আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস: অভিবাসনে খরচ বেশি, বেতন কম

একটি চাকরির জন্য গত বছর সৌদি আরবে শহীদুল মিয়ার (ছদ্মনাম) খরচ হয়েছে ৪ লাখ টাকার মতো।
স্টার ফাইল ফটো

একটি চাকরির জন্য গত বছর সৌদি আরবে শহীদুল মিয়ার (ছদ্মনাম) খরচ হয়েছে ৪ লাখ টাকার মতো।

মুন্সিগঞ্জের ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক টাকার একটি অংশ ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে এবং বাকিটা স্থানীয় মধ্যস্ততাকারীকে মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে দিয়েছিলেন।

রিয়াদে নির্মাণ খাতের চাকরি থেকে তিনি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পান।

শহীদুলের মতো বিদেশে যেতে অনেক খরচ করা ও কম বেতন পাওয়া মানুষ এ দেশে বিরল নয়। অভিবাসনের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতেই অনেকের বছরের পর বছর সময় লেগে যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর 'কস্ট অব মাইগ্রেশন সার্ভে-২০২০' অনুসারে, বাংলাদেশি কর্মীরা অভিবাসনের জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ করেন, তা উঠে আসতে গড়ে প্রায় দেড় বছর লাগে।

পুরুষ কর্মীদের জন্য এই সময় দেড় বছরের বেশি ও নারীদের জন্য প্রায় ৬ মাস।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান এ ব্যাপারে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে অভিবাসন ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একজন বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী যা আয় করেন, তা সবচেয়ে কম।'

ওয়ার্কিং ভিসার বেশি চাহিদার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন শরিফুল।

বিবিএসের সমীক্ষা বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অভিবাসীদের আনুমানিক গড় নিয়োগ খরচ ছিল ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সির সার্ভিস চার্জ ও বিমান ভাড়াসহ পাসপোর্ট, চিকিৎসা ও ভিসা ফি অন্তর্ভূক্ত আছে।

এ সময়ের মধ্যে সিঙ্গাপুরে অভিবাসনের জন্য খরচ হয়েছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া সৌদি আরবের জন্য ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, মালয়েশিয়া ও কাতারের জন্য ৪ লাখ টাকার কিছু বেশি এবং ওমানের জন্য ৩ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে একেকজন অভিবাসীর।

এটি ২০১৭ সালে ১৪ টি দেশে অভিবাসনে পুরুষ কর্মীদের জন্য সরকার নির্ধারিত খরচের পুরোপুরি বিপরীত। এর মধ্যে রাশিয়ায় অভিবাসনে নির্ধারিত খরচ ছিল সবচেয়ে বেশি। আর সবচেয়ে কম ৯৭ হাজার ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল বাহরাইনে যাওয়ার জন্য।

বিবিএসের সমীক্ষায় উল্লিখিত উচ্চ অভিবাসন খরচের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের। তিনি বলেন, "এটা হতে পারে…কিন্তু আমাদের কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই।'

বিবিএসের জরিপে দেখানো হয়, বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশি কর্মীদের গড় মাসিক মজুরি ২৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে একজন পুরুষ অভিবাসীর গড় মজুরি ২৭ হাজার ও নারী অভিবাসীর গড় মজুরি ১৮ হাজার টাকা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) একটি বুলেটিনে বলা হয়, কুয়েতে একজন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকের নিয়োগ খরচ পুনরুদ্ধারে তার প্রায় ৯ মাসের উপার্জন লাগে। বিপরীতে সেখানে একজন ভারতীয় অভিবাসী শ্রমিকের ৩ মাসেরও কম উপার্জনের দরকার হয়।

এদিকে কাতারে নিয়োগ খরচ উঠিয়ে আনার জন্য একজন ভারতীয় শ্রমিকের ২ মাসের বেশি উপার্জনের দরকার হয়, একজন ফিলিপিনো শ্রমিকের ১ মাসের কিছু বেশি এবং একজন নেপালি শ্রমিকের ৩ মাসের বেশি উপার্জনের প্রয়োজন হয়।

বুলেটিনে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ফিরে আসা স্বল্পদক্ষ অভিবাসীরা মাসে ২৬৫ ডলার থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত আয় করেছে। নিয়োগের খরচ ফিলিপিনোদের জন্য ছিল ৪০০ ডলার, আর পাকিস্তানিদের জন্য ৪ হাজার ডলার।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশে অভিবাসন খরচ বাড়ার কারণ ভিসা বাণিজ্য। তারা বলছেন, কর্মী পাঠানো ও নিয়ে আসার সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু মধ্যস্ততাকারী ওয়ার্কিং ভিসা ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত, যা আদতে নিষিদ্ধ।

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, অভিবাসীদের অধিকার আদায়ে কাজ করা সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসন ব্যয় কমানোর দাবিতে সোচ্চার থাকলেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। কারণ এই ধরনের অপকর্মে জড়িত বেশিরভাগ নিয়োগকারী সংস্থাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

তিনি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মীরা দালাল অথবা মধ্যস্থতাকারীদের টাকা দেন। যারা রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে কাজ করেন।

শাকিরুল বলেন, এ অবস্থায় একজন মধ্যস্বত্বভোগী একজন শ্রমিকের কাছ থেকে কত টাকা নেবেন তার কোনো জবাবদিহি নেই।

অভিবাসন খরচ কমাতে শাকিরুলের পরামর্শ হলো, সরকার এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারে, যার মাধ্যমে নিয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়োগের খরচ প্রদান করা হবে। পরবর্তীতে কর্মীরা সরকারকে টাকা পরিশোধ করবে। তিনি বলেন, এভাবে কর্মীদের উচ্চ অভিবাসন ব্যয় কমে আসবে।'

এদিকে 'ভিসা বাণিজ্যের' প্রসঙ্গে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসানের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশের একার পক্ষে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব না। এ জন্য শ্রম গ্রহণকারী দেশগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।

এ ছাড়া রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকারকে 'আসল' অভিবাসন ব্যয় বের করার পরামর্শও দেন শরিফুল। তিনি আরও বলেন, যদি শ্রমিকদের দক্ষতার উন্নয়ন করা যায়, তাহলে তা অভিবাসন ব্যয় কমাতে সাহায্য করবে।

এ বিষয়ে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) অধুনালুপ্ত কমিটির মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমানের ভাষ্য, সরকারের বেঁধে দেওয়া খরচে বিদেশে কর্মী পাঠানো সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, যখন এই ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল তখন দুবাইয়ের বিমান ভাড়া ছিল ১৫০ ডলার (প্রায় ১২ হাজার ৮৯১ টাকা) ও সৌদি আরবের ৩০০ ডলার (প্রায় ২৫ হাজার ৮০০ টাকা)। এখন ওই একই রুটের ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ হাজার ও ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার মধ্যে।

অভিবাসন খরচ কমিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নোমান শ্রমিকদের জন্য ২৫০ ডলার থেকে ৩০০ ডলারের মধ্যে 'শ্রমিক বিমানভাড়া' চালুর পরামর্শ দেন।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

4h ago