওয়া, পরনো যন্ত্র ব্যবহারের কারণে আখ থেকে চিনি কম উৎপাদন হওয়া, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, পূর্জি বিতরণের অনিয়ম। অথচ এই বিষয়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিলেই উৎপাদন খরচ কমানো যেত এবং এখনো চেষ্টা করলে ও সরকার উদ্যোগী হলে সেই চিনিকলগুলোকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করা সম্ভব।'

বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, 'পাটকল আধুনিকায়নের জন্য ১২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়নি, কিন্তু ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ সরকারের চোখ পড়েছে জমির দিকে। এই মহা মূল্যবান পাটকল এবং চিনিকলের জমি ব্যবসায়ীদের হাতে দিয়ে দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। বেসরকারি পাটকল শ্রমিকদের বেতনমাত্র ৫ হাজার টাকা যা দিয়ে তার ন্যূনতম জীবনমানও রক্ষা হয় না।'

বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত জনগণের মালিকানাধীন পাটকলগুলো লুটেরাদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। পাটকলগুলো রক্ষার দাবিতে শ্রমিক কৃষকের পরিবার নিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।'

এই সেমিনার থেকে দেশের অর্থনীতি, মৌলিক শিল্প, জনগণের সম্পদ, শ্রমিকের কর্মসংস্থান, স্থানীয় অর্থনীতি ও চিনি এবং পাটচাষীদের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ও চিনিকল রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করার জোর দাবি জানানো হয়েছে এবং ৭ দফা দাবি জানানো হয়েছে।

Comments