পাচারকারীদের নজর বস্তির নারীদের দিকে

আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রগুলো শহরের বস্তিগুলোতে বসবাসরত নারীদের টার্গেট করছে। ভালো চাকরির কথা বলে তারা ওই নারীদের ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দিচ্ছে।
প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রগুলো শহরের বস্তিগুলোতে বসবাসরত নারীদের টার্গেট করছে। ভালো চাকরির কথা বলে তারা ওই নারীদের ভারতের বিভিন্ন যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দিচ্ছে।

গত ছয় বছরে এভাবে অন্তত ৫০ জন নারী পাচার হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরে কালশীর একটি বস্তি থেকে এমন প্রায় ২০ জন নারীকে পাচার করা হয়েছে।

কালশীর ওই বস্তি থেকে চার বছর বয়সী সন্তানের এক মা গত ৬ এপ্রিল ভারতের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। পাচারকারীরা তাকে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে একটা বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই নারীকে প্রতিবেশী দেশটির একটি যৌনপল্লীতে নেওয়া হয়।

পরে ওই নারী যৌনপল্লী থেকে টেলিফোন করে বিষয়টা তার মাকে জানান। সম্প্রতি পাচার হওয়া ওই নারীর মা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, মেয়ের ফোন পাওয়ার পরপরই তিনি দ্রুত সোহাগ ও কালু নামের দুই ব্যক্তির কাছে ছুটে যান। যারা তার মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছিল।

'কালু ‍ও সোহাগ আমাকে বলে, এসব ভুল কথা। আমার মেয়ে ভালো আছে।'- বলেন তিনি।

বৃদ্ধ ওই মায়ের কাছ থেকে আরও জানা যায়, তার মেয়ে বর্তমানে ভারতের কিশানগঞ্জের একটি যৌনপল্লীতে আছেন। সেখানে মাদক নিতে বাধ্য করার পাশাপাশি তাকে যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে।

চার বছর বয়সী নাতনীর হাত ধরে ওই বৃদ্ধা বলতে থাকেন, সম্প্রতি ভারতের ওই যৌনপল্লী থেকে বস্তির আরেক নারী তার মেয়েকে উদ্ধার করে দেশে ফিরেছেন। তাদের কাছ থেকেই মেয়ের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন তিনি।

কালশী বস্তির ওই তিন নারীকে একই চক্র পাচার করেছিল।

পাচার হওয়া নারীর মা ও ভারত থেকে ফিরে আসা আরেক নারী গত ১৫ আগস্ট পল্লবী থানায় পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। ওই দিনই অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন কালু, সোহাগ ওরফে নাগিন সোহাগ ও বিল্লাল হোসেন নামের তিন ব্যক্তিকে ঢাকা থেকে আটক করে র‌্যাব।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, চক্রটির সঙ্গে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন জড়িত। যারা ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বস্তিগুলো থেকে নারীদের পাচার করছে।

কালু ও সোহাগ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভিকটিমরা পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। কর্মকর্তারা বলছেন, কালু-সোহাগের চক্রটি এককভাবে গত এক বছরে ১৫ জনের বেশি নারীকে পাচার করেছে।

তবে কিছু ভিকটিম অভিযোগ করে বলেন, প্রভাবশালী বলে পুলিশ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি অভিযুক্তদের কয়েকজন আটক হলেও তদন্তকারীরা চক্রটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাচ্ছে না। এ ছাড়া পাচারকৃতদের ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।

এই অভিযোগ অস্বীকার করে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম জানান, তারা প্রতিটি মামলা তদন্ত করেছেন। তিনি বলেন, 'এই ঘটনায় এর মধ্যে দুটি মামলা করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তিন অভিযুক্তকে। যার মধ্যে দুই জন জড়িত থাকার বিষয়টি আদালতে স্বীকার করেছেন।'

এই পাচারকারী চক্রের আরও কয়েক সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে পারভেজ ইসলাম আরও বলেন, 'পাচার হওয়া নারীদের সম্পর্কে আমরা তথ্য পেয়েছি। এখন তা যাচাই করা হচ্ছে।'

মেয়েকে উদ্ধারে স্বেচ্ছায় পাচার হন এক নারী

কালশী বস্তির চার বছর বয়সী শিশুর নানী যে নারীর কাছ থেকে তার মেয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় পাচার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন তার নিজের মেয়েকে উদ্ধারের জন্য।

ভারতের ওই যৌনপল্লী থেকে মেয়েকে উদ্ধার করে গত ২৩ জুন তিনি দেশে ফিরে আসেন।

এ প্রতিবেদককে ওই নারী জানান, পাচারকারী চক্র তার মেয়ের মগজ ধোলাই করে ফেলেছিল। তারা বলত, বস্তিতে থেকে তার জীবন নষ্ট করা ঠিক হবে না। তার চেয়ে যদি সে বিউটি পার্লারে কাজ নেয়, তাহলে তার একটা উন্নত ভবিষ্যৎ হবে।

ওই নারী বলেন, 'আমার মেয়ে একটা ফাঁদে পড়ে গত ১৭ জানুয়ারি ঘর ছাড়ে। তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। পর দিন মেয়ে আমাকে ফোন করে জানায় যে, সে প্রতারণার শিকার হয়েছে। পাচারকারীরা তাকে ভারতে বিক্রি করে দিয়েছে।'

এক মাস পর পাচার হওয়া ওই মেয়ে আবার তার মাকে ফোন করে ভারতে তার অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়।

এই মা জানান, মেয়ের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানান পর তিনি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাড়া পাননি। পরে পরিচয় লুকিয়ে তিনি চাকরি চেয়ে একই পাচারকারী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

পরে পাচারকারীরা তাকে দিল্লির একটি যৌনপল্লীতে নিয়ে যায়। সেই স্মৃতি মনে করে ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমাকে ওই যৌনপল্লীতে চার মাস ধরে অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে অন্য একটি যৌনপল্লীতে নেওয়ার সময় আমি চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ি। পরে রাস্তা ধরে দৌড়ে একটা অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে আসি।'

পরবর্তীতে দুঃসাহসী এই মা কিশানগঞ্জের যৌনপল্লীতে পৌঁছান। সেখানে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন। যিনি তার মেয়েকে ওই যৌনপল্লী থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে রাজি হন।

কিন্তু যৌনপল্লীর মালিকরা জানায়, তারা তার মেয়েকে আড়াই লাখ চাকায় 'কিনেছে'। তাই বিনা পয়সায় তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি তারা।

এই পরিস্থিতিতে সেই নেতা মেয়েকে উদ্ধারের ব্যাপারে ওই নারীকে সাহায্য করেন। শেষ পর্যন্ত ‍জুন মাসে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসার সময় মা-মেয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক হন।

যদিও বিএসএফ কর্মকর্তারা মা-মেয়ের নিদারুণ দুর্দশার কথা শুনে পতাকা বৈঠক ডেকে তাদের বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেন।

পরবর্তীতে দেশে ফিরে ওই নারী পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে দুটি মামলার একটি দায়ের করেন। তিনি বলেন, 'আমি এখন ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছি। কারণ গ্রেপ্তারকৃতরা জেল থেকে বেরিয়ে এসে আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে।'

ওই নারী জানান, দেশে ফেরার পর তিনি ওই পাচারকারী চক্রের হাত থেকে আরও দুই নারীকে রক্ষা করেছেন।

পাচারের একটি প্রধান রুট সাতক্ষীরা

কালশী বস্তির একজন রিকশাচালক অভিযোগ, এই একই চক্র হয়তো তার স্ত্রীকে ভারতে পাচার করেছে। তিনি বলেন, 'কালু ও সোহাগ আমার বউকে ভালো চাকরির লোভ দেখাত। একদিন সে আমাকে কিছু না জানিয়ে ঘর ছাড়ে। আমার মনে হয় সে একই সিন্ডিকেটের প্রতারণার শিকার হয়েছে।'

ভুক্তভোগী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ভিকটিমদের প্রথমে সাতক্ষীরায় নিয়ে 'সেফ হাউসে' রাখা হয়। পরে একটা ছোট নদী পার করে তাদের ভারতে পাচার করা হয়।

র‌্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এই সিন্ডিকেটের ছোট ছোট 'সেফ হাউস' আছে। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সীমান্তের দুই পাশেই এই সিন্ডিকেটের লোকজন আছে। তারা মাঝে মধ্যে গ্রেপ্তার হয়। পরে জামিনে বের হয়ে এসে আবার একই অপরাধে জড়ায়।'

র‌্যাব পরিচালক আরও জানান, চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের শারিরীক ও যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি মাদক নিতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, 'আমরা এর মধ্যে পাচারকারী চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে ধরেছি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে শাখা সাধারণত ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে, তারাও সীমান্তের ওপারে সক্রিয় সিন্ডিকেট সদস্যদের আপডেট পাচ্ছে। আমরা সতর্ক আছি, যাতে তারা আর কাউকে পাচার করতে না পারে।'

গত জুন মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত 'ট্রাফিকিং ইন পারসনস রিপোর্ট-২০২১' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশ সরকার গত এক বছরে ৫১৭ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির (যৌন কাজে পাচারের জন্য ১৮৪ জন ও জবরদস্তি শ্রমে নিযুক্ত করার জন্য ৩৩৩ জন) বিচার করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'এর মধ্যে সাত পাচারকারী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে একটি যৌন কাজে পাচারের জন্য, দুটি জবরদস্তি শ্রম পাচারের জন্য, আর চারটি পাচার সংক্রান্ত অনির্ধারিত অপরাধের জন্য।'

চলতি বছরে মার্চে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নতুন একটি পাচারকারী চক্রকে চিহ্নিত করে। যারা টিকটক অ্যাপ ব্যবহার করে তরুণীদের পাচার করত।

চক্রের সদস্যরা তরুণীদের ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে ভারতে পাচার করত। সেখানে ভুক্তভোগীদের ঠাঁই হতো বিভিন্ন যৌনপল্লীতে। এই চক্রটিকেও সাতক্ষীরায় 'সেফ হাউস' ব্যবহার করতে দেখা যায়। পরে সীমান্তবর্তী দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখানোর নাম করে ভুক্তভোগীদের পাচার করা হয়।

র‌্যাব ও পুলিশের তথ্য অনুসারে, এই 'টিকটক চক্র' অন্তত ৫০ জন নারীকে পাচার করেছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এ পর্যন্ত এই চক্রের প্রায় ২০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ১১ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Keep local realities in mind while making plans: PM to economists

Prime Minister Sheikh Hasina today asked the economists to design their policies, plans and programmes considering the local realities as advice from a foreigner will not be fruitful here.

47m ago