মহামারির মধ্যেও রেল কর্তাদের বিদেশ সফরের ধুম

করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা আগামী ৩ মাসে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে ৪টি সফরে যাবেন।

করোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা আগামী ৩ মাসে ইউরোপ, আমেরিকা ও ভারতে ৪টি সফরে যাবেন।

তাদের ভাষ্য, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানার্জন, প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও কারখানা পরিদর্শনের জন্য এসব সফরের আয়োজন করা হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে সরকার বিদেশ ভ্রমণের জন্য বরাদ্দের ৫০ শতাংশ অর্থ আটকে দিয়েছে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের রুটিন সফরগুলোও বাতিল করতে বলেছে। তা সত্ত্বেও রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসব সফরে যাচ্ছেন।

গত ১ জুলাই জারি করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, কেবল জরুরি ও অনিবার্য পরিস্থিতিতে বিদেশ ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।

আগামী মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে যাওয়া ইউরোপের ৪টি দেশে ১৩ দিনের সফরে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। আজ রোববার সন্ধ্যায় তারা ঢাকা ছাড়বেন।

মন্ত্রীর ভাষ্য, এসব সফরের পরিকল্পনা অনেক পুরনো, যা বিভিন্ন কারণে প্রয়োজন।

এ সংক্রান্ত নথি থেকে জানা যায়, মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সফরের ব্যয় বহন করা হবে সরকারি কোষাগার থেকে। বাকী ৩টি সফরের ব্যয় নির্বাহ করবেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ২টি প্রকল্পের ঠিকাদাররা।

অবশ্য সফরগুলোতে ঠিক কত টাকা খরচ হতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।

মহামারির আগে কর্মকর্তারা দেশের করদাতাদের অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সভা ও সেমিনারে অংশ নিতে প্রতি বছর বিদেশ সফর করতেন।

কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো এমন কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে পাঠাতেন, যাদের আসলে ওই সংশ্লিষ্ট কিছুই করার থাকত না।

সরকারি কর্মকর্তাদের এমন ঘন ঘন বিদেশ সফর নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। কারণ সরকারি খরচে এমন অনেক সফরের ফলাফল থাকে শূন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এসব সফরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

চলমান করোনাভাইরাস মহামারি এই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। মহামারির জন্য অনেক সফর বাতিলের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে সরকারের প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বেঁচে গেছে।

বিশ্বব্যাপী মহামারিজনিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় রেলওয়ে কর্মকর্তারা আবার বিদেশ ভ্রমণের সেই চর্চা শুরু করেছেন।

রেলমন্ত্রীর সফর

গত ৩১ অক্টোবর জারি করা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আগামী ২৩ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্স সফরে রেলমন্ত্রী ও সচিবের স্ত্রীরা নিজস্ব খরচে তাদের ভ্রমণের সঙ্গী হবেন।

বিজ্ঞপ্তিতে দেশগুলো ভ্রমণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ কিংবা উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়নি। তবে রেলমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিনিধি দল সেখানকার উন্নত রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা দেখবে। পাশাপাশি রেলওয়েতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখানো বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলবেন তারা।

ইউরোপ যাত্রায় মন্ত্রীর সঙ্গী হতে যাচ্ছেন রেল সচিব সেলিম রেজা, অতিরিক্ত সচিব ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস, উপসচিব নাজমুল হক, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কামরুল আহসান ও মঞ্জুর উল আলম চৌধুরী, মন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ও সহকারী একান্ত সচিব রাশেদ প্রধান।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রী হওয়ার পর ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন নুরুল ইসলাম সুজন।

ভারত ও চীন বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এ ছাড়া রেলওয়ের অনেক প্রকল্পে ভারত ও চীনের বেশ কিছু কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা আছে। পদ্মাসেতুর রেল সংযোগ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পে কাজ করছেন চীনের ঠিকাদাররা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রোগ্রেস রেল ৪০টি নতুন ব্রডগেজ লোকোমোটিভের সরবরাহকারী। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার পিটি ইন্ডাস্ট্রি কেরেটা এপি ২০০ মিটারগেজ কোচ সরবরাহ করেছে।

বর্তমানে রেলওয়ের ৩৭টি প্রকল্প চলমান আছে। তবে ইউরোপের যে ৪টি দেশে প্রতিনিধি দল সফরে যাচ্ছে তার কোনোটিই এসব প্রকল্পে কোনো ধরনের বিনিয়োগ করছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ৭টি প্রকল্পের আওতায় সরঞ্জামাদি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কোনোটিই এসব দেশের নয়।

৩১ অক্টোবরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, রেলমন্ত্রীর সফরের খরচ মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের বাজেট থেকে বহন করা হবে।

২ অতিরিক্ত মহাপরিচালকের ভ্রমণ ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় বাকিদের খরচ বহন করবে।

রেলমন্ত্রী সুজন জানান, ইউরোপের দেশগুলোতে উন্নত রেল নেটওয়ার্ক আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও কোম্পানি বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। গতকাল শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহায়তা নিতে পারি সে ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কথা বলব। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন কোম্পানির কারখানাগুলোও পরিদর্শন করব।'

এই কাজগুলোকে জরুরি মনে করা যেতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দেননি তিনি।

মন্ত্রী বলেন, 'আমরা আমাদের রেলওয়েকে উন্নত করতে চাই। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোভিডের কারণে দেড় বছর পার হয়ে গেছে। তারা (বিদেশি সংস্থা ও কোম্পানি) এখানে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখন যদি আমরা না যাই, তাহলে কখন যাবো?'

মন্ত্রীর ইউরোপ সফর নিয়ে আজ রোববার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল মন্ত্রণালয়। তবে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সফর থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে সফরের বিস্তারিত জানানো হবে।

কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী মাসে মন্ত্রী রাশিয়া সফরেও যাবেন।

অন্যান্য সফর

গত বৃহস্পতিবার রেল মন্ত্রণালয় বিদেশ ভ্রমণের ৩টি আদেশ জারি করেছে।

আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩ কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের ১ প্রশাসনিক কর্মকর্তা আগামী ১ থেকে ৭ ডিসেম্বর ভারত সফর করবেন।

ভারতের তামাকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ডিজি পিএসসি স্লিপার ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের খরচ বহন করবে।

এ ছাড়া আগামী বছরের ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি 'রোলিং স্টক অপারেশনস ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট অব বিআর' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় 'শিক্ষা সফর' এর জন্য ১০ সদস্যের আরেকটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকবে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ৫ জন কর্মকর্তার পাশাপাশি ওই সফরে পরিকল্পনা কমিশনের ২ কর্মকর্তা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২ কর্মকর্তা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ১ কর্মকর্তা থাকবেন।

এই খরচ বহন করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি প্রোগ্রেস রেল।

একই প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ রেলওয়ের আরও ১২ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে ৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। তারা সেখানে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত থাকবেন। এই সফরের খরচও বহন করবে প্রোগ্রেস রেল।

এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

নথি অনুসারে, গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর রেল কর্মকর্তারা ২ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
New School Curriculum: Implementation limps along

New School Curriculum: Implementation limps along

One and a half years after it was launched, implementation of the new curriculum at schools is still in a shambles as the authorities are yet to finalise a method of evaluating the students.

10h ago