পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটানোর অভিযোগ শাবিপ্রবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের নিয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কোনো চিন্তা নেই। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের নিয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কোনো চিন্তা নেই। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আছে কি না। প্রশাসন কেন শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে দমন-পীড়ন করে সে বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খানের সঙ্গে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা সমস্যা। কোথাও ডাইনিংয়ের টাকা নিয়ে এমন চাপ দেয় যে প্রফেসর মারা যায়। কোথাও আটক করে। এই সমস্ত ব্যাধির একটাই কারণ আমি দেখি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংসদ নেই। ছাত্র সংসদগুলো থাকলে দুটো জিনিস ঘটে, প্রথমত, সেখানে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো থাকে, তারা সাংস্কৃতিক চর্চা করে। সংস্কৃতির বিকাশ হয়। এটা না থাকলে সেটা বস্তির মতো হয়ে যায়। দ্বিতীয় যেটা হয়, ছাত্র সংসদ থাকলে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। তাদের কর্তৃত্ব থাকে, লিডারশিপ থাকে। প্রশাসন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে।'

'আমি যেটা মনে করি ছাত্র সংসদগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ১৯৯১ সালের পর থেকে এই জিনিসটা নেই। এই জন্য যেটা হয়, একটা বস্তির মতো হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়। বস্তিতে যেরকম হানাহানি হয়, বস্তির মালিক যেমন ব্যবহার করে। এখানে সে ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক।'

'বিশ্ববিদ্যালয় একটা একাডেমিক জায়গা। সেখানে একাডেমিক কাজ হবে। সাংস্কৃতিক চর্চা হবে। কোনো সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। সেখানে কোনো গান, কোনো নাটক, কোনো ডিবেট নেই, বার্ষিক নির্বাচনগুলো এক ধরেনের ফেস্টিভ্যাল। সেখানে শিক্ষার্থীরা নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করে এবং সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব তৈরি হয়। সেটা না থাকার ফলে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রশাসন তাদের ভয় করে। তাদের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। তাদের বিরুদ্ধে গেলে খুলনাতে যে ঘটনা হলো, ওই রকম ঘটনা ঘটে।'

'এ সব ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিবছর নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অনেকে এটাকে খারাপ মনে করতে পারে, সেটা মোটেও খারাপ না।'

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষার্থীদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা দুটি ভাগ দেখি। একটা ভাগ হলো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী। প্রশাসনের কাছে যাদের গুরুত্ব খুব কম। আরেকটা ভাগে ক্ষুদ্র একটা অংশ আছে, যারা সরকারি ছাত্র সংগঠন। যারা সন্ত্রাস করে, হল দখল করে কিংবা হলের সিট বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে, চাঁদাবাজি করে। এই গ্রুপটা দেখা যায়, প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় নানা সময় এই গ্রুপটাকে ব্যবহার করে তাদের সন্তুষ্ট রেখে তারা নিজেদের পদ নিশ্চিত করতে চায়। তার কারণ, সরকার চায় উপাচার্য এমন একজন লোক হোক যে অনুগত থাকবে। সরকারের যে সমস্ত পরিকল্পনা সেগুলো বাস্তবায়ন করবে।'

'এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে যেখানে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ থাকার কথা। সেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু নিয়ে কথা বললে অথবা তাদের যে সমস্ত স্বাভাবিক সমস্যা আছে, সেসব সমস্যা নিয়ে কথা বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শিক্ষকরা বিরক্ত হয়, ক্ষুব্ধ হয়, সেটাকে গুরুত্ব দেয় না।'

'অন্যদিকে সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন যখন প্রশাসনকে ব্যবহার করে, কিংবা যখন তারা কোনো অপরাধ করে প্রশাসনও চুপ মেরে থাকে। কিংবা তাদের হাতে হলের দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছে কিংবা বিভিন্ন নির্মাণ কাজে তারা চাঁদাবাজি করছে। সেগুলোতে প্রশাসনের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন তাদের সাধারণ কিছু সমস্যা নিয়ে কথা বলতে আসে, তখনই তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এই দুঃখজনক পরিস্থিতিরই একটা ভয়ঙ্কর রূপ আমরা দেখলাম যে, প্রশাসনের অনুমিত নিয়েই বা প্রশাসন পুলিশকে দিয়ে শিক্ষার্থীদের দমন করছে।'

'এটা একটা অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমস্যা থাকতে পারে। আলোচনা করবে। শিক্ষকরা যদি ঠিকমতো তাদের ভূমিকা পালন করে, ঠিকমতো চলে শিক্ষার্থীদের তো কথা না শোনার কথা না। শিক্ষকরা সেই পথে না গিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালাল। শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের আক্রমণ না, তার আগের দিন ছাত্রলীগকে দিয়ে হামলা করা হয়েছে।'

শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলাটা হয়েছে, সেটা যদি প্রশাসনের জ্ঞাতসারে না হয়ে থাকে, তাদের ইচ্ছায় না হয়ে থাকে তাহলে তো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এই ঘটনায় প্রশাসনের ইন্ধন ছিল। আগের দিন ছাত্রলীগকে দিয়ে, পরের দিন পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরিত্র হতে পারে না। অথবা উপাচার্যের ভূমিকা এটা হতে পারে না।'

'আমরা আমাদের দেশেও তো এরকম উপাচার্য দেখেছি, যে রকম উপাচার্য আমরা চাই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করেছে বলে পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্যের ভূমিকা এরকমই হওয়া উচিত।'

'উপাচার্য তো একজন শিক্ষক। উনি পুলিশ বা মিলিটারি না। সেখানে শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর যেন কোনো সন্ত্রাসী হামলা না হয়, পুলিশি হামলা না হয় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।'

'তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে সমস্যা সমাধান করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে যারা সমস্যার সমাধান করতে চায়, তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালানোর যোগ্যতা রাখে না।'

'আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সারা বাংলাদেশেই এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে যে, উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সন্ত্রাসীদের প্রতি খুব নমনীয় এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি খুব অনমনীয়। দুর্নীতিবিরোধী কোনো প্রতিবাদ হলেই তারা ক্ষিপ্ত হয়। ছাত্রলীগ-পুলিশ একাকার করে তারা এই তৎপরতা রুখতে চায়। এটা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হতে পারে না।'

অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থাকতে তো পুলিশ ক্যাম্পাসে আসার কথা না। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পিরিটের সঙ্গে এটা তো যায় না। প্রশাসনে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই থাকেন। প্রশাসনের শিক্ষকরা যখন শুধু প্রশাসক হয়ে ওঠেন, আর শিক্ষক থাকেন না তখনই এ ধরনের ঘটনা তারা ঘটাতে পারেন। প্রশাসনে যারা থাকেন, তারা যদি নিজেদের শিক্ষক হিসেবে চিন্তা করেন তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটে না।'

'সবাই তো তাদের শিক্ষার্থী। এ রকম ভাবলে এসব সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করা যায়। যে সব সমস্যা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে সেগুলোর সবই সমাধানযোগ্য। এমন তো না যে সেগুলোর সমাধান করা যায় না। এই সদিচ্ছা শিক্ষকদের নেই, কারণ তারা নিজেদের শিক্ষক মনে করে না। তারা নিজেদের প্রশাসক মনে করে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রশাসক হিসেবে তারা সেখানে কাজ করে। যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের যে দূরত্ব তৈরি হয় সেই দূরত্বের প্রকাশগুলো এভাবে ঘটে। তখন পুলিশ এসে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে।'

'শিক্ষার্থীরা দাবিগুলো মেনে নিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না। সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই একই অবস্থা। হলগুলোর ৮০ শতাংশ আসন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন দখল করে রাখে। এগুলো তাদের দখলে থাকবে কেন, হলগুলোর অনিয়ম দেখা তো প্রশাসনের দায়িত্ব। হলগুলোতে যারা প্রভোস্ট হন, তারা নিজেদের প্রশাসক ভাবেন শিক্ষক না ভেবে। যার ফলে এই ধরনের সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরও জটিল হয়ে ওঠে।'

'শিক্ষার্থীদের দাবি না মেনে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সেটি এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি করছে। সমস্যাটি এই পর্যায়ে আসার কথা না, যদিও খুব সহজেই সমাধান করা যেত শিক্ষক হিসেবে, প্রশাসক হিসেবে না। আমাদের দেশের প্রশাসকরা খুবই আমলাতান্ত্রিক এবং সমঝোতার চাইতে শক্তির ব্যবহার করতে তারা পছন্দ করে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক তো শক্তির সম্পর্ক না এটা হলো ভালোবাসার সম্পর্ক। এই ভালোবাসাটুকু না থাকলে শিক্ষকের যে নৈতিকতা সেটাই তো থাকে না।'

 

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

6h ago