স্লোভেনিয়ার সৌন্দর্য মাউন্ট ট্রিগলাভ, লেক বোহিনি ও লেক ব্লেডের সন্ধানে

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত সাত হাজার ৮২৭ দশমিক চার বর্গমাইলের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। লুবলিয়ানা দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর।
স্লোভেনিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্ল্যাসিয়াল হ্রদ লেক বোহিনি। ছবি: লেখক

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত সাত হাজার ৮২৭ দশমিক চার বর্গমাইলের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। লুবলিয়ানা দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর।

দেশটির উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে-হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ২৯ মাইল সীমারেখা বরাবর অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূল। ইউরোপের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল আল্পস পর্বতমালা, প্যানোনিয়ান প্লেট, ভূ-মধ্যসাগর ও ডিনারেইডসের মিলন ঘটেছে এ স্লোভেনিয়াতে এসে।

পর্যটকদের প্রথম গন্তব্য লেক ব্লেড। ছবি: লেখক

স্লোভেনিয়া এক সময় লিবারেল কমিউনিজমের ভিত্তিভূমি হিসেবে পরিচিত সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অংশ ছিল। ১৯৯১ সালের ২৫ জুন প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভিয়ার জোট থেকে বের হয়ে আসে এবং নিজেদেরকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু, ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়া সে সময় স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার এ দাবির স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ। স্লোভেনিয়ার এ স্বাধীনতা যুদ্ধ ১০ দিন স্থায়ী হওয়ায় একে ১০ দিনের যুদ্ধ নামেও অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল ইউরোপ মহাদেশের প্রথম যুদ্ধ। এতে ৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটে।

স্লোভেনিয়াকে তাই অপেক্ষাকৃত নতুন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিলেও ভুল হবে না। এ কারণেই হয়তো দেশটি এখনও সবার কাছে সেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। তবে সম্প্রতি দেশটির পর্যটন শিল্প নতুন মাত্রা পেয়েছে। সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, বিভিন্ন হ্রদ ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি ইতোমধ্যে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

ব্লেড ক্যাসেল থেকে লেক ব্লেড ও আশেপাশের স্থানের দৃশ্য। ছবি: লেখক

হাঙ্গেরির সীমানা পেড়িয়ে যখন স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করা হয় তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে সুউচ্চ পর্বতমালা। এর সৌন্দর্য এক কথায় অসাধারণ। স্লোভেনিয়াকে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করলেও ভুল হবে না। কারণ, সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে স্লোভেনিয়ার ভূ-প্রকৃতির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। আল্পস পর্বতমালা বিধৌত দুটি দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রায় একই ধরনের। যদিও, স্লোভেনিয়া সুইজারল্যান্ডের মতো এত ব্যয়বহুল নয়।

লেক ব্লেড এবং পোস্তয়ানা কেভ— এ দুটি স্থান পরিদর্শনের জন্য বর্তমানে স্লোভেনিয়াতে সবচেয়ে বেশি মানুষের সমাগম হয়। তাই, স্লোভেনিয়াতে আসার পর প্রথমে যে স্থানটি পরিদর্শনের জন্য আমার মাঝে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ কাজ করছিল, সেটি হচ্ছে লেক ব্লেড। এ পর্যন্ত কয়েকবার লেক ব্লেড ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তবে, গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারির ভ্রমণটা ছিল একটু আলাদা। ২৯ ফেব্রুয়ারি 'লিপ ডে' হিসেবে পরিচিত। কারণ, প্রতি চার বছর পর পর এ দিনটি আসে। সেদিনের এ সফরটি ছিল দিনটিকে বিশেষভাবে রাঙিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। লেক ব্লেডের পাশাপাশি বাড়তি পাওনা হিসেবে ছিল লেক বোহিনি এবং স্লোভেনিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ট্রিগলাভ দেখার সুযোগ।

স্লোভেনিয়ার উচ্চতম পর্বত ট্রিগলাভ। ছবি: লেখক

কয়েকটি দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হলেও, ইউরোপে তখনও করোনার প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডব শুরু হয়নি। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারির পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ ৪ মার্চ স্লোভেনিয়াতে প্রথম কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। করোনা মহামারি শুরুর আগে আমাদের অনেকের জীবন অনেক সুন্দর ছিল। সবকিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। জীবনের স্বাভাবিক ছন্দও বজায় ছিল। কিন্তু, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কারণে কীভাবে আমাদের জীবন তছনছ হয়ে পড়ে, তা বিশ্লেষণ করতে হলে এ ট্যুরটির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কঠিন এক বাস্তবতার সাক্ষী হয়ে আজও আমার স্মৃতিপটে বারবার ভেসে ওঠে ২৯ ফেব্রুয়ারির কথা।

এক্সচেঞ্জ স্টাডি সম্পন্ন করতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর আগমন ঘটেছে। তাদের মধ্যে তিন জন ছিলেন আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভ, ভালেরিয়া কর্টুন ও নূরানা গাম্বারোভা । ডরমিটরিতে এ তিন জন ছিলেন আমার প্রতিবেশী। একসঙ্গে  আমরা এক সেমিস্টার পার করেছি। লকডাউনের দিনগুলোতে যখন বাধ্য হয়ে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছিল, তখন পারস্পরিক বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে আমাদের। আলেকজান্ডার চিস্টিয়াকোভকে আমরা শাশা নামে সম্বোধন করতাম, আর ভালেরিয়া কর্টুনকে ডাকতাম লেইরা নামে। লেইরা জন্মসূত্রে ইউক্রেনের হলেও বসবাস করতেন রাশিয়ায়। শাশা ও লেইরার দুজনই রাশিয়ার রোস্টোভ অন ডন ইউনিভার্সিটির স্নাতকের শিক্ষার্থী। আর নূরানা ছিলেন আজারবাইজানের।

ব্লেড ক্যাসেলের অভ্যন্তরীণ মিউজিয়ামে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

২৯ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য আমরা লেক ব্লেড ও লেক বোহিনি ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। স্লোভেনিয়াতে গণপরিবহন সেবার মান খুব একটা ভালো না। এজন্য প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সবাই নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করেন। সরকারও গণপরিবহনের ওপর তেমন একটা জোর দেয় না। তাই গণপরিবহনের ওপর নির্ভর করে স্লোভেনিয়ার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করার সিদ্ধান্ত একরকম বোকামিই বলা চলে। যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই, তারা এক শহর থেকে থেকে অন্য শহরে যাতায়াত করতে প্রিভোজি নামের একটি কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহার করেন। তবে ব্যক্তিগত কোনো ট্যুরের কাজে প্রিভোজির ওপর নির্ভর করা যায় না। এজন্য আমরা একদিনের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। চার সিটের একটি গাড়ি ভাড়া নিতে ৮০ ইউরোর মতো খরচ হয়েছিল। জ্বালানি খরচ ছিল নিজেদের।

রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম গন্তব্য ছিল ট্রিগলাভ পর্বত। লুবলিয়ানা থেকে লেক ব্লেডের অবস্থান ৩৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এবং লেক বোহিনির অবস্থান ৫২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। ট্রিগলাভ ন্যাশনাল পার্ক স্লোভেনিয়ার একমাত্র ন্যাশনাল পার্ক। এর আয়তন ৩৪০ বর্গমাইল, যা দেশটির মোট আয়তনের শতকরা চার ভাগ। এ অঞ্চলের মূল আকর্ষণ হচ্ছে জুলিয়ান আল্পস পর্বতমালা। কথিত আছে, রোমের সম্রাট জুলিয়াস সিজার সর্বপ্রথম স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আল্পস পর্বতমালার এ অংশ আবিষ্কার করেছিলেন। এজন্য একে জুলিয়ান আল্পস নামে ডাকা হয়।

ব্লেড আইল্যান্ডের মূল আকর্ষণ হচ্ছে প্রিমিলেজ চার্চ অব দ্য অ্যাজামশন অব মারিয়া। চার্চের ভেতরের দৃশ্য এটি। মূলত একটি ক্যাথলিক চার্চ হলেও খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের আগে এই স্থানে প্যাগানদের তৈরি একটি মন্দির ছিল। ছবি: লেখক

ট্রিগলাভ ন্যাশনাল পার্কের কেন্দ্রস্থলে ট্রিগলাভ পর্বতের অবস্থান। তিন শৃঙ্গবিশিষ্ট এ পর্বতটি স্লোভেনিয়ানদের অন্যতম জাতীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি স্লোভেনিয়ার জাতীয় পতাকায়ও ট্রিগলাভ পর্বতের ছাপ রয়েছে। স্লোভেনিয়ানদের মাঝে এক ধরণের বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, কোনো মানুষ ততদিন নিজেকে প্রকৃত স্লোভেনিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না, যতদিন না তিনি ট্রিগলাভের চূড়ায় আরোহণ করেন। খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের আগে স্লোভেনিয়ার বেশিরভাগ অধিবাসী ছিলেন প্যাগান। প্যাগানদের অনেকে বিশ্বাস করতেন, ট্রিগলাভ পর্বতমালার উপরিভাগে তিন শিংবিশিষ্ট এক দানব বসবাস করে। ট্রিগলাভের তিনটি শৃঙ্গের সবচেয়ে উঁচুটি নয় হাজার ৩৯৫ ফুট। এটি স্লোভেনিয়াতে আবিষ্কৃত সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।

শীতকালে ট্রিগলাভসহ আশেপাশের পর্বতগুলো ঘন তুষারে ঢেকে যায়। তবে, গ্রীষ্মকালে হাইকিং বা মাউন্টেন ট্রেকিংয়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য অভিযাত্রী এসব পর্বতে জড়ো হন। একদিন আমিও ট্রিগলাভ পর্বতের চূড়ায় পা রাখার স্বপ্ন দেখি। তবে এজন্য ধারাবাহিক কিছু অনুশীলন প্রয়োজন।

প্লেটনা নামক কাঠের তৈরি এই বিশেষ নৌকার সাহায্যে ব্লেড আইল্যান্ডে পৌঁছানো যায়। ছবি: লেখক

স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমের অংশটি আশ্চর্য রকমের সুন্দর। পর্বতমালার পাশাপাশি স্কি রিসোর্ট ও ছোট-বড় বিভিন্ন হৃদ, জলপ্রপাত এবং নদীর উপস্থিতি স্লোভেনিয়ার এ অংশকে রূপকথার রাজ্যে পরিণত করেছে। এখানকার প্রত্যেকটি গ্রামই ছবির মতো সুন্দর। এসব গ্রামের ছোট ছোট ঘরবাড়ি এ সৌন্দর্যের প্রাণ। বব চ্যাপেক যদি কোনোদিন এ স্থানে বেড়াতে আসেন, তাহলে তিনি এখানে ডিজনি সিরিজের কোনো অ্যানিমেশন নির্মাণ করতে চাইবেন বলে আমার বিশ্বাস।

ট্রিগলাভের পর্বতশৃঙ্গ থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল লেক বোহিনি। ৩১৮ হেক্টর আয়তনবিশিষ্ট এ লেকটি স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে লেকগুলোর একটি। জুলিয়ান আল্পস পর্বতমালা সংলগ্ন বোহিনি উপত্যকায় এর অবস্থান। এটি মূলত একটি গ্ল্যাসিয়াল লেক। লেক বোহিনির প্রবেশ মুখে একটি পাথরের ব্রিজ রয়েছে। ব্রিজ ধরে হাঁটলে ছোট একটি চার্চের দেখা মেলে। এ চার্চটি আনুমানিক ৭০০ বছরের পুরনো। স্থানীয়রা একে 'চার্চ অব সেইন্ট জনস' নামে চেনেন। উত্তর-স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন অংশের মতো বোহিনিতেও চ্যামোয়া নামের এক বিশেষ প্রজাতির ছাগলের প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। চ্যামোয়া এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান এন্ডেমিক প্রাণী। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষ বাড়ার ফলে এদের সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে। এ চ্যামোয়াকে ঘিরে বিভিন্ন জনশ্রুতির প্রচলন রয়েছে।

ব্লেড ওয়াইন। ছবি: লেখক

আগেই বলেছি, অন্যান্য দেশ থেকে যেসব পর্যটক স্লোভেনিয়াতে বেড়াতে আসেন, তাদের বেশিরভাগের প্রথম গন্তব্য হয় লেক ব্লেড। অনেকখানি প্রত্যাশা নিয়ে তাই আমরা লেক ব্লেডে যাই। কিন্তু, সত্যি বলতে লেক ব্লেড আমাদের কাছে লেক বোহিনির মতো এতটা মোহনীয় লাগেনি।

স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনে বর্তমানে খুব একটা ধর্মের প্রভাব দেখা যায় না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগই মানুষই ধর্মের প্রতি সেভাবে আস্থাশীল নন। তাই বলে স্লোভেনিয়াকে নেদারল্যান্ডস কিংবা স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর মতো প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসেবেও আখ্যা দেওয়া যায় না। লেক ব্লেড স্লোভেনিয়ানদের জাতীয় প্রতীক। এটিকে মূলত খ্রিস্টান ধর্মের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ধারণা করা হয়, দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রসার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এ লেক বেল্ডকে ঘিরে। পুরো লেকটির চারদিকে একবার চক্কর দিলে প্রায় ছয় কিলোমিটারের মতো হাঁটা হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনো এক সময় সুইজারল্যান্ডের এক চিকিৎসক ব্লেডে বেড়াতে আসেন। পরবর্তীতে সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন তিনি। তিনিই মূলত লেক ব্লেডকে দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।

মধ্যযুগে ব্লেড ক্যাসেলের ভেতরে সৃষ্ট জনবসতির নিদর্শন। ছবি: লেখক

লেক ব্লেডের ঠিক মাঝখানে ব্লেড আইল্যান্ড নোমের ছোট একটি দ্বীপ রয়েছে। ব্লেড আইল্যান্ডের মূল আকর্ষণ হচ্ছে 'প্রিমিলেজ চার্চ অব দ্যা অ্যাজামশন অব মারিয়া' নামের একটি চার্চ। অনেকে আবার এ চার্চটিকে 'চার্চ অব দ্যা মাদার অব গড' নামে অভিহিত করে থাকেন। এটি মূলত একটি ক্যাথলিক চার্চ। তবে, খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের আগে এ স্থানে প্যাগানদের তৈরি একটি মন্দির ছিল। ১১৪২ সালে প্রথম এখানে একটি ইটের ক্যাথলিক চার্চ নির্মাণ করা হয়। ১৪৬৫ সালে লুবলিয়ানার প্রথম বিশপ জিগা ল্যামবার্গ চার্চটি সংস্কার করেন এবং একে মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্যশৈলীর রূপ দেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে আবারও এ চার্চটির নকশার পরিবর্তন করা হয়। এখন আমরা যেভাবে এ চার্চটিকে দেখি সেটি মূলত সে সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

চার্চের ভেতরে উইশিং বেল নামের একটি বিশেষ ঘণ্টা রয়েছে। একটি মোটা দড়ি ধরে টান দিলে ঘণ্টাটি বেজে উঠে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিশ্বাস করেন, এ ঘণ্টাটি বাজানোর পর মনের কোনো ইচ্ছা ব্যক্ত করলে তা পূরণ হয়ে যায়। উইশিং বেল নিয়ে আরও বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে।

লেক ব্লেডের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ব্লেড ক্যাসেল। ছবি: লেখক

স্লোভেনিয়ানদের চোখে লেক ব্লেড হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা। মূলত প্রেমিক-প্রেমিকারা এ স্থানে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বর্গসম পরিবেশ তাদের বিয়ের স্মৃতিকে মধুর করে তোলে। প্লেটনা নামের কাঠের তৈরি একটি বিশেষ নৌকার সাহায্যে ব্লেড আইল্যান্ডে পৌঁছানো যায়। অতীতে ব্লেডের ওপর দিয়ে স্পিড বোট থেকে শুরু করে লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযানের চলাচল ছিল। তবে পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে বর্তমানে স্লোভেনিয়ার সরকার সেখানে পেট্রোলিয়ামচালিত সব নৌযানের চলাচল নিষিদ্ধ করেছে। ব্লেড কমিউনিটির ৪০টি পরিবারই শুধু লেক ব্লেডের ওপর নৌযান চালাতে পারে। প্লেটনা থেকে আইল্যান্ডে নেমে ৯৯টি পাথরের সিঁড়ি বেয়ে এ চার্চে প্রবেশ করতে হয়।

চার্চের পাশাপাশি ব্লেড আইল্যান্ডের ভেতরে ৫২ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি দুর্গ রয়েছে। এ ছাড়া, সৌখিন কিছু মানুষের বসতিও রয়েছে সেখানে। লেক ব্লেডের উত্তর-পূর্ব বরাবর রয়েছে ব্লেড ক্যাসেল। আনুমানিক ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রাজা দ্বিতীয় হেনরির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিক্সেনের বিশপ আলবুইনের নেতৃত্বে প্রথম এ দুর্গটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ব্রিক্সেনের কোনো বিশপই কখনো সেখানে বসবাস করেননি। তবে প্রতিরক্ষার কাজে দুর্গটি ব্যবহার করা হতো। আলবুইনের হাত ধরে আধুনিক কালের ব্লেড কমিউনিটির গোড়াপত্তন ঘটে। এক সময় পুরো ব্লেড কমিউনিটির শাসনভার বিশপদের হাতে ন্যস্ত ছিল এবং তারা জনসাধারণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতেন। মধ্যযুগে এ দুর্গটি সংস্কার করা হয় এবং এর ভেতরে অতিরিক্ত কয়েকটি টাওয়ার যোগ করা হয়। দুর্গের ভেতর এক সময় জনবসতি গড়ে উঠেছিল।

গোল্ড হর্ন চ্যামোয়ার সামনে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ব্লেড ক্যাসেলের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে ১৩ ইউরো দিয়ে আলাদাভাবে টিকেট কিনতে হয়। তবে, শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা ডিসকাউন্ট রয়েছে। ক্যাসেল থেকে জুলিয়ান আল্পস পর্বতমালা বেষ্টিত লেক ব্লেডের এক অসাধারণ দৃশ্য অবলোকন করা যায়। এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিভিন্ন সময় ব্লেডে বসবাস করা জনসাধারণের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে পুরো ক্যাসেলটিকে সাজানো হয়েছে।

ভোজনরসিকদের জন্য ব্লেডের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সেখানকার ক্রিম কেক। এটি বেশ বিখ্যাত। আর যারা অ্যালকোহলিক বেভারেজের স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্য রয়েছে ব্লেড ওয়াইন। স্থানীয় পর্যটকদের চোখে অবশ্য ব্লেডের চেয়ে বোহিনি বেশি সুন্দর। তাই, যখন আমরা বোহিনিতে পা রাখি তখন বিদেশি পর্যটকের দেখা তেমন না পেলেও, স্থানীয় পর্যটক ছিল অনেক। আর ব্লেডে লোকাল ট্যুরিস্টের তুলনায় বিদেশি পর্যটকের দেখা পেয়েছি বেশি।

দুটি লেকই আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। চারদিকে বরফে ঢাকা সবুজ পাহাড় এবং লেকের স্বচ্ছ জলরাশি প্রকৃতি প্রেমী যে কোনো মানুষের চিত্ত হরণ করতে বাধ্য। করোনার আগের স্বাভাবিক বিশ্বে এটিই সর্বশেষ স্মৃতি, যা আমাদের সবাইকে প্রশান্তি দিয়েছিল। আর সেদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি হওয়ায় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বাড়তি মাত্রা পেয়েছিল। এরপর এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। পুরো পৃথিবী আজ করোনার ভয়াল থাবার আঘাতে পর্যদুস্ত। তবু, মানুষ বাঁচে আশায়। হয়তো একদিন পৃথিবী থেকে করোনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং সবকিছু আগের রূপে ফিরে আসবে। সেদিন এভাবে আবার বেড়িয়ে পড়ব নতুন কোনো স্থানের সন্ধানে। আমিও তো এ বিশ্ব জগৎটাকে আপন হাতের মুঠোয় পুরে দেখতে চাই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

8h ago