মুক্তিযুদ্ধ

৪ আগস্ট ১৯৭১: যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বাঙালি কূটনীতিকের একযোগে পদত্যাগ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৪ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের উপ-প্রধান প্রতিনিধি সৈয়দ আনোয়ারুল করীমের নেতৃত্বে জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশন ও ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসে নিযুক্ত ১৪ বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মচারী একযোগে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ্য করেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৪ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের উপ-প্রধান প্রতিনিধি সৈয়দ আনোয়ারুল করীমের নেতৃত্বে জাতিসংঘের পাকিস্তান মিশন ও ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসে নিযুক্ত ১৪ বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মচারী একযোগে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ্য করেন।

পদত্যাগকারীদের ১৪ জনের মধ্যে ৭ জনই ছিলেন জাতিসংঘ ও ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের কূটনীতিবিদ। পদত্যাগকারীদের মধ্যে ছিলেন ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের উপ-প্রধান এনায়েত করিম, পাকিস্তান দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর শাহ এ এম এস কিবরিয়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক শাখার কাউন্সিলর আবু রুশদ মতিন উদ্দিন, হিসাব বিভাগের প্রধান ও দ্বিতীয় সচিব আতাউর রহমান চৌধুরী, রাজনৈতিক শাখার তৃতীয় সচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, সহকারী প্রশাসনিক অ্যাটাচি এ এম শরফুল আলম, সহকারী প্রেস অ্যাটাচি শেখ রুস্তম আলী ও আবদুর রাজ্জাক খান প্রমুখ।

পদত্যাগের পর এই ৭ বাঙালি কূটনীতিবিদ মার্কিন সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং 'বাংলাদেশ মিশন ওয়াশিংটন' নামে একটি সংহতি গ্রুপ তৈরি করেন। এর আগে ৩১ জুলাই ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন বাঙালি কূটনীতিবিদ আবুল মাল আবদুল মুহিত।

ঢাকায় এদিন

৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৬২ নং সামরিক আদেশ জারি করে। এই আদেশের ফলে নতুন করে ৬ নং সামরিক সেক্টর গঠন করা হয়।

দেশব্যাপী এদিন

সম্প্রতি ইরানের একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের 'হিন্দুদের ভোটেই নির্বাচনে জিতেছেন শেখ মুজিব', বক্তব্যকে চরম মিথ্যাচার ও গণহত্যাকে চাপা দেয়ার চেষ্টা বলে অবহিত করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র। মুজিবনগরে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই মুখপাত্র আরও বলেন বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশের বেশি নয়, অথচ আওয়ামী লীগ ৮২ শতাংশ ভোট পেয়েছে।

৪ আগস্ট গাইবান্ধায় খন্দকার আজিজুর রহমান ও রইসউদ্দীনকে আহ্বায়ক ও সম্পাদক করে ১৩ সদস্যের শান্তিকমিটি পুনরায় গঠন করা হয়।

ভারতে এদিন

৪ আগস্ট দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শরণার্থী সমস্যা, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ও ভারতের অবস্থান নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক করেন মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুল রহমান।

এসময় ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য পূর্ব বাংলায় নিরাপদ ও উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জোর দেন। তিনি বলেন, 'শরণার্থীদের আমরা এই অবস্থায় পাঠাতে পারি না। কারণ সেখানে এখনও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। গণহত্যা ও নিপীড়ন সেখানে এখনও চলমান। আগে সেখানে তাদের নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।'

৪ আগস্ট দিল্লিতে লোকসভায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য নিয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন 'পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকবেন কিনা সন্দেহ।' ইয়াহিয়া খানের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লোকসভার সদস্যরা অতিসত্বর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রামকে বক্তব্য দেয়ার আহ্বান জানান।

এদিন লোকসভায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের এই হটকারিতামূলক বক্তব্যে গভীর উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।'

৪ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে কলকাতায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারত সফররত পশ্চিম জার্মানির প্রতিনিধি ড. হেরমান সিমটভকেন হাউজেন সাংবাদিকদের বলেন, 'পূর্ব বাংলার বিষয়ে জাতিসংঘের এখনই হস্তক্ষেপ করা উচিত। শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে আমরা টের পেয়েছি পূর্ব বাংলার অবস্থা কতোটা শোচনীয়। সেখানে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিরাপত্তাও নেই।

পাকিস্তানে এদিন

৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। জাতীয় পরিষদে যেসব পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যের আসন বহাল থাকবে এবং অপরাধ অথবা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য যারা আসন হারিয়েছেন, খুব শিগগির তাদের নাম ঘোষণা করা হবে। একমাত্র সীমান্ত এলাকা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটেছে। পূর্ব-পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। আমরা বাধ্য হয়েই কড়া পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে বলে যে মিথ্যাচার রটানো হয়েছে তা জঘন্য মিথ্যাচার। মূলত নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র সংখ্যক সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ায় তাদের উৎখাত করতে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর বহু জায়গায় বিদ্রোহী ও দেশদ্রোহীদের দমন করতে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সহায়তা বন্ধ করে তবে উপমহাদেশে শরণার্থী সমস্যা আরো প্রকট হবে। আগের দিন মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ জারি করে একটি বিল পাস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই কথা বলেন। তিনি একই সঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই পাকিস্তানের উপর সরাসরি চাপ প্রয়োগ করবে না। বরং তাদেরকে সমঝোতার পক্ষে আনার চেষ্টা করবে। একই সঙ্গে উল্লেখ্য যে কংগ্রেসে পাস হওয়া এই বিলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ করার ও বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৪ আগস্ট সিলেটের কালচেরা টি এস্টেটের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় ৫০ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা ২ সৈন্যকে আটক করে। একই সঙ্গে এই ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ১টি মেশিনগান, ১টি এলএমজি, ৬টি রাইফেল, ১৮ হাজার কার্তুজ ও বিপুল পরিমাণ মজুতকৃত খাদ্যদ্রব্য নিজেদের দখলে নেয়।

৪ আগস্ট সিলেটে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বড়লেখা-বিয়ানীবাজার সড়কপথে চানগ্রাম বাজারের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি টহলদার দলকে অ্যামবুশ করে। এসময় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ৭ হানাদার সেনা পালিয়ে গেলেও হানাদার বাহিনীর ল্যান্স নায়েক মামুন আনসারী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে।

৪ আগস্ট কুমিল্লার কোটেশ্বরে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি ঘাঁটির উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় ৩ ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে ৫ হানাদার সেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়।

৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের একটি ক্যাম্পে মর্টার হামলা চালায়। এসময় ২০ হানাদার সেনা ও ৭ রাজাকার নিহত হয়।

এদিন কুমিল্লার বুড়িচংয়ের গোমতী নদীর হরিমঙ্গল ব্রিজের পাশে মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৩ হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এদিন বিকেলে চান্দিনার শ্রীমন্তপুরে মুক্তিবাহিনীর হামলায় ২ হানাদার সেনা নিহত হয়।

৪ আগস্ট শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিখ্যাত তন্মর যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ, আনার আলী, কলিমউদ্দিন, জামাল, লালমিয়া মাঝি, জমিরুদ্দিন, জবান আলী ফকির শহীদ হন।

৪ আগস্ট ফেনী নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের করেরহাটে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৩৭ হানাদার সৈন্যসহ ৫০ রাজাকার নিহত হয়।

৪ আগস্ট খুলনার তেরখাদায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৫৭ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে পুকুরপাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।

এদিন আগস্ট কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গত কয়েকদিনে কুমিল্লার প্রায় ২৫টি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে ক্রমাগত হামলার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

৪ আগস্ট কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পালটি গ্রামে রাজাকাদের গুলিতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৪ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সিংগেরঝিল এলাকায় মুক্তিবাহিনী ১২ হানাদার সৈন্যকে খুন করে ১২টি রাইফেল উদ্ধার করে।

৪ আগস্ট কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নদীপথে তাহেরপুরের দিকে অগ্রসর হলে হাবিলদার শফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে। এসময় দুই বাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে ১৮ হানাদার সেনা নিহত হয়। ঠিক একই সময় কুমিল্লার বরুড়ার ব্রজপুরে মুক্তিবাহিনীর কুমিল্লা উত্তর সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের মর্টার হামলায় ৭ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, চতুর্থ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ৫ আগস্ট, ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৫ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ আগস্ট ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

4h ago