মেয়াদ শেষের দিকে জাবি উপাচার্যও নিয়োগে তৎপর!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আর নয় মাস বাকি। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নিয়োগ দিতে তৎপরতা শুরু করেছেন। গত চার মাসে একে একে ৪৭টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন।
অনলাইনে আয়োজন করেছেন শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা। ফলে ক্যাম্পাসে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগ উঠেছে, ‘পছন্দের প্রার্থী’কে নিয়োগ দিতেই উপাচার্যের এমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, নির্দিষ্ট বয়সসীমা নির্ধারণ না করেই ১০টি পদের আটটিতে কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।
জাবি প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তিন ধাপে বিভিন্ন বিভাগে মোট ৩৭ জন শিক্ষক এবং ১০ জন প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধের মধ্যেও বিভিন্ন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়। যেখানে আবেদনকারীদের জন্য অত্যন্ত কম সময় বেঁধে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে ১০টি বিভাগে ৩৭ জন শিক্ষকের নিয়োগের কথা বলা হয়। দর্শন এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ছয় জন করে এবং রসায়ন বিভাগে পাঁচটি স্থায়ী পদে প্রভাষক নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করা হয়।
এদিকে, বিভাগের ‘রীতি লঙ্ঘন’ করে প্রয়োজনের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন দর্শন বিভাগের আট জন শিক্ষক। চিঠিতে তারা এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তবে, ‘টিচিংলোড’ বিবেচনায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সশরীরে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে মত দেন তারা।
এ বিষয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের মুখপাত্র অধ্যাপক রাইহান রাইন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের যেখানে শ্রেণিকক্ষে ডেমনস্ট্রেশনের (নমুনা ক্লাস) নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে কীভাবে অনলাইনে “ভালো শিক্ষক” পাওয়া যেতে পারে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিভাগে একবারে এত বেশি শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। কারণ, এখনো অনেক শিক্ষকের কোনো কোর্স নেই, আবার কোনো কোনো শিক্ষকের সব বর্ষ মিলে মাত্র একটি বা দুটি কোর্স আছে। উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানের মেয়াদও শেষ হতে চলেছে। তাই হয়তো পছন্দের প্রার্থী নিতে তাড়াহুড়ো করছেন।’
দর্শন বিভাগে ছয় পদের বিপরীতে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেবেন প্রায় ৬০ জন প্রার্থী। আগামী শনিবার অনলাইনে তাদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। একদিনে সবার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে কতটুকু মেধা যাচাই করা সম্ভব হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিভাগের শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোস্তফা নাজমুল মানসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রক্রিয়ায় কোনো রীতি লঙ্ঘিত হয়নি। বিভাগীয় শিক্ষকদের মিটিংয়ের রেজ্যুলেশনও আছে। আমাদের বিভাগ ভীষণ শিক্ষক সংকটে আছে। গত ১০ বছরে কোনো নিয়োগ হয়নি। তার ওপর পাঁচ জন শিক্ষক অবসরে গেছেন এবং চার জন শিক্ষাছুটিতে আছেন। এ অবস্থায় একাধিক বর্ষে কোর্স শিক্ষক দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
অনলাইনে একদিনে মৌখিক পরীক্ষায় কীভাবে মূল্যায়ন হবে? এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিভাগের সভাপতি হিসেবে আমি নিয়োগ কমিটির সদস্যমাত্র। মূল কাজ করে রেজিস্ট্রার অফিস। হয়তো একদিনে না হলে সময় বাড়তে পারে। আমাদের আশু নতুন শিক্ষক প্রয়োজন।’
করোনাকালেই এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং (আইআরএস), আইন ও বিচার বিভাগ, আইআইটি, অর্থনীতি বিভাগে অনলাইনে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়।
জাবিতে অনলাইনে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার বিষয়ে অবগত নন দাবি করে ইউজিসি সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের কাছে শিক্ষক নিয়োগের কোনো চাহিদাই আসেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইনে শিক্ষক নিয়োগ কোনোভাবেই হতে পারে না। বোর্ডে একজন প্রার্থীকে সামনাসামনি দেখতে হয়, তার সার্টিফিকেট দেখতে হয়। অনলাইনে কীভাবে সম্ভব? আমরা কেবল বলেছি— অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে। তাও অনেক নীতিমালা উল্লেখ করেছি। সেগুলো রেকর্ড করতে বলা হয়েছে।’
প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগে নেই বয়সসীমা
উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে একসঙ্গে আট জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও দুই জন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। গত ২ মে পত্রিকায় এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। যদিও উপাচার্যের প্রথম মেয়াদে অ্যাডহক ভিত্তিতে কিছু নিয়োগ হয়েছিল।
এবার উপাচার্য অফিসে একজন, সিইটিএল অফিসে একজন, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অফিসে একজন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে একজন, আইআইটি বিভাগের অফিসে একজন, গ্রন্থাগার অফিসে একজন, অভ্যন্তরীণ অডিট অফিসে একজন ও জনসংযোগ অফিসে একজন করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাবেন দুই জন।
নিরাপত্তা কর্মকর্তা পদে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ বছর। তবে, বাকি আট পদে কোনো বয়সসীমা উল্লেখ করা হয়নি।
প্রশাসনিক অফিস সূত্রে জানা যায়, ১০ পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ১২ শতাধিক। কোনো কোনো অফিসের একটি পদের বিপরীতে দুই শতাধিক আবেদনও জমা পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়োগের চেষ্টা করছে। উপাচার্য প্রথম মেয়াদে কিছু অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিলেও এবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দিতে চাইছেন। ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা এবং নেতাদের স্ত্রী, শিক্ষকদের স্ত্রী ও সাংবাদিকরা তালিকায় রয়েছেন বলে শুনেছি।’
নিয়োগ দিতে বিভিন্ন অফিস থেকে ইচ্ছেমতো পদ সৃষ্টির অভিযোগও উঠেছে এবার।
নিয়োগের বিষয়ে আইআইটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমাদের ইনস্টিটিউটের জন্য দরকার প্রোগ্রামার। যেহেতু কাজগুলো টেকনিক্যাল। এই নিয়োগ চেয়ে বিজ্ঞপ্তির চাহিদা দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের কাছে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের অর্গানোগ্রাম হচ্ছে দাবি করে তখন নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এখন দেখছি আইআইটির জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে সংক্ষিপ্ত নোটিশে প্রশাসনিক মিটিংয়ে ডাকা হয়। মিটিংয়ে আমাদের শুধু জানানো হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। যদিও আমি বলার চেষ্টা করেছি যে, আমাদের প্রোগ্রামার লাগবে।’
এসব নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিভিন্ন বিভাগের খালি পদের বিপরীতেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আর প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের নীতিমালায় কোনো নির্ধারিত বয়সসীমা উল্লেখ নেই। আবেদন বাছাইপর্বে বোঝা যাবে কোন বয়সের প্রার্থী আবেদন করেছেন।’
তবে, বয়সসীমার বিষয়ে ইউজিসি সদস্য ড. দিল আফরোজা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সরকারি চাকরির বয়সসীমা মানতে হবে। নীতিমালায় এ বিষয়ে উল্লেখ থাকতে হবে। শুধু অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা যদি আবেদন করেন, সেক্ষেত্রে বয়সের বিষয়টা বিবেচনা করা যাবে। আমরা শিগগির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নীতিমালা নিয়েও কাজ করব।’
বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য অধ্যাপক সোহেল আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি ও স্থায়ীকরণের সব বোর্ড ভার্চুয়ালি চলছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে অদ্যাবধি একটি ইনস্টিটিউট ও দুটি বিভাগে শূন্য প্রভাষক পদে অত্যন্ত মেধাবী ও মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ এই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেই সম্পন্ন হয়েছে। এই সময়োপযোগী পদ্ধতি চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট মোকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর।’
শেষ সময়ে ‘নিয়োগ তৎপরতা’ নিয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চলে যাচ্ছে বলে নয় মাস আগে থেকেই কাজ করতে পারবে না? তাহলে তো এক বছরই কাজ করতে পারবে না। করোনার জন্য তো সব স্লো করা হয়েছে। সুতরাং যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোবহান সাহেবের সঙ্গে তুলনা করে, তারা গর্হিত অন্যায় কাজ করছে। কারণ, তিনি তো অ্যাডহকে নিয়োগ দিয়েছেন মেয়াদ শেষের একদিন আগে। একদিন আগে আর নয় মাস আগে এক কথা হতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুবই নিয়মতান্ত্রিক ও চাহিদার আলোকে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির সম্মতি সাপেক্ষেই এসব বিভাগগুলোতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো কোনো বিভাগে ১০-১২ বছর ধরে নিয়োগ হচ্ছে না। কিছু শিক্ষক মারা গেছেন, কিছু চাকরি ছেড়ে গেছেন, অবসরে গেছেন, উনাদের পদের বিপরীতেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।’
অনলাইনে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নিয়োগ পেয়ে থাকে। যারা আগে থেকেই পরিচিত। তারপরও কেউ তথ্য গোপন করলে তার চাকরি চলেও যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ থেকে বাইরের দেশে কেউ চাকরি নিলেও তাকে অনলাইনেই পরীক্ষা দিতে হয়।’
Comments