অযত্নে পড়ে আছে ডিএনসিসির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম

বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর জন্য প্রায় দেড় বছর আগে তিনটি টার্নটেবল মই কেনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৭৪৬ দশমিক ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি মই জার্মানি থেকে কিনতে খরচ হয় নয় কোটি টাকা।

বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর জন্য প্রায় দেড় বছর আগে তিনটি টার্নটেবল মই কেনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৭৪৬ দশমিক ৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি মই জার্মানি থেকে কিনতে খরচ হয় নয় কোটি টাকা।

কেনার কয়েক মাস পর একটি সরকারি পরিদর্শক দল অবশ্য এর মধ্যে দুটি মইকে রাজধানীর ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে অলস পড়ে থাকতে দেখেছে। এ দুটির মধ্যে একটিতে ত্রুটি পাওয়া গেছে। অন্যটি আংশিকভাবে নষ্ট। দুটিরই এখন মেরামত প্রয়োজন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশন (আইএমইডি)।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, তৃতীয় মইটিও সম্প্রতি অকেজো হয়ে পড়েছে।

কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ইমারজেন্সি রেসপন্স সরঞ্জামের গুদাম। আমদানি করা বিভিন্ন অগ্নিনির্বাপন যন্ত্রপাতি এখানে অবহেলায় পড়ে আছে। ছবি: স্টার/আইএমইডি

আইএমইডি বলছে, শুধু মইগুলোই নয়, প্রকল্পটির আওতায় কেনা আরও নানা ধরনের সরঞ্জাম এখন রাজধানীর বিভিন্ন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও ইমারজেন্সি রেসপন্স গুদামে পড়ে আছে। ধুলো জমছে এসব সরঞ্জামে।

এসব স্থান পরিদর্শনের পর আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, অনুসন্ধান ও উদ্ধারে ব্যবহৃত ৫০টিরও বেশি হালকা সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় এসব স্থানে পড়ে আছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক সুক্ষ্ম সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

সম্প্রতি 'আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট-ডিএনসিসি পার্ট' নামের এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আইএমইডি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডিএনসিসি ও ফায়ার সার্ভিসসহ প্রকল্পে জড়িত অন্য সংস্থাগুলোর এ ব্যাপারে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাস নেই। বিভিন্ন সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ কোনো বরাদ্দও নেই। ফলে প্রকল্পটি কতটা টেকসই হবে-তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকরাও গত ৮ জুলাই এমন অন্তত চারটি গুদাম ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিদর্শন করেন এবং সবগুলোকেই তালাবদ্ধ অবস্থায় পান।

মহাখালী স্যাটেলাইট কনট্রোল রুমে একটি সার্ভার। ছবি: স্টার/আইএমইডি

প্রতিবেদনে সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের ব্যবস্থা, গ্যারেজ স্থাপন, দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে আইএমইডি।

কেন এ প্রকল্প?

অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশে সরকার এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। ডিএনসিসি ৭৪৬ দশমিক ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির একটি সহ-প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৭৩১ দশমিক ৫০ কোটি টাকা।

এ প্রকল্পের আওতায় ডিএনসিসি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও সিলেট সিটি করপোরেশনের (এসসিসি) ৭৪ ধরনের জরুরি সরঞ্জাম সংগ্রহ ও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করার কথা।

প্রকল্পটির কাজ ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু, করোনা মহামারির কারণে এর মেয়াদ একবার ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় আবারও বাড়াতে চাইছে।

সংশ্লিষ্ট নথির তথ্য অনুসারে, এ সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদিত হলে প্রকল্পের ব্যয় হবে ৮০৫ দশমিক ৯০ কোটি টাকা এবং মেয়াদ হবে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। প্রস্তাবটি এখন পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

আইএমইডির পর্যবেক্ষণ

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুসারে, গত মে মাসে রাজধানীর বঙ্গবাজারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তর পরিদর্শন করে তাদের পরিদর্শক দল। সেখানে ওই তিনটি মইয়ের দেখা পায় তারা।

একইদিনে তারা পূর্বাচলের ফায়ার সার্ভিস দপ্তরও পরিদর্শন করে। এখানে প্রচুর আইসিটি সরঞ্জাম রাখা আছে। যদিও, বাক্সবন্দি থাকার কারণে এগুলোর অবস্থা দেখতে পারেনি পরিদর্শক দল।

গত ২৮ এপ্রিল দলটি আজিমপুরে ডিএসসিসির আঞ্চলিক অফিস-৩ এর পাশে অবস্থিত জরুরি সাড়াদান সরঞ্জামের গুদাম পরিদর্শন করে। সেখানকার নিচ তলায় অ্যাম্বুলেন্স বা লাশবাহী কোনো যানবাহন দেখতে পায়নি তারা। সিসিটিভিও ঠিকভাবে কাজ করছে না বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে।

মিরপুর-১০ এ ইমারজেন্সি রেসপন্স অয়্যারহাউজে জেনারেটরের ওপর ধুলা জমছে। ছবি: স্টার/আইএমইডি

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'অন্যান্য গুদামের মতো এখানেও রক্ষণাবেক্ষণের তীব্র ঘাটতি। গুদামের রুমগুলোতে ধুলো পড়ে আছে এবং সেখানে অব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো পড়ে আছে। সূক্ষ্ম সরঞ্জামগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।'

একইদিনে মিরপুরের একটি গুদামেও যায় পরিদর্শক দল। প্রতিবেদনে সেখানকার পাঁচটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছবিতে অব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স পড়ে থাকতে এবং বাকিগুলোতে অব্যবহৃত জেনারেটর, আসবাবপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামে ধুলোর আস্তরণ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

গত ২৫ মে পরিদর্শক দল কারওয়ান বাজারের গুদাম পরিদর্শন করে। নির্মাণাধীন একটি পার্কের কাজে ইট রাখার কারণে সেখানকার মূল ফটক এমনভাবে আটকে আছে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জরুরি ভিত্তিতে গুদাম থেকে কোনো সরঞ্জাম বের করা সম্ভব হবে না। ‍

অন্যান্য গুদামের মতো এ গুদামেও ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে এবং যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মহাখালি ও কল্যাণপুরের গুদাম এবং আজিমপুর, মিরপুর-১০, কারওয়ান বাজার ও মহাখালীর স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সম্পর্কে একই ধরনের পর্যবেক্ষণ আইএমইডির।

দ্য ডেইলি স্টার যা দেখেছে

দ্য ডেইল স্টারের প্রতিবেদকরা গত ৮ জুলাই মহাখালী ও কারওয়ান বাজারের গুদাম ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিদর্শন করেন।

ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিস-৩ এর কাছে অবস্থিত মহাখালীর গুদামটির দরজা বন্ধ পান তারা। এর সামনে যেভাবে ঘাস গজিয়েছে, তাতে গুদাম যে খুব একটা খোলা হয় না তা স্পষ্ট।

যোগাযোগ করা হলে ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ জানান, প্রকল্পটির অধীনে থাকা অ্যাম্বুলেন্সগুলো বর্তমানে ডিএনসিসির কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গুদামের চাবি তার কাছে থাকে এবং যখন প্রয়োজন হয় তখন এটি খোলা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ করেন তিনি।

কারওয়ান বাজারের গুদাম ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকরা দেখতে পান, স্থাপনাটি একটি টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা। নির্মাণাধীন একটি পার্কের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেড়াটি দেওয়া হয়েছে।

বেড়ার অন্য পাশের ছোট একটি গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রতিবেদকরা গুদামটি তালাবদ্ধ অবস্থায় পান। পার্কে কাজ করা কয়েকজন শ্রমিক জানান, সবশেষ গত রমজান মাসে এই গুদাম খোলা হয়েছিল।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক তারিক বিন ইউসুফ জানান, তারা প্রায় দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসগুলোর কাছে গুদাম এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষগুলো হস্তান্তর করেছেন। এক্সিকিউটিভ অফিসগুলোরই এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ছিল।

কিন্তু, করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে না বলে দাবি করে তিনি বলেন, আগামী দুই বা তিন মাসে কেন্দ্রের সঙ্গে সব জোনাল অফিসকে যুক্ত করে ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার স্থাপন করা হবে।  

কারওয়ান বাজারের গুদামের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারিক বিন ইউসুফ বলেন, নির্মাণাধীন পার্কের নিরাপত্তার জন্য বেড়াটি দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ হলে সেখানকার প্রবেশ মুখে পর্যাপ্ত জায়গা থাকবে।

মইয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে মইগুলো পাইনি। ত্রুটিপূর্ণ মই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেবে।'

আইএমইডির পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আইএমইডি আমাদের কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা চায়নি।'

মই সরবরাহকারী রোজেনবাউর এজির স্থানীয় এজেন্ট সাদমান অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, তারা দুটি মই 'আনুষ্ঠানিকভাবে' ফায়ার সার্ভিসে হস্তান্তর করেছেন এবং কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের শনাক্ত করা কিছু 'ত্রুটি' সমাধানের পরে অপরটিকে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু, গ্যারেজ থেকে বের করার সময় ফায়ার সার্ভিস দুটি মইয়ের একটি আংশিকভাবে নষ্ট করে ফেলেছে।

ইতোমধ্যে ত্রুটিযুক্ত ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত মই দুটির জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ পেয়েছেন জানিয়ে গত ১৫ জুলাই তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে বিশেষজ্ঞদের এগুলো মেরামত করার কথা, করোনার কারণে তারা ঢাকায় আসতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই বিশেষজ্ঞরা এগুলো ঠিক করে দেবেন বলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসকে নিশ্চিত করেছি আমরা।'

এ ছাড়া, ফায়ার সার্ভিস ব্যবহারের সময় তৃতীয় মইটিও নষ্ট করে ফেলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'ওই মইটিও নিজেদের খরচে মেরামত করে দেব আমরা।'

যোগাযোগ করা হলে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, 'কোভিড পরিস্থিতির কারণে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা যায়নি। এসব সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত লোক প্রস্তত রাখতে শিগগিরই ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, স্কাউট ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সভা করব।'

'সবকিছু যেন কার্যক্ষম থাকে, সেজন্য আমরা প্রতি তিন মাসে একবার মহড়া দেবো', মেয়র বলেন।

 

সংক্ষেপিত: ইংরেজিতে পুরো প্রতিবেদনটি পড়তে ক্লিক করুন Crucial yet left without care

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন জারীন তাসনিম

Comments

The Daily Star  | English

Heatwave alert extended for 72 hours

The Met office has extended the heat alert that the ongoing heatwave is likely to persist for 72 more hours starting this morning

42m ago