ডিজেলের দাম বৃদ্ধি: ঋণের বোঝা বাড়ছে রাজশাহীর জেলেদের

ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহী বিভাগের নদ-নদীতে মাছ ধরার ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অঞ্চলের জেলেদের দৈনিক আয় কমপক্ষে ৭৫ টাকা কমেছে। অফ-পিক মৌসুমে মাছও তেমন মিলছে না। ফলে ডিজেল কেনার টাকা শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
ছবি: আনোয়ার আলী/ স্টার

ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহী বিভাগের নদ-নদীতে মাছ ধরার ব্যয় বেড়ে গেছে। এই অঞ্চলের জেলেদের দৈনিক আয় কমপক্ষে ৭৫ টাকা কমেছে। অফ-পিক মৌসুমে মাছও তেমন মিলছে না। ফলে ডিজেল কেনার টাকা শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

জেলেরা জানান, নদীতে মাছ ধরার নৌকা চালাতে দিনে গড়ে ৫ লিটার ডিজেল লাগে। ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায় ৫ লিটারের জন্য অতিরিক্ত ৭৫ টাকা ব্যয় হচ্ছে তাদের, কমে যাচ্ছে আয়। ফলে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলেদের বেশিরভাগই মহামারির দুর্দশা থেকে এখনও বের হতে পারেননি। এর মধ্যে আয় কমায় ঋণে জর্জরিত জেলেরা।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলায় প্রায় ১ দশমিক ৪০ লাখ জেলে আছেন। তাদের ৭০ শতাংশই ৩৩টি নদী থেকে মাছ ধরেন, যা বছরে বিভাগে ধরা মোট মাছের ৫ লাখ টন ২০ শতাংশ।

এই বিভাগে আরও ১ দশমিক ৪০ লাখ মাছ চাষী আছেন, যারা বছরে ধরা মোট মাছের ৭০ শতাংশ পুকুর থেকে এবং বাকি ১০ শতাংশ বিল ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করে থাকেন।

বিভাগ থেকে প্রতি বছর ৫৫ হাজার টনের বেশি উদ্বৃত্ত মাছ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে পাঠানো হয়।

সম্প্রতি রাজশাহী জেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী চর সাতবাড়িয়া, নবগঙ্গা ও বেরপাড়া এলাকা পরিদর্শনকালে এই সংবাদদাতা ৩০ জন জেলের সঙ্গে কথা বলেন।

তারা জানান, তাদের বেশিরভাগই স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে ৮৫ টাকা লিটার দরে বাকিতে ডিজেল কেনেন। নিয়মিত টাকা পরিশোধ করতে না পারায় অনেক জেলের কাছে ডিজেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন বিক্রেতারা।

ছবি: আনোয়ার আলী/ স্টার

অক্টোবর-নভেম্বর মাস থেকে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত মাছ ধরার অফ-পিক সিজন ধরা হয়। এ সময় নদী পানিতে প্রায় পূর্ণ থাকলেও মাছ কম পাওয়া যায়। এপ্রিল-মে থেকে আগস্ট-সেপ্টেম্বরকে পিক সিজন বিবেচনা করা হয়। এ সময় শুষ্ক মৌসুমের পানি হ্রাস পেতে থাকে এবং বৃষ্টির সঙ্গে নদী পুনরায় ভরে যেতে থাকে। নদীতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায় তখন।

চর সাতবাড়িয়ায় জেলে মুস্তাকিম বিল্লাহ বলেন, 'অফ সিজনে এমনিতেই আমরা পর্যাপ্ত মাছ পাই না। তার উপর ডিজেলের দাম বৃদ্ধি আমাদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিয়েছে।'  

মুস্তাকিম অন্য ২১জন জেলের সঙ্গে মিলে ৫টি নৌকায় মাছ ধরে থাকেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ লিটার ডিজেল লাগে তাদের।

অফ সিজনে মাছ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি জানান, গত ২ সপ্তাহে বাকিতে ১৯ হাজার ১২৫ টাকার ডিজেল কিনে তারা কেবল ১টি ৯ কেজি ওজনের পাঙ্গাস মাছ পেয়েছেন। নিলামে মাত্র ৭ হাজার  টাকায় বিক্রি হয়েছে মাছটি।

মুস্তাকিম বলেন, 'এই দাম দিয়ে আমরা কী করব? এই টাকার কতটুকু নিজেদের মধ্যে ভাগ করব? আর কতটুকু দিয়ে ডিজেলের দাম পরিশোধ করব?'

ডিজেলের দাম বাড়ায় তাদের এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা বাকি পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের অনেকে মাছ ধরা ছেড়ে রিকশা চালানো শুরু করেছে। কিন্তু এতেও আজকাল জীবন চলে না।'

আরেক জেলে জামাল উদ্দিন জানান, মাছ বিক্রির টাকার কিছুটা নিজেরা নিয়ে আর কিছুটা ডিজেল বিক্রেতাকে দিয়ে কোনো মতে দিন চলছে তাদের।

তিনি বলেন, 'আমরা পিক সিজনের জন্য অপেক্ষা করছি। ওই সময় প্রচুর মাছ ধরতে পারি। দৈনিক আয় ৫০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায় তখন।'

তবে পিক সিজনের ভালো আয় কখনোই জেলেদের কোনো কাজে আসে না বলে জানান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের অধ্যাপক এবিএম মহসিন।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'অফ-পিক সিজনে জেলেদের ঋণের বোঝা এত বড় হয়ে যায় যে, পিক সিজনে ভালো উপার্জনের বেশিরভাগই বকেয়া ঋণ পরিশোধে চলে যায় তাদের।'

অফ-পিক সিজনে জেলেদের সরকারি সহায়তা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

সাতবাড়িয়ার জেলে শাহ জামাল বলেন, 'ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় বিক্রেতা আমাকে ডিজেল দেওয়া বন্ধ করে দেন। ২-১টি মাছ খুঁজে পেতে ২ সপ্তাহ বা এরচেয়েও বেশি সময় লাগে। মাছ না পেলে আমি কীভাবে ডিজেলের দাম দেবো?'  

ছবি: আনোয়ার আলী/ স্টার

জানতে চাইলে সাতবাড়িয়া জামে মসজিদের কাছে ডিজেল বিক্রেতা আবুল কালাম বলেন, 'আমি যতদিন পারি তাদের বাকিতে ডিজেল দিই। কিন্তু আমার সক্ষমতারও একটা সীমা আছে।'

বেরপাড়া এলাকার মাহবুব হোসেন জানান, তিনি আরও ২ জেলের সঙ্গে ছোট মাছ ধরেন প্রতিদিন। ১ দিনে তারা ৫১০ টাকার ডিজেল নিয়ে পদ্মায় নামেন। তারা সাধারণত পিওলি, বাঁশপাতা, ছোট চিংড়ি, খয়রা, রাইখোর, পুঁটি, ট্যাংরা এবং বেলে মাছ পান। এগুলোর দাম ১ হাজার টাকার মতো হয়। ফলে মাছ ধরার সময় খাবারের খরচ দিয়ে তারা একেক জন দিনে ২০০ টাকার বেশি আয় করতে পারেন না।

তিনি বলেন, 'এত অল্প টাকায় কি চলে? বাঁচার জন্য আমাদের ঋণ করতেই হয়।'

ইতোমধ্যে মাহবুব হোসেনের ৪৫ হাজার টাকার মতো ঋণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া, তার পরিচিত কয়েকজন জেলের ২ লাখ টাকার মতো ঋণ আছে বলে জানান তিনি।

আরেক জেলে আসাদুল হক জানান, তাকে নৌকা, জাল ও অগভীর ইঞ্জিন সরবরাহকারীদের সঙ্গে মাছ বিক্রির টাকা ভাগাভাগি করতে হয়। ডিজেলের দাম বাড়ার পর থেকে তাকে অতিরিক্ত ১০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।

'মাছ খুঁজে পাব না জানি। তারপরও নদীতে নামি। কারণ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হলে কিছু টাকা তো হাতে আসতে হবে', তিনি বলেন।

নবগঙ্গার মিনারুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের দুঃখ শোনার কেউ নেই। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার মতোও কেউ নেই।'

শুধু জেলেদেরই নয়, ডিজেলের দাম বাড়ার পর মাছ চাষীদেরও খরচ বেড়েছে। পরিবহন বাবদ বাড়তি টাকা গুণতে হচ্ছে তাদের।

পবা উপজেলার মাছ চাষী মো. ইব্রাহিম জানান, বছরে প্রায় ২০০ ট্রাক জীবন্ত মাছ ঢাকায় পাঠানোর জন্য তাকে বাড়তি ২ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অলোক কুমার সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জেলেরা আমাকে তাদের এসব দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়ে রেখেছি।'

Comments

The Daily Star  | English

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

11h ago