ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৭টি উঁচু ভবন নির্মাণের মহাপরিকল্পনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো পরিবর্তনে ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিয়েছে প্রশাসন। এতে বদলে যাবে শতাব্দী প্রাচীন এই ক্যাম্পাসের বর্তমান চিত্র।
নান্দনিক অবকাঠামো, অসংখ্য গাছপালা ও সবুজে ভরপুর এই প্রতিষ্ঠানটিতে ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মচারীদের সুবিধায় অবকাঠামোগত সংশোধনের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনায় ৫৯৯টি পুরানো স্থাপনা ভেঙে ৯৭টি উঁচু ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি ১০ তলা ভবন বা তার চেয়েও উঁচু।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দিয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেটেক্স (ডেটা এক্সপার্ট প্রাইভেট লিমিটেড) এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে ৯ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মহাপরিকল্পনায় নতুন একাডেমিক ভবন ছাড়াও আছে একটি আধুনিক গ্রন্থাগার, আধুনিক সুবিধা সম্বলিত চিকিৎসা কেন্দ্র, জিমনেসিয়াম, মেয়েদের জন্য সুইমিং পুল এবং গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা।
এতে বাইসাইকেলের জন্য আলাদা লেন, ওয়াকওয়েসহ নতুন রাস্তা, খেলার মাঠের উন্নয়ন, উন্নত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সবুজায়ন এবং জলাশয়ের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মহাপরিকল্পনাটি তিন ধাপে বাস্তবায়িত হবে। প্রথম ধাপে মোট ২৮টি ভবন হবে, যার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ২০ তলার একটি প্রশাসনিক ভবনও রয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উত্তর-পশ্চিম অংশটি ভেঙে সেখানে ১২ তলা ভবনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
খসড়া মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাবি ক্যাম্পাস ৩০৪ দশমিক ২১ একর জমির উপর অবস্থিত। মূল ক্যাম্পাস শাহবাগ, কাঁটাবন, পলাশী এবং কার্জন হল এলাকায় ২৭৬ দশমিক ২৮ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
এখানে মোট আয়তনের ২৬ শতাংশ এলাকায় ৯৮৫টি ভবন রয়েছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মোট আয়তনের ২১ শতাংশ জায়গা বিভিন্ন ভবনের দখলে থাকবে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, মহাপরিকল্পনাটি ঢাবির ক্রমবর্ধমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের আবাসন ও অন্যান্য সমস্যাগুলো কমাবে।
ঢাবিতে বর্তমানে ৪১ শতাংশ শিক্ষার্থী, ২৯ শতাংশ শিক্ষক-কর্মকর্তা এবং ২২ শতাংশ কর্মচারীর আবাসন সুবিধা আছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর, ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৫৩ শতাংশ শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং ৩৫ শতাংশ কর্মচারী আবাসন সুবিধা পাবে বলে পরিকল্পনায় বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাবি শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, 'কর্তৃপক্ষ এমন সময়ে ক্যাম্পাসে হাজার হাজার কর্মচারীর আবাসন সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছে যখন তাদের ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার্থে ডিজিটালাইজড সিস্টেম চালু করা উচিত।'
তিনি ২০ তলা প্রশাসনিক ভবনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'অবশ্যই আমাদের উন্নয়ন দরকার, কিন্তু আমাদের কোনো আমূল পরিবর্তন করা উচিত নয়। আমাদের নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখা উচিত।'
তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত জায়গা শিক্ষার পরিবেশ ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
তিনি বলেন, 'এখানে প্রচুর গাছ, খোলা জায়গা এবং আকর্ষণীয় স্থাপনা থাকা উচিত যা মানুষের জন্য একটি সাংস্কৃতিক-শিক্ষার গন্তব্য হতে পারে।'
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে শিক্ষার মান কীভাবে বাড়ানো যায় তার ওপর ঢাবি কর্তৃপক্ষের আলাদা পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।
শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতার দাবি জানান।
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, 'পরিকল্পনা শুধুমাত্র প্রকৌশলীদের দ্বারা করা উচিত নয়— এতে দেশের সেরা আধুনিক স্থপতি, নন্দনতত্ত্ববিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাস্তুবিদ্যা ও বনবিদ্যা বোঝেন এমন পরিবেশবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।'
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাবির প্রধান আকর্ষণ মানবিক স্কেল মডেল যেখানে কার্বনের গতিশীলতা কম এবং এটি জনবহুল নগরের বিকল্প বিস্তৃতি হিসেবে পরিচিত।
তিনি বলেন, 'মানবিক স্কেলটি ঢাবির প্রধান আকর্ষণ এবং আমরা ইতোমধ্যেই কিছু উঁচু ভবন নির্মাণ করে এটি ধ্বংস করা শুরু করেছি।'
উঁচু ভবন বাণিজ্যিক জায়গার জন্য উপযুক্ত দাবি করে তিনি বলেন, 'আমরা যদি বাণিজ্যিক মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আনি তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।'
ঢাবির সাবেক উপ-উপাচার্য আ ফ ম ইউসুফ হায়দার বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কনক্রিটের জঙ্গল হওয়া উচিত নয়। এটি পরিবেশের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে।'
শিক্ষার মান উন্নয়নে বিশেষ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আধুনিক গবেষণাগার নির্মাণ ও গবেষণার মান উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা থাকতে হবে।
উঁচু ভবন নির্মাণ সময়ের দাবি স্বীকার করে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের অবশ্যই মধুর ক্যান্টিন এবং চারুকলা ভবনের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা করতে হবে।'
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
মহাপরিকল্পনার কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক ঢাবির প্রো-ভিসি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, 'আমরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়েছি, সিন্ডিকেটে প্ল্যান পাস করেছি এবং অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দেশনা দিলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হবে। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে উঁচু ভবন তৈরি করা 'সময়ের দাবি'।
'সবুজ, ঐতিহ্য, পরিবহন, দূষণ, জলাবদ্ধতার সমাধান ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে,' তিনি যোগ করেন।
উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ, উন্মুক্ত স্থান ও ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোকে সুরক্ষিত রাখার জন্য তারা প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছেন।
'পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি পাবে। আমাদের প্রথম লক্ষ্য হল একাডেমিক ও গবেষণার চাহিদা পূরণ করা,' তিনি যোগ করেন।
শিক্ষার মান উন্নয়নে পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাডেমিক উন্নয়নের পরিকল্পনা একটি চলমান প্রক্রিয়া।
উপাচার্য বলেন, 'একাডেমিক চাহিদা বিবেচনা করে মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।'
অনুবাদ করেছেন সুমন আলী
Comments