রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানাগুলোতে খরচ বেশি, উৎপাদন কম

রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানাগুলো যে পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করছে, সে তুলনায় প্রত্যাশিত পরিমাণে ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে পারছে না।

রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানাগুলো যে পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করছে, সে তুলনায় প্রত্যাশিত পরিমাণে ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে পারছে না।

সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় প্রতি ৯ দিনে যে পরিমাণ গ্যাস অপচয় হয়, তা দিয়ে পুরো দেশের একদিনের বিদ্যুতের চাহিদা (প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট) মেটানো সম্ভব।

দেশের ৪টি ইউরিয়া উৎপাদনকারী কারখানা থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৯৬ লাখ টন দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু, এর জন্য প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ গ্যাস খরচ হয়েছে। উল্লেখ্য, ইউরিয়া সার উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ প্রাকৃতিক গ্যাস।

৪টি কারখানায় গড়ে ১ টন ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য ৪৩ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমসিএফ) গ্যাস প্রয়োজন হয়। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একই পরিমাণ সার উৎপাদনের জন্য ২৫ এমসিএফ গ্যাস ব্যবহৃত হওয়ার কথা। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নথি থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

বিসিআইসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কারখানাগুলো হচ্ছে—যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (জেএফসিএল), আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (এএফসিসিএল), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) ও শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (এসএফসিএল)।

কর্মকর্তারা কারখানাগুলোর উপযোগিতা কম থাকার জন্য পুরনো যন্ত্রপাতিকে দায়ী করছেন। এগুলো বহু বছর ধরে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা হয় না। এ ছাড়া, গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন এবং দক্ষ জনশক্তির অভাবের কথাও বলেছেন তারা।

৪টি কারখানার মধ্যে এএফসিসিএল, সিইউএফএল ও জেএফসিএলের ২০ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এএফসিসিএল ও সিইউএফএল এর যাত্রা শুরু হয় যথাক্রমে ১৯৮১ ও ১৯৮৭ সালে এবং জেএফসিএলের উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে।

সিলেটের এসএফসিএলে উৎপাদন মাত্র ৫ বছর আগে শুরু হলেও ইতোমধ্যে এর উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে।

অপরদিকে, এই খাতে দেশের একমাত্র বহুজাতিক অংশীদার প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী সার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সার উৎপাদন করছে।

১৯৯১ সালে কাজ শুরুর পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে কাফকো ৫ লাখ ৩০ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন করেছে এবং এর উৎপাদন ক্ষমতার অনুপাত প্রতি টনে ২৭ দশমিক ৯৭ এমসিএফ।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারি কারখানাগুলোতে উৎপাদন ক্ষমতা কম থাকার বিষয়টি বহু বছর ধরেই 'ওপেন সিক্রেট'। এই অপচয় দেশের দ্রুত কমতে থাকা প্রাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং বড় আকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে।

এই কারখানাগুলো সরকারের দেওয়া ভর্তুকির সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে এবং এর পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে বলে জানান তারা।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই ৪ প্রতিষ্ঠানের ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৩৫ কোটি টাকা, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে প্রায় ৩ গুণ বেড়ে ৬৫৯ কোটি হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানান, সরকার এ ক্ষেত্রে একটি বড় আকারের দ্বিধায় আছে।

বাংলাদেশ প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ইজাজ বলেন, 'এই জরাজীর্ণ কারখানাগুলো পুরানো মডেলের গাড়ির মতো। এর জন্য প্রচুর জ্বালানি দরকার হয়। কিন্তু নতুন গাড়ি কেনার ক্ষমতা না থাকায় আমরা তা ফেলে দিতে পারছি না। এই কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দিলে দেশে ইউরিয়া সংকট দেখা দেবে, যা সমস্যাকে আরও বাড়াবে।'

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ ৪১ হাজার টন ইউরিয়ার চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলো ৮ লাখ ৭৭ হাজার টন উৎপাদন করে, আর বাকি ১৬ লাখ টন আমদানি করা হয় বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

অধ্যাপক ইজাজ পুরনো ও জরাজীর্ণ কারখানায় সার উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, 'আমরা চাইলেও প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় বা একে কম দামে বিক্রি করতে পারব না। কারণ বিশ্বে এলএনজির দাম দিন দিন বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'কারখানাগুলোতে ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে হলে তাদের উৎপাদন খরচকে আন্তর্জাতিক এলএনজি বাজারের মূল্যের সঙ্গে তুলনা করে হিসাব করতে হবে।'

তিনি জানান, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ উপযোগিতা বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।

সিলেটের এসএফসিএলের কম উপযোগিতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এটি উপযোগিতা অনুযায়ী কাজ করছে না। কারণ এই কারখানা প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়নি।'

বিসিআইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও স্বীকার করেন, নকশায় কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তিনি জানান, এই বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে তদন্ত চলছে।

যে চক্রের কোনো শেষ নেই

সরকারের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, গত ৫ বছরে এই ৪ কারখানায় অপচয় হওয়া গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৬৭ কোটি ৭ লাখ ২৭ হাজার ২৫০ এমসিএফ বা দৈনিক ২৭ হাজার ১১০ এমসিএফ।

২০১৬ সালের পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যানে (পিএসএমপি) দেশজুড়ে এই বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১৬ সালের পিএসএমপিতে বলা হয়েছে, যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হতো, তাহলে প্রতিদিন ১৩০ মিলিয়ন এমসিএফ গ্যাস সাশ্রয় হতো, যা ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের সমতুল্য।

এই প্রতিবেদনে উপযোগিতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করা হয়, কিন্তু এ পর্যন্ত তার খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে।

গত ৫ বছরে ৬টি সরকারি সার কারখানার মধ্যে ২টি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই কারখানাগুলো থেকে মোট ৪২ লাখ ৮০ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদিত হয়েছে, আর সার্বিকভাবে উপযোগিতার হার ছিল ৩৯ দশমিক ৪২ এমসিএফ/টন।

সরকার ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বহু পুরনো পলাশ ইউরিয়া কারখানা এবং ঘোড়াশাল সার কারখানা বন্ধ করে দেয়।

উল্লিখিত ৪টি কারখানার মধ্যে শুধু শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি নিয়মিতভাবে পরিচালিত হয়। বিসিআইসি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সিইউএফএল, আশুগঞ্জ ও জেএফসিএলে যথাক্রমে ৩৫৯, ২১১ ও ২০৬ দিন সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

আশুগঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আনোয়ারুল হক জানান, তারা গত মাসে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য কারখানা বন্ধ রেখেছিলেন।

তিনি বলেন, 'এটি খুবই স্বাভাবিক, একটি ৪০ বছরের পুরনো কারখানা থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যাবে না। আমরা প্রতি ১০ বছরে একবার এর উন্নয়ন করেছি। আবারও কার্যক্রম শুরু করার জন্য আমাদের আরও ৩ মাস সময় লাগবে।'

সবচেয়ে নতুন কারখানা হিসেবে শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিতে গ্যাস ব্যবহারে কার্যক্ষমতার হার প্রতি টনে ৩৪ দশমিক ৩৩ এমসিএফ।

এই কারখানার মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) সুনীল চন্দ্র দাস জানান, মেশিনগুলো ১০০ শতাংশ লোড নিয়ে পরিচালিত হলে সেগুলোতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সার উৎপাদিত হয়। 
 
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ সক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারি এবং এই সক্ষমতা ম্যানুয়ালি বাড়ানোর কোনো উপায় নেই। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময় আমরা এমন কী ২৫ এমসিএফ/টন হারেও ইউরিয়া উৎপাদন করতে পারিনি।'

তিনি জানান, কারখানার উপযোগিতা ২২ দশমিক ৫ এমসিএফ/টন হওয়ার কথা।

নকশা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সুনীল বলেন, 'সম্ভবত নকশায় কোনো সমস্যা ছিল।'

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০২০ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার ৫ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বছরে ৫ লাখ ৮০ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতার এসএফসিএল কারখানা নির্মাণ করে।

তবে, গত ৫ বছরে এই কারখানা থেকে গড় উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন। চীনা একটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই কারখানাটি নির্মাণ করেছে।

কাফকোর পরিস্থিতি ভালো

সাড়ে ৪৩ শতাংশ সরকারি মালিকানা নিয়ে কাফকো একটি অংশিদারত্বমূলক সংস্থা। কাফকো গত ৫ বছরে ২০ লাখ ৭ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন করেছে এবং এই কারখানার সক্ষমতার হার ২৮ দশমিক ৭৬ এমসিএফ/টন।

এই কারখানার সক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

কর্মকর্তারা জানান, কাফকো সফল হয়েছে কারণ, তারা সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে।

বিসিআইসির পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) শাহীন কামাল বলেন, 'সরকার আমদানি মূল্যে কাফকোর কাছ থেকে ইউরিয়া কেনে এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার জন্য তাদের যথেষ্ট উপার্জন রয়েছে। প্রতিটি মেশিন প্রতি ১৮ মাসে একবার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত, কিন্তু ২০১০ সালের পর আমরা একবারও উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে পারিনি।'

কাফকোর ক্ষেত্রে আমদানি মূল্যে গ্যাস বিক্রি করে থাকে সরকার।

লোকসানের কারণ কি?

শাহীন কামাল জানান, তারা সরকারকে অনেক কম দামে ইউরিয়া সার বিক্রি করে।

তিনি বলেন, 'আমরা সরকারকে প্রতি টন ইউরিয়া ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম এখন প্রায় ৭২ হাজার টাকা। আমাদের কাছ থেকে প্রতি টনে সরকারের ৫৮ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়।'

তিনি পুরনো যন্ত্র ও গ্যাসের চাপ কম থাকাকে উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, 'চাইলেও ৯০-এর দশকের একটি যন্ত্র থেকে আপনি প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবা পাবেন না। আমরা উপযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু এর জন্য সময় প্রয়োজন।'

যমুনা সার কারখানার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'এই কারখানাটি প্রতিদিন চললেও বছরে ৩৩০ দিন গ্যাসের চাপ কম থাকে।'

তিনি আরও বলেন, 'এই কারখানাগুলোর অর্থনৈতিক মেয়াদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। যন্ত্রগুলো প্রায় ৩০ থেকে ৪০ বছরের পুরনো এবং আমরা এর ওপর বাড়তি চাপ দিচ্ছি। একটি মেশিনকে বন্ধ থেকে চালু অবস্থায় নিতে ৮-১০ দিন সময় লাগে এবং ৩ কোটি টাকা মূল্যের গ্যাস প্রয়োজন হয়।'

বিসিআইসি চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ ইমদাদুল হক জানান, তিনি গ্যাসের অপচয় নিয়ে কোনো প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানেন না। তিনি বলেন, 'আমরা ২২ টাকায় ১ ইউনিট ইউরিয়া উৎপাদন করি এবং তা ১৪ টাকায় বিক্রি করি। এজন্য লোকসান হয়।'

সার্বিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ইউরিয়া সার কারখানাগুলোকে সাদা হাতি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না, যার পেছনে খরচ প্রচুর, কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন নেই।
 

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments

The Daily Star  | English

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

11h ago