এই ‘উন্নয়ন’ কার জন্য?

প্রথমবারের মতো তারা বাস্তুচ্যুত হন ১৯৫০ সালে। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেই জমিতে আখের খামার করে স্থানীয় সাঁওতাল ও বাঙালিদের মজুর হিসেবে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। এটি ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকের ঘটনা। তখনও উপমহাদেশের বাসিন্দারা দেশভাগ এবং রায়টের ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি। স্থানীয় সম্প্রদায়ের মনে সম্ভবত তখনো ১৯৫০ সালের মার্চে পাকিস্তান পুলিশের হাতে গোবিন্দগঞ্জের সীমান্তের কাছে ১৭ সাঁওতাল শরণার্থী হত্যার স্মৃতি সতেজ। তবে খুব সম্ভবত ক্ষুধার যন্ত্রণা আরও বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। প্রায় ২ শতকের ঔপনিবেশিক শোষণের পর সে সময় উত্তরবঙ্গ ছিল সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত অঞ্চল এবং পরবর্তী আরও বেশ কয়েক দশকেও এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ছবি: মোস্তফা সবুজ

প্রথমবারের মতো তারা বাস্তুচ্যুত হন ১৯৫০ সালে। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে। সেই জমিতে আখের খামার করে স্থানীয় সাঁওতাল ও বাঙালিদের মজুর হিসেবে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় সরকার। এটি ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকের ঘটনা। তখনও উপমহাদেশের বাসিন্দারা দেশভাগ এবং রায়টের ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেননি। স্থানীয় সম্প্রদায়ের মনে সম্ভবত তখনো ১৯৫০ সালের মার্চে পাকিস্তান পুলিশের হাতে গোবিন্দগঞ্জের সীমান্তের কাছে ১৭ সাঁওতাল শরণার্থী হত্যার স্মৃতি সতেজ। তবে খুব সম্ভবত ক্ষুধার যন্ত্রণা আরও বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। প্রায় ২ শতকের ঔপনিবেশিক শোষণের পর সে সময় উত্তরবঙ্গ ছিল সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত অঞ্চল এবং পরবর্তী আরও বেশ কয়েক দশকেও এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এখন আমরা জানি এই জমির মূল মালিকদের সঙ্গে শোষক পাকিস্তানি সরকার প্রতারণা করেছিল। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ একরের মালিকানা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের এবং বাকিটা স্থানীয় বাঙালিদের ছিল। ২০১৬ সালে দ্য ডেইলি স্টার এই দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য পুরনো ভূমি রেকর্ড, ১৯৬২ সালে রংপুর জেলা প্রশাসন ও পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি এবং ১৯৪০ সালের করা একটি ক্যাডাস্ট্রাল জরিপের প্রতিবেদন পরীক্ষা করে। পরীক্ষা শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরবর্তীতে মাত্র ২ জন সাঁওতালকে খামারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের কাছে আর কখনোই সে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি এবং গত বছর পর্যন্ত সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত রংপুর চিনি কলের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। সাঁওতাল ও বাঙালি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বিগত বছরগুলোতে তাদের পৈত্রিক জমিতে অস্থায়ী বাড়ি বানিয়ে থাকলেও বাস্তবতা এটাই যে তাদের মালিকানা ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরসহ পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় বাস্তুচ্যুতির ঘটনা মাত্র ৫ বছর আগের। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর ২ হাজারেরও বেশি সাঁওতাল ও বাঙালি পরিবারকে এই এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের আগে পরিবারের সদস্য, চিনিকলের কর্মী ও পুলিশের মধ্যে একটি ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়, যার ফলশ্রুতিতে ৩ জন সাঁওতাল নিহত হন এবং ৯ পুলিশসহ আরও অন্তত ২০ জন আহত হন। তাদের অস্থায়ী বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং তারা প্রায় প্রত্যেকেই তাদের সহায় সম্পত্তি হারান।

এখনো ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাননি। উল্টো সংঘর্ষের জের ধরে করা মামলা লড়ার জন্য তাদের অনেককেই মূল্যবান সময় ও সম্পদ খরচ করতে হচ্ছে। এই দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া তাদেরকে কর্মসংস্থানের জন্য অন্যত্র যেতেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ সদস্য মূলত স্বল্প আয়ের কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, ভিন্ন এলাকায় আরও বেশি আয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের জন্য খুবই জরুরি।

যদি সরকার বিতর্কিত জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে খুব শিগগির আমরা তৃতীয়বারের মতো এই এলাকার বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত হতে দেখবো। সাহেবগঞ্জ-বাগদা এলাকায় বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ সাঁওতাল ও বাঙালি পরিবার বসবাস করছে। কাছের মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া নামের ২টি সাঁওতাল গ্রামও ইপিজেড স্থাপনের ঝুঁকিতে আছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় প্রতিটি কর্মকর্তা দাবি করছেন, এই জমি সরকারের। প্রকল্প পরিচালক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তান আমলে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি পুরোপুরি অধিগ্রহণ করা হয় এবং সরকার এই জমি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানি শাসকের অধিগ্রহণের ঘটনাকে কেন এত সহজে স্বাধীন বাংলাদেশে মেনে নেওয়া হচ্ছে? যখন আমরা জানছি, সেই শাসকের মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে শোষণ করা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও ভোগান্তিকে উপজীব্য করে মুনাফা অর্জন করা। আমাদের কী উচিত নয় আমাদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এই নির্দয় ও শোষণমূলক নীতিমালার সব নেতিবাচক প্রভাবকে দূর করা, যার কারণে গাইবান্ধার হাজারো মানুষ গরিব ও গৃহহীন হয়েছেন?

২০১৬ সালের হামলার পরে কিছু বিশেষ মহল থেকে বলা হতে থাকে, ওই জমি কখনোই সাঁওতালদের মালিকানায় ছিল না। এ বিষয়টি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব এবং অন্যান্যদের অনুসন্ধান থেকে এ দাবির স্বপক্ষে কোনো ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৬২ সালের চুক্তিতে ২টি গুরুত্বপূর্ণ ধারা আছে, যেগুলো মেনে চলা হলে জমির মূল মালিকরা ন্যায়বিচার পেতেন। ৩ নম্বর ধারার একটি অংশে বলা হয়েছে 'উক্ত করপোরেশন অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির রূপ পরিবর্তন করবে না' এবং ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, 'যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না, উল্লিখিত করপোরেশন প্রাদেশিক সরকারের কাছে জমিটি তার মুক্তি এবং পুনরুদ্ধারের জন্য সমর্পণ করবে... এবং করপোরেশন মুক্তি এবং পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সমস্ত খরচ এবং ক্ষতিপূরণ বহন করবে।'

২০০৪ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মত এই ধারা লঙ্ঘন করে। সেসময় কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা বিভিন্ন স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের কাছে এই জমি ইজারা দিতে থাকে। পরবর্তী ৩ বছর কারখানা বন্ধ ছিল এবং সেসময় এই প্রভাবশালী মহল আবারো জমি চড়া দামে কৃষকদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। এ ঘটনা নিয়ে ২০১৯ এ দ্য ডেইলি স্টারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সাঁওতাল নেতারা আরও অভিযোগ করেন, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বড় ধরনের লোকসানের পরও চিনিকলের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সেসময় প্রতিবছর ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা গচ্চা দিলেও, শুধুমাত্র সাঁওতালরা যাতে তাদের পৈত্রিক জমিতে ফিরে আসতে না পারেন, সেজন্য চিনিকল বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেন তারা।

যেহেতু অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তির 'রূপ' পরিবর্তিত হয়েছে এবং যেহেতু আগে এটি 'পূর্বোক্ত কারণে' (চিনিকল পরিচালনা) ব্যবহৃত হয়নি এবং যেহেতু এর ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্যও পুরোপুরি ভিন্ন হবে, এখনই উপযুক্ত সময় এই জমির 'মুক্তি এবং পুনরুদ্ধারের' বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখার। এটি খুবই লজ্জার বিষয় যে, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র সাঁওতাল ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষকে পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া তো দূরের কথা, তাদেরকে উৎখাত করে আরও নিঃস্ব করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে প্রস্তাবিত ইপিজেড প্রকল্পের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের মনে দুঃখ দুর্দশার বিষয়টি একেবারেই দাগ কাটতে পারেনি। গত ২৪ আগস্ট বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম খামার এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন এবং গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সেই বৈঠকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাউকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

বৈঠকে নতুন ইপিজেডে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আবারও আশ্বাস দেওয়া হয়। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে কতজন এই ভাগ্যবান ২ লাখের মধ্যে থাকবেন? এ ক্ষেত্রে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যের সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের পূর্বপুরুষদেরও নিয়োগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পরবর্তীতে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছিল, যা তাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে।

এ মাসের শুরুর দিকে সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাসকে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কৃষি জমিতে কায়িক শ্রমের অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবের কারণে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের ইপিজেডে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

এই প্রকল্পের ব্যাপ্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ইপিজেডের জন্য ১ হাজার ৮৩২ একর ভূমির সম্পূর্ণ অংশ অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় ইপিজেডটি তৈরি করা হয়েছে ৫০০ একর জমির ওপর। কেন এত জমি প্রয়োজন এবং সেখানে কী কী শিল্পের কলকারখানা স্থাপন করা হবে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। শুধু জানা গেছে, শুরুতে ছোট জায়গায় ইপিজেড তৈরি করা হবে এবং ভবিষ্যতে এর সম্প্রসারণ হবে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত নিজেদেরকে প্রশ্ন করা, এতগুলো প্রান্তিক পরিবারের জীবন-জীবিকার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে তাদেরকে গৃহহীন ও ভূমিহীন করার জন্য কি যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজ করছেন?

সন্দেহাতীতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইপিজেড তৈরির কারণে অত্যাবশ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে এবং আগে দরিদ্র ছিল এমন অঞ্চলের উন্নয়ন হয়েছে। তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কোনো উপকার না হলে এই উন্নয়ন কার জন্য? বিশেষ করে যদি সেই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক একটি নৃ-গোষ্ঠীর অংশ হয়ে থাকেন, যারা কেবল দেশের সবচেয়ে দরিদ্র একটি অঞ্চলের বাসিন্দাই নন, একইসঙ্গে ভূমিহীন ও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত কর্মী। যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে এবং সবচেয়ে দরিদ্ররা উন্নয়নের ফাঁক গলে বিস্মৃত হতে থাকেন তাহলে এমন উন্নয়নের উদ্দেশ্য কী?

সুপ্রভা তাসনীম: দ্য ডেইলি স্টারের এডিটোরিয়াল টিমের সদস্য

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

The deadline for completion of the Rooppur Nuclear Power Plant project has been extended to 2027, and a unit of the plant will be commissioned this December if transmission lines are ready.

1h ago