কৃষকের দুঃস্বপ্নের নাম ডিজেল

ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহী অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য কৃষক ও কৃষিবিদদের।

ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে রাজশাহী অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য কৃষক ও কৃষিবিদদের।

তারা বলেছেন, জমি চাষ, ফসল কাটা, পরিবহন, ধান মাড়াই, ঝাড়াই ও সেচের জন্যে ডিজেলচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ডিজেলের বর্ধিত দাম ও বর্ধিত দামে জমিতে ডিজেল পরিবহনের জন্যেও খরচ বেড়েছে।

এতে করে, কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেলে তাদের বাড়তি ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাইদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ন্যায্য দাম না পেলে কৃষক ক্ষতির মুখে পড়বেন। আর ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে দাম কমে গেলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। তখন ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে।'

তিনি বলেন, 'মহামারি চলাকালে কৃষি ও কৃষক দেশের জন্যে গর্বের জায়গা ছিল। কিন্তু, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষি খাতটি উপেক্ষা করা হয়েছে।'

কৃষকের ক্ষতি পূরণে অবিলম্বে সরকারকে উপায় বের করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'অন্যথায়, কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হবে। এর প্রভাব সারা দেশের মানুষের ওপর পড়বে। অশান্তি ছড়িয়ে পড়তে পারে।'

ডিজেলের দাম বাড়ার পর জমি চাষে পাওয়ার টিলার ব্যবহারের জন্যে বিঘা প্রতি উঁচু-নিচু এলাকা ভেদে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা খরচ বেড়েছে। পরিবহন খরচ প্রতি বিঘায় ৪০০ টাকা ও সেচ খরচ প্রতি ঘণ্টা ৩০ টাকা বেড়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।

কৃষকরা সাধারণত মাড়াই কল ও হপার মেশিনে ধান ঝাড়াই করার খরচ ধান দিয়ে মিটিয়ে থাকেন। ডিজেলের দাম বাড়ার পর এসব কাজের জন্য তাদেরকে প্রতি বিঘা জমিতে ১০ কেজি ধানের অতিরিক্ত খরচ গুণতে হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় মোট সেচের জমির ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশে ডিজেলচালিত সেচ পাম্প ব্যবহার করে সেচ দেওয়া হয়ে থাকে।

এ অঞ্চলে সেচ কাজের আওতায় থাকা মোট ৬ লাখ ৯১ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমির মধ্যে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৭ হেক্টর জমি ডিজেলচালিত ৫ হাজার ৪৬৪টি লো লিফট পাম্প, ৭২ হাজার ৬৯৬টি অগভীর নলকূপ ও ৪৭১টি আধা-গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ করা হয়ে থাকে।

এ ছাড়াও, এই অঞ্চলে ৩০৫টি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার, ১৮১টি রিপার, ২৭টি রোপনকারী যন্ত্র, ৪২ হাজার ৭৭১টি পাওয়ার টিলার, ১ হাজার ৫৪১টি ট্রাক্টর ও ৩৩ হাজার ৫১৮টি থ্রেসার রয়েছে যা ডিজেলচালিত।

গত সোমবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের গোলাই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে সচ্ছল কৃষক বল্টু সরদার তার নিজের জমি থেকে আমন ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি জানিয়েছেন, তার নিজস্ব ট্রাক্টর আছে এবং দাম বাড়ানোর আগেই তার প্রয়োজনীয় ডিজেলের মজুদ ছিল বলে তার এবার অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে না। তবে তার গ্রামের অন্য কৃষকরা ধান পরিবহনে বিঘা প্রতি ৬০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকা খরচ করছেন।

কিন্তু, বল্টু সরদারকে তার আমন ধানের মাড়াইয়ের জন্যে মাড়াই কল ভাড়া করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'এক বিঘা জমির ধান মাড়াই করতে আমরা এতদিন ১০ কেজি ধান দিয়েছি। একই কাজের জন্যে এখন ২০ কেজি ধান দাবি করা হচ্ছে।'

'কৃষকের ক্ষতি হলে কারোরই কিছু আসে যায় না। কিন্তু, এই মুহূর্তে খরচের কথা ভাবতে বসলে আমাকে কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে হবে। আমি ইতোমধ্যেই কৃষিকাজ অনেক সংকুচিত করেছি। সামনে আরও কমিয়ে আনবো। শুধু নিজের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু থাকবে,' যোগ করেন তিনি।

একই গ্রামের কৃষক আব্দুল মমিন বলেন, 'পাওয়ার টিলার মালিক যারা বিঘা প্রতি জমিতে এক চাষের জন্য ৩০০ টাকা নিতেন, এখন ১৫০ টাকা বাড়িয়ে তারা নিচ্ছেন ৪৫০ টাকা।'

মমিন তার ছয় বিঘা জমিতে আমন ধান কাটার পর গম, সরিষা, মসুর ও বেগুন চাষ শুরু করেছেন। এই ফসলগুলো তুলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার বোরো আবাদ করবেন।

তিনি বলেন, 'গম, মসুর, ছোলা, সরিষাসহ রবি ফসলের জন্যে ২ বার চাষ লাগে। এ জন্য খরচ হচ্ছে ৯০০ টাকা, যা আগের খরচের চেয়ে ৩০০ টাকা বেশি। ধান চাষে ৩ বার জমিতে চাষ করতে হয়, সেখানে খরচ হবে ৯০০ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার ৩৫০ টাকা।'

তানোর উপজেলার বহোড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ জানান, তিনি ধান ঝাড়াই করতে হপার মেশিন ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, 'এক বিঘা জমির ধান ঝাড়াই করতে তাকে দিতে হতো ১০ কেজি ধান। এখন লাগছে ২০ কেজি।'

গোদাগাড়ী উপজেলার জগপুর গ্রামের কৃষক মাজেদ আলী জানান, ডিজেলচালিত পাম্প মালিকরা এরই মধ্যে এক ঘণ্টা সেচের জন্য সেচ খরচ ৩০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, 'আমরা এক ঘণ্টা সেচের জন্য ১০০ টাকা দিতাম। এখন দাম বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে।'

নাটোরের সিংড়া উপজেলার চলন বিল এলাকার কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, 'ডিজেলের দাম বাড়ার পর এবার আর আমার বোরো ধান করার কোনো ইচ্ছাই হচ্ছে না।'

তিনি সাধারণত ৫টি স্কিমে চলনবিলের ৮০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেন যেখানে তার প্রতি বিঘায় সেচের জন্যে কমপক্ষে ৬০ লিটার ডিজেল লাগে।

ডিজেলের দাম ১৫ টাকা বেড়েছে, তবে চলনবিল এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার জমিতে ডিজেল নিয়ে যেতে আরও ৩ টাকা বেশি খরচ হবে বলে জানান তিনি।

'ডিজেলের দাম বেড়েছে, সারের দাম বাড়ার সম্ভাবনা আছে। বোরো চাষ করে এবার লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। আমি অন্য ফসল চেষ্টা করব,' বলেন জলিল।

নির্মল কুমার দাস বলেন, 'বর্ধিত দামে ডিজেল কিনছি বলে আমাকে প্রতিটি পরিষেবার দাম বাড়াতে হয়েছে। তা না হলে আমি বাঁচব কেমন করে? আমি তো নিজের ক্ষতি করতে পারি না।'

তানোরের মোহর গ্রামের নির্মল একটি ডিজেলচালিত পাম্পের মাধ্যমে সেচ দেন। তার একটি পাওয়ার টিলার, একটি ট্রাক্টর ও একটি মাড়াই মেশিনও আছে৷

যদিও ডিজেলের দাম এখন প্রতি লিটার ৮০ দশমিক ৭৭ টাকা, নির্মল তালন্দা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে তার গ্রামে স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি লিটার ডিজেল ৮৫ টাকায় সংগ্রহ করেন। তারপর ফসলের মাঠে পাম্পে ডিজেল নিয়ে যেতে তার পরিবহন খরচ আছে বলেও জানান তিনি।

তিনি প্রতি ঘণ্টায় সেচ খরচ ১০০ টাকার বিপরীতে ১২০ টাকা, পাওয়ার টিলারের ভাড়া আগের প্রতি বিঘা ২০০ টাকার বিপরীতে ২৫০ টাকা, ট্রাক্টরের রেট আগের প্রতি বিঘা ৬০০ টাকার বিপরীতে ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছেন।

তিনি এখন কৃষকদের কাছ থেকে এক বিঘা জমির ফসলের জন্য তার মাড়াই মেশিন ব্যবহার করতে আগের সাড়ে ১০ কেজি ধানের বিপরীতে ১৪ কেজি ধান চার্জ করেন।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'ডিজেলের দাম বাড়ার পর মাঠের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Tk 127 crore owed to customers: DNCRP forms body to facilitate refunds

The Directorate of National Consumers' Right Protection (DNCRP) has formed a committee to facilitate the return of Tk 127 crore owed to the customers that remains stuck in the payment gateways of certain e-commerce companies..AHM Shafiquzzaman, director general of the DNCRP, shared this in

17m ago