কেন লজ্জা, কেন প্রতিবাদ নয়?

প্রথম সাড়ে ৩ বছর বাদে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তো আমরা সামরিক শাসনে ছিলাম। সেই সময়ের কথা হিসাবে ধরছি না। ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু-বৌদ্ধ-সাঁওতাল-চাকমা-মারমা…দের ওপর যত হামলা হয়েছে, হত্যা-ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হয়েছে, ঘর-বাড়ি ছাড়া করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কোন ঘটনাটির তদন্ত ও বিচার হয়েছে? স্মরণ করতে পারছি না। কেউ তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে উপকৃত হবো।

প্রথম সাড়ে ৩ বছর বাদে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তো আমরা সামরিক শাসনে ছিলাম। সেই সময়ের কথা হিসাবে ধরছি না। ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত হিন্দু-বৌদ্ধ-সাঁওতাল-চাকমা-মারমা…দের ওপর যত হামলা হয়েছে, হত্যা-ভাঙচুর-আগুন দেওয়া হয়েছে, ঘর-বাড়ি ছাড়া করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কোন ঘটনাটির তদন্ত ও বিচার হয়েছে? স্মরণ করতে পারছি না। কেউ তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে উপকৃত হবো।

দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলেও সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি দেশ পরিচালনা করছে। গত ১৩ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রচলিত ধারণা যে, আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সংবেদনশীল। সংখ্যালঘুরাও ভরসা করতে চায়, আশ্রয় পেতে চায় আওয়ামী লীগের কাছেই। সেই আওয়ামী লীগ এখন শুধু ক্ষমতায় নয়, দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। ক্ষমতায় তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, এ কথা আওয়ামী লীগ নেতারা সবাই বলেন।

যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর জামায়াত অস্তিত্ব সংকটে। বিএনপিকে কেউ ভোটই দেবে না, এ কথাও শোনা গেছে কয়েকদিন আগে। ২০ দলীয় জোটও ভেঙে ছোট হয়ে গেছে। জাতীয় পার্টি, হেফাজতে ইসলাম সরকারের কাছাকাছিই আছে। সরকারের দাবি, জঙ্গিও দমন করে ফেলা হয়েছে। বিএনপি একটি সমাবেশ তো নয়ই, একটি মিছিলের জন্যে পুলিশের অনুমতি চেয়ে বসে থাকে। অনুমতি ছাড়া ৫-৭ জনে মিছিল করলেও পুলিশ পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আওয়ামী লীগের একক ক্ষমতার এক যুগেরও বেশি সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ ভিন্ন ধর্মের মানুষ কতবার আক্রান্ত হলেন? চট্টগ্রামের বৌদ্ধ পল্লীতে কারা তাণ্ডব চালিয়েছিল? যশোরের অভয়নগর, পাবনার সাঁথিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, এবারের কুমিল্লাসহ সারাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে হামলা হলো, কারা করলো এই হামলা? ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় এবং বিএনপির বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। সিরাজগঞ্জসহ দেশের বেশকিছু অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, ঘটেছিল ধর্ষণের ঘটনা। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদে দেশ তোলপাড় হয়েছিল। হামলা-ধর্ষণের দায় দায়িত্ব অস্বীকার করলেও, পুরোটাই নিতে হয়েছিল বিএনপিকে। কারণ তারা জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তাদের নেতাকর্মী বা অন্যরা হামলা করেছিল। ঠেকানো বা প্রতিরোধের দায়িত্ব ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপির। তারা তা করেনি। ফলে দায় নিতে হয়েছে, বিএনপিকে দায়ী করা হয়েছে, এখনো করা হয়, ভবিষ্যতেও করা হবে। সেই সময় যারা সরব ছিলেন এখন তারা নিরব। মূলত প্রতিবাদ বিষয়টিই ঝিমিয়ে পড়েছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই 'লজ্জা' পাচ্ছেন 'মুখ লুকাচ্ছেন', 'ক্ষমা চাইছেন'।

এই হামলার জন্য সরকারের অভিযোগ কখনো সরাসরি বিএনপির দিকে, কখনো বায়বীয় শক্তির বিরুদ্ধে। বিএনপির সরাসরি অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে।

কুমিল্লার ঘটনাটি কারা ঘটাল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটি প্রায় অনুপস্থিত। প্রথম কে জানলো, কে প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি পোস্ট করলো? অল্প সময় বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটা বের করা অসম্ভব হওয়ার কথা নয়। সেদিকে সরকারি সংস্থাগুলোর মনোযোগ আছে বলে প্রথম দুদিনে দৃশ্যমান হলো না। জানানোর পরও কেন তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ এগিয়ে এলো না, ৯৯৯-এ ফোন করেও কেন সারা পাওয়া গেল না, স্থানীয়দের এসব অভিযোগ তদন্তে সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তদন্ত সেই পথে বা গতিতে হচ্ছে? সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক নেতা স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্যের দিকে ইঙ্গিত করলেন। এই অভিযোগের তদন্ত হবে বা শুরু হয়েছে? পূর্বের ঘটনাগুলো বিবেচনায় এই অভিযোগগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

নাসিরনগরের হামলায় সরকার দলীয় ২ সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্বের যে বিষয়টি গণমাধ্যম সামনে এনেছিল, সেসব বিষয়ে আদৌ কোনো তদন্ত হয়েছে কি না জানা যায়নি।

'নাসিরনগরের এমপি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের সঙ্গে মোকতাদির ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের দ্বন্দ্বই হামলার নেপথ্য কারণ হিসেবে উদঘাটিত হয়েছে।' (বিডিনিউজ২৪.কম, ১০ নভেম্বর ২০১৬)

এই হামলার অভিযুক্ত চার্জশিটভূক্ত ৩ আসামিকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়ে পরে আবার ২ জনের মনোনয়ন বাতিল করেছে।

সাঁথিয়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়ি আক্রমণকারীদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও সেই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু তাদের দেখতে গিয়েছিলেন। সেই সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

'Mithu, one of the men alleged to have vandalised over 100 Hindu houses and temples, inset, at Bonogram in Santhia of Pabna on Saturday, is seen behind State Minister for Home Shamsul Hoque Tuku when he visited the area yesterday. (The Daily Star, 7 November 2013)

এসব প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে বা প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ না করে, কেন লজ্জা পেতে হবে বা ক্ষমা চাইতে হবে? যারা বাড়ি-মন্দির-প্রতিমা ভাঙল, লুটপাট করল—তারা অপরাধী। যাদের হামলায় মানুষ নিহত হলো, তারা হত্যাকারী। তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করার কথা। এখনকার ঘটনার তদন্ত-বিচার চাইতে হবে। পূর্বের ঘটনাগুলোর তদন্ত-বিচার কেন হয়নি, তুলতে হবে সেই প্রশ্ন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত না করায় সরকারকে অভিযুক্ত করে প্রশ্ন তুলতে হবে। যেভাবে ২০০১ সালের ঘটনার পরে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, প্রতিবাদ করা হয়েছিল।

এখন যদি প্রশ্ন তোলা না হয়, প্রতিবাদ করা না হয়, লজ্জায় মুখ লুকালে কি মিছিল-ভাঙচুর-হত্যাকারীদের একজন হয়ে যেতে হয় না?

আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে হবে।

প্যালেস্টাইনে বা রাখাইনে যখন মুসলমানরা নিপীড়িত হয়, আমরা ব্যথিত হই, বিক্ষুব্ধ হই। আবার সেই আমরাই নিজ দেশে সংখ্যায় যারা কম তাদের ওপর আক্রমণ করি। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, কেউ হামলাকারীদের চিহ্নিত করে না। বিচার করে না। শুধু রাজনীতি করে। এটা তো আমার আপনার লজ্জা পাওয়ার বিষয় নয়, প্রতিবাদের বিষয়।

'হামলাকারী কাউকে ছাড়া হবে না'—এই বক্তব্যের অর্থ বা তাৎপর্য কী? কোনো ঘটনার তদন্ত-বিচার না করে বছরের পর বছর ধরে কেন এমন বক্তব্য? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন তথ্যের ভিত্তিতে বলেছিলেন, পূজা মণ্ডপে কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই? শুক্রবার জুমার নামাজের পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পূজা মণ্ডপে হামলা হলো। এমন হামলা যে হতে পারে, তা অপ্রত্যাশিত ছিল না। গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ না করে তাদের দায় সারল বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিল। সরকার কী করলো?

কোনো কোনো জায়গার ইউএনওরা আমাদের সংবাদকর্মীদের বলেছেন, আমরা অসহায়, হামলাকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তাহলে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ-বিজিবি থাকল না কেন? বিরোধীদলের রাজনৈতিক সমাবেশ-মিছিলের চেষ্টা যে ক্ষীপ্রতা-কঠোরতার সঙ্গে প্রতিহত করা হয়, ভাঙচুরকারীদের ক্ষেত্রে তা দেখা গেল না কেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নমনীয় আচরণে হামলা চলতে থাকল। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ছিল বলেই চাঁদপুরে গুলি চালানো হয়েছে এবং ৪ জন নিহত হয়েছেন। এও এক অদ্ভুত বিষয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোরতা মানেই গুলি এবং মানুষ হত্যা। এর বাইরে আর কোনো দক্ষতা বা প্রশিক্ষণ নেই? মন্দিরে ভাঙচুর ঠেকাতে গুলি করে মানুষ হত্যার নাম কঠোরতা হতে পারে না। এই গুলি এবং নিহতের পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির আরও পরিণতির সম্ভাবনা থাকে। যা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয়, আন্তরিকতার সঙ্গে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া হয় কি না?

সংখ্যায় যারা কম তাদের ঘর-মন্দিরে হামলা, নিপীড়ন-হত্যার মতো অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে প্রকাশ্যে। ধর্মের নামে একদল উন্মাদ এসব অপকর্ম করছে। এই উন্মাদদের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয়-প্রশ্রয় ও পরিচালনা করছে রাজনীতিকরা। 'রাজনীতিক' মানে বায়বীয় কোনো বস্তু নয়। তারা চিহ্নিত, তাদের চেনা যায়, জানা যায়। ক্ষমতাসীনরা গত ৩০ বছর ধরে তাদের 'আড়াল' করে রাখছে। সেই আড়ালের দেওয়াল ভাঙার সামর্থ্য হয়ত আমার আপনার নেই, কিন্তু প্রতিবাদ ও প্রশ্ন করার সামর্থ্য আছে। প্রতিবাদ না করে লজ্জা পেলে বা ক্ষমা চাইলে, তবে 'আড়াল' করে রাখাওয়ালাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পার্থক্য থাকবে না।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Protest over students' death: Cuet to reopen on May 12

The Chittagong University of Engineering and Technology (Cuet), which was closed following a student protest over the death of two students in a road accident, will reopen on May 12.

47m ago