আন্তর্জাতিক বাজারে ঊর্দ্ধগতি, হুমকির মুখে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেলের একটি চালান আমদানি করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) খরচ হতো ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় এখন সেই চালান আমদানি করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৯ মিলিয়ন ডলার।
দেশে জ্বালানি সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখতে বিপিসিকে প্রতি মাসে শুধুমাত্র ডিজেলের ৪টি চালান আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে যে হারে ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশংকা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার দর জানতে এশিয়া-প্যাসিফিক/আরব গালফ মার্কেট স্ক্যান (প্ল্যাটস- Platts) রিপোর্ট বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩ জানুয়ারি প্রতি ব্যারেল ডিজেল বিক্রি হয়েছে (ফ্রেইড অন বোর্ড-এফওবি মূল্য) ৮৭ দশমিক ৯৫ ডলার দামে। ৩ ফেব্রুয়ারি ছিল ১০৪ দশমিক ৪৭ ডলার প্রতি ব্যারেল। আর ৩ মার্চ এর দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৪ মার্কিন ডলারে।
৬ মার্চ আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম ছিল ১৩৯ দশমিক ১৩ মার্কিন ডলার। একদিনের ব্যবধানে ৭ মার্চ সোমবার এসে সেই দাম প্রায় ১৭ ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৬ দশমিক ০৩ ডলারে।
প্ল্যাটসের তথ্য মতে, বিশ্ববাজারে ১ মার্চ অকটেনের এফওবি মূল্য ছিল ১১৪ দশমিক ২৮ ডলার, ২ মার্চ দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২২ দশমিক ৫৮ ডলার এবং ৩ মার্চ ১৩০ দশমিক ৩৫ ডলার। ৪ মার্চ দাম কিছুটা কমে হয়েছিল ১২৪ দশমিক ৬৮ ডলার। আর ৭ মার্চ এসে দাম আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৪২ দশমিক ৬০ ডলার।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিজেল এবং অকটেন এ দুটি জ্বালানি পণ্যে বিপিসির দৈনিক ক্ষতি ৬২ কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি আমরা। এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দৈনিক ২ বার অবগত করছি।'
বিপিসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'জ্বালানি পণ্যের মূল্য সমন্বয়ের ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো পরিকল্পনা বা প্রস্তাবনা নেই। এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিবে।'
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, শুধু ডিজেল নয়, বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরণের জ্বালানি পণ্যের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ডিজেল আমদানির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এলসি খুললেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডলার পেমেন্ট করতে হিমশিম খাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তারা আরও বলেন, আগামী এপ্রিল পর্যন্ত ডিজেল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি মাসের মধ্যেই ডিজেলের দাম ২০০ ডলারে পৌঁছাবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, অনেক দেশ জ্বালানি তেল কিনতে পারবে না।
কর্মকর্তারা জানান, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসির কাছে ২ মাসের রানিং ক্যাপিটাল থাকে। এই ২ মাসের মধ্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করে পরবর্তী মাসের জন্য বুকিং দেওয়া হয়।
গত ১৪ বছরে মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম এখন সর্বোচ্চ। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে ডিজেলের দাম সর্বোচ্চ ১৭২ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল।
বিক্রির ক্ষেত্রে বিপিসি এখন প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৮ টাকা এবং অকটেনের ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে ২৫ টাকা করে লোকসান দেওয়ায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ কোটি টাকায়।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির কারণে গত বছর ডিজেলের ব্যবহার কম হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বিভিন্ন সেক্টরে ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এই চাহিদা আরও সাড়ে ৪ লাখ বেড়ে দাঁড়াবে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে ব্যবহৃত ৬৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ লাখ মেট্রিক টন। ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল ৫ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, অকটেনের ব্যবহার ছিল ৩ লাখ মেট্রিক টন, পেট্রোলের চাহিদা ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন এবং কেরোসিন বিক্রি হয়েছে ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল। ডিজেলের ব্যবহার বেশি হওয়ায় এখন লোকসানের পরিমাণও বেশি।
গত ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজেল আমদানির ক্ষেত্রে বিপিসি ব্রেক ইভেনে ছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৯৪ ডলারের কম ছিল। ১২ জানুয়ারি ডিজেলের দাম ৯৫ দশমিক ৫৭ ডলারে উঠে আসলে বিপিসির লোকসান হওয়া শুরু করে।
এখন বিশ্ববাজারে ডিজেলের দাম দাঁড়িয়েছে ১৫৬ দশমিক ০৩ ডলার প্রতি ব্যারেল। দেশে এখন ডিজেল মজুদ আছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
Comments