নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন এখন সময়ের দাবি

দুই বছর পরে জাতীয় নির্বাচন, এ সময় নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে সংবিধানে আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা থাকলেও তা এখনো হয়নি।

দুই বছর পরে জাতীয় নির্বাচন, এ সময় নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে সংবিধানে আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা থাকলেও তা এখনো হয়নি।

জনগণের অনাস্থা, নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কম, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই বর্তমান নির্বাচন কমিশন বিদায় নিতে চলেছে।

নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারের হাতে আর মাত্র চার মাস সময় আছে। বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর ৪ কমিশনারের পদের মেয়াদ ৫ বছর পর ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হতে যাচ্ছে।

যদিও ৪৯ বছর আগে সংবিধানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে, তবুও সকল ক্ষমতাসীন সরকার এ বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এ ধরনের আইন রয়েছে।

আইন না থাকায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতার সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি যেমন নেই, তেমনি কী কী বিষয়ের ভিত্তিতে একজন কমিশনারকে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে, সে ব্যাপারেও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলশ্রুতিতে সমগ্র প্রক্রিয়াটি বিতর্কের জন্ম দেয়।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বিরোধী দল, নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। এছাড়াও, সংস্থাটি স্থানীয় ও উপ-নির্বাচনে ভোটারের অনুপস্থিতি ও অনেক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণেও সমালোচিত হয়েছে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যর্থতার জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছে। এ ধরনের নির্বাচনের কারণে অনেক মানুষ ও রাজনৈতিক দল ভোট প্রক্রিয়ার প্রতি উৎসাহ হারিয়েছে।

নির্বাচন কমিশন ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) প্রযুক্তি চালু করার কারণেও বিতর্কিত হয়েছে। কিছু মানুষ দাবি করেছে, ভোট গণনায় 'অনিয়ম' সৃষ্টি করার জন্য এই প্রযুক্তি চালু করা হয়েছে।

বর্তমান কমিশনাররা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। কোনো নির্দিষ্ট আইন না থাকায়, সে বছর রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি সার্চ কমিটি তৈরি করেন।

১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে বেশিরভাগক্ষেত্রেই সরকার তাদের পছন্দের লোকদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংবিধানের ১১৮ (১) ধারায় বলা হয়েছে, 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।'

প্রখ্যাত আইনজীবী শাহদীন মালিক শনিবারে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি প্রয়োজন।'

তিনি আরও বলেন, 'যদি আইন প্রণীত হয়, তাহলে সরকার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারবে না, কারণ সেক্ষেত্রে প্রার্থীদের যোগ্যতা কী হবে, তা এই আইনই নির্ধারণ করবে।'

তিনি আরও জানান, এই আইন চালু হলে সিলেকশন কমিটি তৈরির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। 'যদি নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী একটি সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে গঠন করা হয়, তাহলে সেটি বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারের [কে এম নূরুল হুদা] অধীনস্থ নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বেশি নিরপেক্ষ হবে', বলেন শাহদীন মালিক।

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান নির্বাচন কমিশন সাফল্যের সঙ্গে জনগণকে ভোটবিমুখ ও বিশাল সংখ্যক পদে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন করতে সক্ষম হয়েছে। এটি দেশের নির্বাচনকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে।'

শাহদীন উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশনের সম্ভাব্য সদস্যদের নাম প্রস্তাব করার জন্য গঠিত বর্তমান সার্চ কমিটির কোনো 'আইনগত ভিত্তি' নেই।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের উদাহরণ দিয়ে শাহদীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এ সংক্রান্ত আইন আছে এবং আমাদেরকে সব কিছু নতুন করে তৈরি করতে হবে না। তথাকথিত এড-হক সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগদানের প্রক্রিয়াটি একটি কলঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।'

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৩ সেপ্টেম্বর জানান, তার দল নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত একটি স্থায়ী সমাধান চায়। 'কিন্তু তার আগে আমাদের একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন, যাদের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে', বলেন ফখরুল।

১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টি'র চেয়ারম্যান জিএম কাদের 'স্থায়ী সমাধান' পাওয়ার জন্য সংবিধান অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানান।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৮ সেপ্টেম্বর বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজ করছে।

তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে সামনে রেখে বিতর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'সংবিধানে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এটি হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তবে কোনো সরকার এ পর্যন্ত এটি করেনি। আইন প্রণয়ন আমাদের দায়িত্ব নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিমত হচ্ছে, সরকার নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতা চাইলে আমাদের তা দেওয়া উচিত।'

সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।

তবে এই আইন বা নীতিমালা তৈরির উদ্যোগের সময়সীমা সম্পর্কে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দেননি।

নির্বাচন কমিশন গঠনের বর্তমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে আইন মন্ত্রী বলেন, 'সরকার সংবিধানের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং কোনো ক্ষেত্রে এই ধারাগুলোকে লঙ্ঘন করা হয়নি।'

আগের উদ্যোগ

নির্বাচন কমিশনের সূত্ররা জানিয়েছে, ২০০৭-২০০৮ এ তৎকালীন নির্বাচন কমিশন একটি খসড়া আইন তৈরি করে সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল। তৎকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনকে জানায়, তারা যেনো খসড়াটি পরবর্তী সরকারের কাছে জমা দেয়।

আরও যাচাইবাছাইয়ের পর ২০১১ সালে আরেকটি খসড়া তৈরি করা হয়।

দ্য ডেইলি স্টার খসড়া আইনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে, যার শিরোনাম, 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগদান প্রক্রিয়া) আইন, ২০১২', যেটি ২০১১ সালের নভেম্বরে তৈরি করা হয়েছিল।

খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ দিতে, যার মধ্যে একজন কমিশনার নারী হবেন। আইনে আরও সুপারিশ করা হয়েছে, কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে দক্ষ, সৎ, নীতিমান ও নিরপেক্ষ নাগরিক বেছে নিতে।

নির্বাচনের প্রতি অনাগ্রহ

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদীয় উপ-নির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে দেখা গেছে, যেটি গণতন্ত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত। এই নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণের হারও খুবই কম ছিল। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যেমনই হোক না কেন, কয়েক বছর আগেও এই নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা প্রচুর উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে অংশ নিতেন।

উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ১৬০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৩টিতে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে, যার অর্থ প্রায় ২৯ শতাংশ চেয়ারম্যান কোনো ধরনের ভোট ছাড়াই পদে অসীন হয়েছেন।

৪৫৬টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৯৪ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে ৯৩ জনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত।

৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিলেট-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে মাত্র ৩৪ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা যায়। ২০২০ সালের ২১ মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ উপ-নির্বাচনের চিত্র আরও করুণ ছিল, কারণ ওই নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে।

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, 'দেশে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে। ভোটদান প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসা, আর এ কারণে সেখানে গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই।'

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের সদস্যরা ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট চুরিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আসায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেছেন।

ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ফেব্রুয়ারিতে একটি সভায় অভিযোগ আনে, নির্বাচনী ব্যবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়টি এখন সবাই জেনে গেছে এবং জনমানুষ এই প্রক্রিয়ার ওপর ভরসা হারিয়েছে।

দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ও এ বছরের ১৭ জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া দুটি পৃথক চিঠিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নির্বাচন কমিশনে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্তের অনুরোধ জানান।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Keep local realities in mind while making plans: PM to economists

Prime Minister Sheikh Hasina today asked the economists to design their policies, plans and programmes considering the local realities as advice from a foreigner will not be fruitful here.

25m ago