ইতিহাসের দুঃসাহসিক মহাকাব্য: ২২৪ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ায় বাঙালির পদচিহ্ন
ব্রিটিশ নাবিক জেমস কুক ১৭৭০ সালে আদিবাসীদের পরাস্ত করে অস্ট্রেলিয়া দখল করেন। এর মাত্র ২৭ বছর পর স্কটিশ ব্যবসায়ী উইলিয়াম ক্লার্কের সঙ্গে ১২ জন বাঙালি আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থাৎ আজ থেকে ২২৪ বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগর তীরের ভূমিতে বাঙালির প্রথম পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়েছিল। তাদের গন্তব্য ছিল সিডনি। নতুন গড়ে ওঠা সিডনি শহরে তখন লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০০ জন। বর্তমানে সিডনির জনসংখ্যা ৫০ লাখ।
উইলিয়াম ক্লার্কের সফরসঙ্গী হিসেবে ১২ জন বাঙালি ছাড়াও ছিলেন ৪ জন ব্রিটিশ। ১৭৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা কলকাতা থেকে একটি জাহাজ নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখন চট্টগ্রাম থেকে অনেক বাঙালি কলকাতা গিয়ে জাহাজে কাজ করতেন। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্য থেকে ৯০ মাইল দূরের একটি সমুদ্র সৈকতের কাছে তাদের জাহাজটি প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে। ১৭৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের জাহাজটি ঝড়ে বাস স্ট্রেটের ফার্নাক্স দ্বীপপুঞ্জে ধ্বংস হয়। তারা সাঁতার কেটে একটি দুর্গম ছোট দ্বীপে আটকা পড়েন। ওই দ্বীপটি সিডনি থেকে ৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। বেঁচে যাওয়া ১৭ জন হেঁটে সিডনির দিকে রওনা হন।
২৭ বছর বয়সী স্কটিশ বণিক উইলিয়াম ক্লার্ক তাদের বিপজ্জনক যাত্রার দৈনিক বিবরণ ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।
অস্ট্রেলিয়া অভিযানের দুই বছর পর ক্লার্ক কলকাতায় ফিরে যান এবং কয়েক বছর পর সেখানে তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে ক্লার্ক কলকাতার এশিয়াটিক মিররের একজন সাংবাদিককে তার ডায়েরি দেখান। ৬০০০ শব্দের ওই ডায়েরিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিপুল আলোচিত হয়। উন্মোচিত হয় ইতিহাসের অলিখিত এক মহাকাব্য। কারণ উইলিয়াম ক্লার্কের আগে আর কেউ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অস্ট্রেলিয়া অভিযানের মতো এমন দুঃসাহস দেখাতে পারেনি।
ক্লার্কের প্রকাশিত ওই ডায়েরি ইতিহাসে 'উইলিয়াম ক্লার্ক জার্নাল' হিসেবে খ্যাত।
তার প্রতিদিনের ভ্রমণলিপি থেকে জানা যায় অসামান্য ও দুঃসাহসিক এক অভিযানের রোমহর্ষক গল্প।
উইলিয়াম ক্লার্ক তার সঙ্গীদের নিয়ে নির্জন, দুর্গম আর লোকালয় বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে সিডনিকে সামনে রেখে হাঁটতে শুরু করেন। এমন করে বেঁচে থাকার গল্প অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে আর নেই। ধু ধু সৈকত, বিস্তৃত পাহাড়, বিশাল গিড়িখাদ, শক্ত পাথর পাড়ি দিয়ে তারা ৯০ কিলোমিটার হাঁটার পর যখন ভগ্ন ক্লান্ত হয়ে লেক এন্ট্রান্স এবং লেক টায়ারের কাছে এসে পৌঁছান তখন ১৪ জন আদিবাসীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। ক্লার্ক তার জার্নালে উল্লেখ করেছেন, আদিবাসীদের সঙ্গে আপোষ করা এবং তাদের সাহায্য নেয়া ছাড়া বেঁচে থাকার অন্য আর কোনো পথ তাদের ছিল না।
আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের আলোচনা ও মতবিনিময়ই তাদের বাঁচিয়েছিল। আদিবাসীরা তাদের খাদ্য সংগ্রহ, ঘুমানোর জায়গা এবং পথের দিক নির্দেশনা দিয়েছিল। এটিই ছিল তখনকার অস্ট্রেলিয়াতে প্রথমবারের মতো আদিবাসীদের সঙ্গে ইউরোপিয়ানদের দীর্ঘ সময়ের সহাবস্থান।
ক্লার্ক লিখেছেন, আদিবাসীরা তাদের পোশাক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করতো। তাদের হাত, নখ এবং পা স্পর্শ করে দেখতো। আদিবাসীদের শরীরে কোনো পোশাক ছিল না।
প্রথম সপ্তাহগুলোতে তারা প্রতিদিন প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেন। যখন তাদের কোনো বড় নদী পাড় হবার প্রয়োজন হতো তখন আদিবাসীদের সাহায্য নিয়ে গাছের বড় বড় গুঁড়ি দিয়ে ভেলা বানিয়ে নদী পাড় হতেন। কখনো কখনো তিন দিন ধরে এই ভেলা বানাতে হতো। তখন তারা গহীন জঙ্গলে আদিবাসীদের সঙ্গেই ঘুমাতেন। প্রথম দিকে তাদের কয়েকটি ভেলা নদীতে ডুবেও যায়।
আদিবাসীরা তাদের গাইড হিসেবে ছিল পুরো যাত্রা পথে। কোথায় থামতে হবে, কোন নদীর পানি খাওয়া যাবে, কোন জঙ্গলে হিংস্র পশু আছে এসব বিষয়ে আদিবাসীরা তাদের নির্দেশনা দিতো। দীর্ঘ প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জারভেস বে পর্যন্ত আসার পর আদিবাসীদের সঙ্গে ক্লার্কদের একটি সংঘর্ষ হয়। ক্লার্কের বর্শার আঘাতে কয়েকজন আদিবাসী নিহত হলে ক্লার্করা নিজেদের মতো চলতে শুরু করেন। আদিবাসীরাও ক্লার্কের কয়েকজন সঙ্গীকে হত্যা করে। আদিবাসীদের ছাড়া চলতে গিয়ে তারা খুব সহজেই ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়তেন। কারণ তাদের জানা ছিল না, কোথায় খাবার ও পানযোগ্য পানি আছে। পথে অনাহারে আরও কয়েকজন মারা যায়।
দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে হাঁটার পর তারা সিডনি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ওয়াটামোল্লা সমুদ্র সৈকতে অর্ধমৃত অবস্থায় মাত্র তিনজন এসে পৌঁছান। তারা এতোটাই দুর্বল ছিলেন যে, সমুদ্র সৈকতে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হচ্ছিল। তখন একজন মৎস্য শিকারী তাদের উদ্ধার করেন। জীবিত তিন জনের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। তার নাম জার্নালের কোথাও উল্লেখ করেননি ক্লার্ক। তবে তার অন্য সঙ্গীর নাম ছিল হিউ থম্পসন।
জীবনের এক কঠিনতম ঝুঁকি নিয়ে একজন বাঙালি এবং দুজন ইউরোপিয়ান সিডনির দিকে এগুতে থাকেন।
অবশেষে ১৭৯৭ সালের ১৫ মে তারা সিডনি এসে গভর্নর জন হান্টারের সঙ্গে দেখা করেন। হান্টার ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় গভর্নর (১৭৯৫-১৮০০)। তিনি দুঃসাহসিক দুজন ইউরোপিয়ান এবং একজন বাঙালিকে সিডনিতে স্বাগত জানালেও তেমন খুশি হতে পারেননি। তিনি মনে করেছিলেন, এভাবে ব্যক্তি অভিযান ব্রিটিশ রাজের অহংকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে।
উইলিয়াম ক্লার্কের অসামান্য দুঃসাহসিক সফরের সঙ্গী ওই বাঙালি সম্পর্কে ইতিহাসে আর কোনো তথ্য না থাকলেও প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে তার দীপ্ত পদচিহ্ন প্রতিটি বাঙালির কাছে গর্বের।
আকিদুল ইসলাম: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক
Comments