‘পাখিটা কি আমার ওপর রাগ করল?’

অধ্যাপক ফকরুল আলম ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক পরিচয়ের বাইরেও একজন প্রথিতযশা অনুবাদক। বাংলা সাহিত্যকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে তিনি কাজ করছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজৈবনিক বইগুলো অনুবাদ করে শুধু খ্যাতিই অর্জন করেননি, সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও সংগ্রামকে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষকে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ছবি: সংগৃহীত

অধ্যাপক ফকরুল আলম ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক পরিচয়ের বাইরেও একজন প্রথিতযশা অনুবাদক। বাংলা সাহিত্যকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিতে তিনি কাজ করছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজৈবনিক বইগুলো অনুবাদ করে শুধু খ্যাতিই অর্জন করেননি, সঙ্গে আমাদের ইতিহাস ও সংগ্রামকে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষকে জানার সুযোগ করে দিয়েছেন।

অধ্যাপক ফকরুল আলম 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি'র পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন গত বছর।

অধ্যাপক ফকরুল আলম। ছবি: সংগৃহীত

শোকের মাস আগস্টে দেশের এই খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, গবেষক ও অনুবাদকের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি'র আপনি প্রথম পরিচালক। যুক্ত হয়েছেন প্রায় এক বছর। কী করছেন? পরিকল্পনা কী?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: খুব বেশি কাজ করতে পারিনি। নতুন প্রতিষ্ঠান, লোকবল কম। বেশ কিছু কাজ করার পরিকল্পনা আছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটির সঙ্গে যৌথভাবে অনলাইনে দুটি সেমিনার করেছি। একটি 'বঙ্গবন্ধু লেকচার সিরিজ' শিরোনামে। এতে একক বক্তৃতা করেছেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। অন্যটিতে মুজিব ও নিউ ডিরেকশন অ্যান্ড রিসার্চ নিয়ে যৌথ বক্তৃতা করেন অধ্যাপক মাহবুবা নাসরিন ও খন্দকার মোকাম্মেল।

মীর মশাররফ, রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের লেখা অনুবাদ করে আপনি পাঠকের আস্থা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অনুবাদ করার আগ্রহ বা শুরুটা কিভাবে হলো?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: আসলে আগ্রহটা আয়োজন করে হয়নি। তবে এটা আমার জন্য আনন্দের বিষয় ছিল। অনুবাদের প্রস্তাবটি আসে আমার বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহর মাধ্যমে। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয় ২০০৫ সালের শেষ দিকে, আলাপ-আলোচনা হয়। তখন তিনি বিরোধীদলের নেত্রী, সুধা সদনে থাকেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও কম্পোজের কাজ হয়। এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও যুক্ত ছিলেন শামসুজ্জামান খান ভাই ও বেবী মওদুদ আপা। তবে অনুবাদ করার পর তারা আবার বাংলার সঙ্গে যত্ন সহকারে মিলিয়ে দেখতেন। সব মিলিয়ে পুরো কাজটিতে বেশ আনন্দ পেয়েছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার কোনো স্মৃতি আছে?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: শেখ কামাল আমার বন্ধু ও সহপাঠী ছিল। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে কামালই আমাদের কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আর আমাদের পারিবারিক আলোচনা সবসময় ছিল।

তার সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ কী আপনার কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: শেখ সাহেব, উনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ছয় দফা আমার মানসে একটা প্রভাব ফেলেছে। তবে এসব বিষয় অনুবাদ করতে অনুপ্রাণিত করেছে তা সরাসরি বলা যায় না।

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' কোনো সাধারণ বই না। অসাধারণ বইটি অনুবাদে আপনার কী ধরনের অনুভূতি হয়েছে?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: প্রথম কথা হচ্ছে, বই একবারে অনুবাদ করিনি। তারা বাংলা পাণ্ডুলিপিটি থেকে কম্পোজ করে প্রিন্ট দিয়ে ৩০ পাতা করে আমাকে পাঠাতেন। সেগুলো অনুবাদ হলে পরবর্তী কিস্তি। এভাবে কাজ হয়েছে। এর প্রতিটি পাতায় মানস বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি, যে মানুষটি গল্প শুনতে এবং বলতে ভালোবাসেন। এ ব্যাপারটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রায় দেখা যায় বজ্রকন্ঠের বঙ্গবন্ধু বন্ধু সুলভ সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন। জনতার সুখ-দুঃখ-আশা বুঝতে পারেন। একজন রাজনীতিবিদের বাইরেও অসামান্য ব্যক্তিত্ব, একজন পুত্র, একজন স্বামী, একজন পিতা, মনোগ্রাহী কথক ও মুক্তমনের মানুষ দেখতে পারি। আর এসব আমার অনুবাদকে সহজতর করে তুলছে।

জাতির জনকের ব্যক্তি জীবন ও রাজনৈতিক জীবনের মেজাজে কতটা পার্থক্য পেয়েছেন? প্রান্তিক মানুষ কতটা মিশে আছে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: না কোনো পার্থক্য নেই। কারণ তিনি যা ভাবতেন, তাই লিখতেন এবং বলতেন। কোনো ভণিতা, কোনো অহং ছিল না। এই বিষয়গুলো 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে যেমন আছে, তেমনি আছে 'কারাগারের রোজনামচা' ও 'আমার দেখা নয়া চীনেও'। কোথাও কোনো ভিন্নতা নেই, ব্যতিক্রম কোনো মেজাজ নেই। তাছাড়া এগুলো রচিত হয়েছিল কারাগারে। ফলে এখানে তার ব্যক্তিগত দুঃখ-অনুভূতি-হতাশা-ব্যর্থতা-দায়-অনুভবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

পরিবার, বন্ধুবান্ধব, রাষ্ট্রের সংকট ও অগ্রজ রাজনৈতিক নেতা সোহরাওয়ার্দীসহ বড় বড় নেতাদের সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। তার বয়ানে চারপাশের বর্ণনা ও প্রান্তিক মানুষের চিত্র সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে।

'কারাগারের রোজনামচা'য় তেমনি একটি চিত্র— জেলখানায় মুরগি, পাখি ও গাছ নিয়ে তার অসামান্য অনুভূতির প্রকাশ পায়।

অধ্যাপক ফকরুল আলম: অসাধারণ একটি কথা মনে করিয়ে দিলেন। যেমন তিনি লিখছেন, 'পাখিটা কি আমার ওপর রাগ করল? না হলে কেন আসে না?' পাখির জন্য তার যে অপেক্ষা। এ দৃশ্য কল্পনা করলেও রোমাঞ্চকর। একবার জেলে একজনের সঙ্গে দেখা, যিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে চুরি করেছিলেন। তিনি তো বঙ্গবন্ধুকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু চিনতে পেরে তাকে অভয় দিলেন ও তার থাকা-খাওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিলেন।

অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্র অবস্থায়। এইভাবে সবসময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানুষের পাশে। তিনি মানুষ ছাড়াও পশু-পাখি-প্রকৃতি পছন্দ করতেন। জেলখানায় নিজে রান্না করে অন্যদের খাওয়াতেন, খোঁজ-খবর নিতেন। সহজে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারতেন। এখানে তিনি রাজনীতিবিদ না, সাধারণ মানুষের মুজিব হিসেবে মন জয় করেছিলেন।

আপনি একবার বলছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণনায় এ বিষয়টি পরিষ্কার যে তিনি যেভাবে পাকিস্তানকে দেখতে চেয়েছিলেন সেই পাকিস্তান হয়নি। এর বিস্তারিত যদি বলতেন।

অধ্যাপক ফকরুল আলম: খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। লাহোর প্রস্তাবের দিকে তাকান, অটোনমাস ইউনিট, ভৌগোলিক ভাগের ভিত্তিতে পলিটিক্স, স্বায়ত্তশাসন— এসব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।

এ ছাড়াও দেশভাগের আগে আসাম, মেঘালয় নিয়ে যে পাকিস্তানের স্বপ্ন কল্পনা করেছিলেন, তা রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে স্বপ্ন-মোহ ভেঙে গেছে। তিনি বারবার সে বিষয়ে কথা বলতেন। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর দেখলেন যে সরকার এই অঞ্চলের মানুষের কথা ভাবছে না। এককেন্দ্রিক চিন্তা করে সাধারণ মানুষের ওপর অবিচার হচ্ছে। উন্নয়নের কথা নেই।

তিনি তার রাজনীতির গুরু সোহরাওয়ার্দীসহ সারাক্ষণ গণতান্ত্রিক ভাবনায় ছিলেন। আর রাজনৈতিক জটিলতায় তা দৃশ্যমান না হওয়ায় সংকটের দিকটি তুলে ধরেছেন।

ইতিহাসের অনেক বই রয়েছে। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বইগুলো কতটা আলাদা?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: সাধারণত ইতিহাসের সংজ্ঞা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বইকে দেখলে হবে না। পৃথিবীতে ইতিহাসের সংজ্ঞা বা কনসেপ্ট অনেক পাল্টে গেছে। ওরাল ন্যারেটিভ বা হিস্ট্রি, চিঠি বা মুখের বর্ণনাও ইতিহাসের অংশ। এসব থেকে ইতিহাস লিখিত হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' যেমন জেলখানায় বসে লেখা, তেমনি ইংরেজি সাহিত্যের আদি উপন্যাস জন বানিয়ানের 'পিলগ্রিমস প্রগ্রেস'ও রচিত হয়েছে জেলের মধ্যে। জওহরলাল নেহরু জেলখানায়ও বসে যা লিখেছেন, এখনও সেগুলো সাহিত্য হিসেবে পড়ানো হয় অনেক জায়গায়।

একটা বিষয় আমাদের মনে রাখা জরুরি, যে মানুষটি রাষ্ট্রের কথা ভেবেছেন, সংগ্রাম করেছেন, সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, মূল্যবোধের প্রতিনিধি, শ্রেণি মানুষের প্রতিনিধি হয়ে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় ভেবেছেন, দেখেছেন তাই লিখেছেন, বর্ণনা দিয়েছেন। মানুষ হিসেবেও যিনি ইতিহাসের অংশ, তিনি যা রচনা করেন সেটি অবশ্য অসামান্য দলিল। ইতিহাসের আকর গ্রন্থ।

আপনি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করছেন। অনুবাদ, গবেষণা, সম্পাদনার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে থাকছেন আলোচক হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নিজের বই ছাড়া, বঙ্গবন্ধুকে স্বচ্ছ ও সঠিকভাবে জানার জন্য কোন বইগুলোর নাম বলবেন?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: বলার মতো বই চোখে পড়ে না। তবে বিশিষ্ট সাংবাদিক-কলামিস্ট সৈয়দ বদরুল আহসান ভাইয়ের গত বছর একটা বই বের হয়েছে। নাম From Rebel To Founding Father: Sheikh Mujibur Rahman। প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ। দারুণ একটা কাজ হয়েছে। এতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

যেকোনো অনুবাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে লেখক ও মূল বইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকে তা খেয়াল করেন না। সে বিষয়ে অনুবাদে আগ্রহীদের জন্য কোনো পরামর্শ?

অধ্যাপক ফকরুল আলম: আমি প্রায়ই বলি অনুবাদ করার জন্য নিবিড় পাঠ জরুরি। চিন্তা ও চরিত্রের প্রবাহ ধরতে বইয়ের ভেতর ঢুকতে হবে, চরিত্র ও মূল কন্টেন্টের মেজাজ আবিষ্কার করতে হবে। যাকে বলে ক্লোজ রিডিং। এতে প্রত্যেক লাইন স্বর, বাক্য গঠন, দাড়ি, কমা এসবে নজর দিতে হবে। নিখুঁত ভাবনাগুলো ধরতে হবে। যেমন: আমার নিবিড় পাঠে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর ধরতে চেয়েছি, বুঝতে চেয়েছি তার বলার ভঙ্গি। মুগ্ধ করেছে বঙ্গবন্ধুর মানসপট।

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

5h ago