ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি
চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর আদালতের (সিএমএম) দেওয়া এক সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মো. সাইফুল ইসলামকে ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে তাকে কিশোরগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়।
পরের দিন, মেট্রোপলিটন আদালতে কিশোরগঞ্জ থেকে পাঠানো সাইফুলের উপ নথি এসে পৌঁছালে আদালতের কর্মচারী নথিভুক্ত করতে গেল তার সন্দেহ হয়। আদালতের কোর্ট ডায়রি, প্রসেস বুক, রেজিস্টার বুক ও পিয়ন বই ঘেটে দেখা যায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি ভুয়া ছিল। গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় থাকা ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমের নামও ভুল ছিল। এ নামে কেউ আদালতে নেই।
পরে আদালতের কর্মকর্তারা সাইফুলকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একটি নোট পাঠান। ততক্ষণে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি কয়েকদিন জেলে কাটিয়েছেন।
চট্টগ্রামের আদালতে যে ভুয়া পরোয়ানার সিন্ডিকেটের কথা বলে হচ্ছে তার একমাত্র শিকার সাইফুলই নন। ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরি করে আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের স্বাক্ষর ও সিল জাল করে মানুষকে টার্গেট করে হয়রানির উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন থানায় পাঠানো হচ্ছে।
আদালতের কর্মকর্তারা এ এরকম ১৪টি ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা শনাক্ত করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন সময়ে আদালত থেকে পাঠানো হয়েছিল।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর, সিএমএম আদালতের নাজির আবুল কালাম আজাদ ১৫ অক্টোবর অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে কোতোয়ালি থানায় চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রবিউল আলমের অনুমতিক্রমে একটি মামলা দায়ের করেন।
তদন্তকারী ও আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অসাধু আইনজীবী, আদালতের কর্মচারী, পুলিশ এবং অ্যাডভোকেটদের কেরানিদের একটি এই ভুয়া পরোয়ানার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তদন্তকারীরা বলছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তৈরি করে এই চক্রটি।
তদন্তকারীদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো বেশিরভাগই ব্যক্তিগত বা সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব বা ব্যবসায়িক শত্রুতার ওপর করে পাঠানো হচ্ছে।
তাদের মতে, জাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো একেবারে আসলগুলোর মতোই। কারণ সরকারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ফর্মগুলোতেই এই ভুয়া পরোয়ানা দেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ঠ আদালতের সঙ্গে ভেরিফাই না করলে তা শনাক্ত করা অসম্ভব৷
বিভিন্ন সময়ে আদালত থেকে দেওয়া হয়েছিল এমন বেশ কয়েকটি ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।
বিভিন্ন অভিযোগে নথিভুক্ত মামলার (সরাসরি আদালতে দায়ের করা) গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় মামলা এবং মেমো নম্বরের পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের ঠিকানার সম্পূর্ণ বিবরণ ছিল।
এই প্রতিবেদক বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, ডাক রেজিস্টারের মাধ্যমে জাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো বিভিন্ন থানায় পাঠানো হয়। ভুয়া পরোয়ানা নিয়ে বিতর্কের পর থেকে তারা কেবল আদালত থেকে যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের কাছে আসে যে পরোয়ানা থানায় এসে পৌঁছে তারা শুধু তা তামিল করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির উত্তর জোনের একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, 'আপনি যদি আসলটির সঙ্গে তুলনা করেন তবে ভুয়াগুলো শনাক্ত করতে পারবেন না। এটি খুব বিভ্রান্তিকর। যে কারণে আমরা ডাকযোগে আসা কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা গ্রহণ করি না।'
সঠিক চ্যানেলের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'একটি পরোয়ানা দেওয়া হলে, এটি আদালতে সংশ্লিষ্ট ডেস্কের মধ্য দিয়ে পুলিশের ডেপুটি কমিশনারের কাছে আসে। পরোয়ানাটি তখন এন্ট্রি হয়ে আবার স্মারক নাম্বার দিয়ে আমাদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছায়।'
তবে কটিয়াদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাত হোসেন দাবি করেন, আদালতের যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে। 'আমাদের সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না কারণ এটি পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকেই এসেছিলো। এখন তাহলে প্রশ্ন কিভাবে এই ভুয়া পরোয়ানা চট্টগ্রামের আদালত সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে এখানে আসলো। "
এর আগে গত বছরের ১৪ অক্টোবর ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিক নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী আদালতের কর্মকর্তার নাম, পদবি, ফোন নম্বর এবং স্বাক্ষর উল্লেখ করতে হবে, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয়েছে তার সত্যতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তা যোগাযোগ করতে পারেন।
আরও বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য নিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুতকারী আদালতের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
আদালত সূত্র জানায়, আদালতের স্টাফ ও কোর্ট পুলিশ নির্দেশনা পালন করলেও কিছু মামলা জমে আছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির (সিডিবিএ) সাধারণ সম্পাদক আ হ ম জিয়া উদ্দিন বলেন, 'এই চক্রের সঙ্গে কিছু অসাধু আইনজীবী, আদালতের কর্মচারী ও পুলিশ জড়িত আছেন। সঠিক তদন্ত ছাড়া তাদের খুঁজে বের করা কঠিন।'
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, 'এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বারবার ঘটনা ঘটলেও অপরাধীরা নিরপরাধ মানুষকে জেলে পাঠিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।'
এই আইনজীবী বলেন, 'একটি ব্যাপক তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার জন্য দায়ী সিন্ডিকেটকে প্রকাশ করা যেতে পারে।'
তবে, এই চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করার জন্য আদালতের পক্ষ থেকে একাধিক নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও, পুলিশ এবং অন্যান্য তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার নেপথ্যে থাকা অপরাধীদের খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দিন বলেন, 'ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিষয়ে দায়ের করা মামলাটি গত মাসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমরা মামলাটি তদন্ত করছি।'
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন সুমন আলী
Comments