রাবিতে ১ লাখ ২৮ হাজার ভর্তিচ্ছুর তীব্র আবাসন সংকটের আশঙ্কা

আবাসিক হল বন্ধ রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তের কারণে আগামী অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহে সারা দেশ থেকে আসা ১ লাখ ২৮ হাজার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাজশাহী শহরে তীব্র আবাসন সংকটের সম্মুখীন হতে পারেন।
রাবি
ফাইল ছবি

আবাসিক হল বন্ধ রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তের কারণে আগামী অক্টোবরে প্রথম সপ্তাহে সারা দেশ থেকে আসা ১ লাখ ২৮ হাজার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাজশাহী শহরে তীব্র আবাসন সংকটের সম্মুখীন হতে পারেন।

শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবকরা এই আশঙ্কা প্রকাশ করে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ভর্তি পরীক্ষার সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজশাহী আসা ভর্তিচ্ছুদের অন্তত ৫০ শতাংশ ক্যাম্পাসের হলগুলোতে অবস্থান নেন। এবার হল বন্ধ থাকায় অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা যারা দূরবর্তী অঞ্চল থেকে যারা রাজশাহীতে আসবেন তাদের আবাসন সংকট তীব্রভাবে মোকাবিলা করতে হতে পারে।

কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে তাদের 'কিছুই করার ছিল না'।

রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি নিরুপায়। কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। অত্যন্ত দুঃখিত যে আমরা ভর্তিচ্ছুদের বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।'

তিনি জানিয়েছেন যে মহামারি পরিস্থিতিতে হল খোলার সিদ্ধান্তকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে দেখেছে। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছিলেন যে আগস্টের শেষের দিকে তিনি ভিসি হওয়ার আগে ভর্তি পরীক্ষা নির্ধারিত হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাননি।

আগামী ৪, ৫, ৬ অক্টোবর ৩টি ইউনিটে বিভক্ত প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার ভর্তিচ্ছু দিনে ৩ শিফটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে বসবেন। সেসময় প্রতিদিন অন্তত ৪৫ হাজার ভর্তিচ্ছু ও তাদের কারো কারো অভিভাবকও রাজশাহীতে অবস্থান করবেন।

এ দিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে ১ অক্টোবর। পরে ২, ৯, ২২ ও ২৩ অক্টোবরেও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তখন রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলার প্রায় ৩৬ হাজার অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর রাজশাহী শহরে অবস্থান নেবেন।

রাবিতে ছাত্রদের জন্য ১১টি, ছাত্রীদের জন্য ৬টি ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ১টি আবাসিক হল আছে। এ হলগুলোয় অন্তত ৮ হাজার শিক্ষার্থী থাকতে পারেন।

ভর্তি পরীক্ষার সময়, রাবি শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে হলগুলোর ধারণ ক্ষমতার ৬ গুণেরও বেশি শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা করেন।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ডেইলি স্টারকে জানান, যদিও ভর্তিচ্ছুদের থাকার ব্যবস্থা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নয়, তবে এটি বহু বছরের পুরনো ঐতিহ্য যে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ হলগুলোয় ভর্তিচ্ছুদের থাকার অনুমতি দেয়।

হলগুলোয় শিক্ষার্থীদের জন্যে নির্ধারিত কক্ষ ছাড়াও, রাবি কর্তৃপক্ষ ভর্তিচ্ছুদের জন্যে হলের অডিটোরিয়াম, মসজিদ, ডাইনিং রুম, কখনও কখনও হলের বারান্দাসহ অন্যান্য খোলা জায়গায় থাকার অনুমতি দেয়।

রাবি ছাড়াও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হল ও মেসগুলোতে ভর্তিচ্ছুরা অবস্থান করেন।

মেস ছাড়া আর কোনো পাবলিক হল এবার খোলা থাকছে না।

ঢাকার সাভারের এক ভর্তিচ্ছুর অভিভাবক আশিক সাদিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ৩ সপ্তাহ ধরে ছেলের রাজশাহীতে থাকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। এখনো কোনো ব্যবস্থাই করতে পারিনি। শহরে আমার পরিচিত কেউ নেই। জানি না ছেলেকে রাজশাহীতে নিয়ে যাব কিনা।'

বরিশালের ছাত্র সাগর পারভেজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক টাকায় প্রাইভেট ডরমিটরিতে রুম নিতে হয়েছে।'

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ রেখে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের সংগঠন স্টুডেন্টস রাইটস অ্যাসোসিয়েশন ক্যাম্পাসে আজ সকাল ১১টায় মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে। তাদের দাবি ক্যাম্পাসের ভেতরেই সুষ্ঠু ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা।

এক শিক্ষার্থী আলভি মনির ফেসবুকে লিখেছেন, আরইউ হল বন্ধ থাকলে আবাসিক হোটেল ও প্রাইভেট ডরমিটরির মালিকরা ব্যবসা করে উপকৃত হবেন।

টিআইবি পরিচালিত রাজশাহীর সচেতন নাগরিক কমিটি পরীক্ষার সময় হল খোলার আহ্বান জানিয়ে রাবি উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।

সম্প্রতি ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে রাবি উপাচার্য বলেছিলেন, ভর্তি পরীক্ষার সময় সীমিত সময়ের জন্যে হল খোলার প্রস্তাব তিনি প্রভোস্ট কাউন্সিলের কাছে করেছিলেন।

'প্রভোস্ট কাউন্সিল রাজি হয়নি' বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

উপাচার্য জানিয়েছিলেন, প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার আগে হল খুলতে রাজি হননি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া হয়েছে এবং টিকা দেওয়ার হার ৮০ শতাংশ হলেই তারা হল খুলবে।

যোগাযোগ করা হলে প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো একরাম হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যারা এখনো আমাদের ছাত্রই হননি, শুধুমাত্র তাদের জন্যে হল খোলার বিষয়ে আমরা আলোচনায় বসতে পারিনি।'

তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা অনুসরণ করবো।'

গত সেপ্টেম্বর ২৪ এক সভায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনও রাবির ভর্তি পরীক্ষার সময় তীব্র আবাসন সংকটের আশঙ্কা করেছে।

ঐ দিন রাবি কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি ও মেস মালিকদের সঙ্গে আলোচনার পর রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, 'এই প্রথমবারের মতো যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ তখন ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। হলগুলো বন্ধ থাকায় আবাসন সংকট দেখা দিতে পারে।'

'বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নগরীর ব্যক্তিগত ছাত্রাবাস, আবাসিক হোটেল, সরকারি রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউসে ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে অন্তত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হবে। বাকিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকবেন,' যোগ করেন তিনি।

তিনি জানান, রাজশাহী মহানগর পুলিশ যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবে। এ ছাড়া, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা ও ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঐ দিনের সভায় মেস মালিকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, বেসরকারি ছাত্রাবাসগুলোর মালিকরা ভর্তিচ্ছুদের থাকার কোনো খরচ নেবে না।

যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী শহর বেসরকারি ছাত্রাবাস মালিক সমিতির সভাপতি মো এনায়েতুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছাত্রদের ওপর নির্ভর করেই আমাদের ব্যবসা। কাজেই মানবিক কারণে তাদের প্রয়োজনে আমরা এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

তিনি আরও বলেন, 'ভর্তিচ্ছুরা বিনামূল্যে আমাদের ছাত্রাবাসে থাকতে পারবেন। তবে তাদের অভিভাবকরা নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে ছাত্রাবাসে থাকতে পারবেন।'

তিনি জানান, রাজশাহী শহরে ৫ হাজারের বেশি ব্যক্তিগত ছাত্রাবাস ছিল। মহামারির কারণে ২ হাজার ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৩ হাজার ছাত্রাবাসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু, রাবি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীদের অনেকে মনে করেন, সরকারি ছাত্রাবাসগুলো না খুলে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ছাত্রাবাসের ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত 'বাস্তবতা বিবর্জিত'।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২ শিক্ষক ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'ভর্তিচ্ছুদের অনেকের রাজশাহী শহর ও এর ব্যক্তিগত ছাত্রাবাসগুলো সম্পর্কে খুব কম ধারণা আছে। তারপরও, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসগুলো বন্ধ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ায় হলের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত ছাত্রাবাসে উঠেছে। ভর্তিচ্ছুরা চরম ভোগান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। সব ভর্তিচ্ছু শহরের নানা স্থান থেকে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার সময় শহরে তীব্র যানজট হতে পারে।

নিকট অতীতে যখন সরকারি ও বেসরকারি ছাত্রাবাসগুলো খোলা ছিল, তখনই আবাসনের সংকট দেখা গেছে। এবার হল বন্ধ রেখে সংকট এড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন তারা।

শহরের আবাসিক হোটেলগুলো বুকিং নেওয়া বন্ধ করেছে এক মাস আগে। হোটেলে যে কক্ষের ভাড়া ৩০০ টাকা, সেগুলো ২ হাজার টাকায় বুকিংয়ের সংবাদ পাওয়া গেছে।

রাজশাহী আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার হাসান কবির ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শহরের প্রায় ৬২টি হোটেলে ২ হাজার লোকের থাকার ক্ষমতা রয়েছে ও এই কক্ষগুলোর কোনোটিই খালি নেই।

কবির বলেন, 'আমাদের সমিতির অধীনস্থ হোটেলগুলো তাদের কক্ষের জন্য বেশি দাম নেয় না। কিন্তু, আমি সেসব হোটেল সম্পর্কে বলতে পারি না যা আমাদের সমিতির তালিকাভুক্ত নয়।'

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কিছু ছাত্র এই সুযোগে ব্যবসা শুরু করেছে। ভর্তিচ্ছুদের জন্যে কোথাও আসন মিলছে না। কিন্তু, ফেসবুকে অনেককে ১ হাজার টাকায় আসন পাওয়া যাচ্ছে বলে পোস্ট দিচ্ছেন। একজনের মন্তব্য, ছাত্রাবাসগুলো থেকে বিনামূল্যে কক্ষ নিয়ে কেউ কেউ ব্যবসা শুরু করেছেন বলে মনে হচ্ছে।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলার সময় রাবি উপাচার্য বলেন, 'আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় হল খোলার বিষয়টি আবার উত্থাপন করা হবে।'

কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষার আগে হল খোলা অনিশ্চিত, তিনি বলেন।

তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে আমরা হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু করেছি। কিন্তু, সব কাজ শেষ হতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ হয়ে যেতে পারে।'

দ্য ডেইলি স্টারের রাবি প্রতিনিধি আরাফাত রাহমান প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন

Comments

The Daily Star  | English
No respite from heat wave for five days: BMD

Heat takes a toll on expecting mothers

The ongoing heatwave has exacerbated the challenges faced by everyone in the country, but the situation has become particularly difficult for expecting mothers.

26m ago