অপরাধ প্রকাশ পায় ট্র্যাজেডির পর

নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অবহেলা করে মানুষের জীবনের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলে যে দুর্ঘটনা ঘটেই, রূপগঞ্জের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড তার আরেকটি উদাহরণ।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড ও বেভারেজ ফ্যাক্টরিতে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ সন্তানের ছবি হাতে এক মা। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অবহেলা করে মানুষের জীবনের চেয়ে ব্যবসায়িক লাভকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হলে যে দুর্ঘটনা ঘটেই, রূপগঞ্জের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড তার আরেকটি উদাহরণ।

এখন পর্যন্ত ৫৬টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ওই ঘটনায়। ধারণা করা হচ্ছে, আরও অনেকেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। কারখানাটির শ্রমিকদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচাইয়ের পর হয়তো আসল চিত্র সামনে আসবে।

এসব মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এতে মোটেই অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারখানাটিতে বিপর্যয় ঘটার মতো সব ধরনের উপাদানই বিদ্যমান ছিল। শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় ঘটেছেও।

আমরা এখন শুধু শোক প্রকাশ করতে পারি এবং ভবিষ্যতে আর কখনও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না— সেই আশা পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। তবে, কিছু মানুষের অমার্জনীয় উদাসীনতার কারণে এসব ভয়াবহ ঘটনার শেষ দেখতে পাচ্ছি না আমরা।

মালিকদের অবশ্যই দায় আছে। তবে এককভাবে শুধু তাদেরকেই দোষারোপ করলে চলবে না। কারখানা নিয়ন্ত্রণ, ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার তদারকি এবং আগুন ও শ্রমবিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের প্রতিটি সংস্থারই এসব মৃত্যুর দায় নেওয়া উচিত। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে সবকিছু আবার ঠিক আগের মতোই চলবে।

এসব মৃত্যুকে আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য ও ক্ষমার অযোগ্য করে তুলেছে যে বিষয়টি, তা হচ্ছে ১৬টি শিশুর হারিয়ে যাওয়া। এখন পর্যন্ত তাদেরকে নিখোঁজ হিসেবে অভিহিত করলেও, তারা মারা গেছে বলেই ধরে নিতে পারি আমরা।

এই ১৬টি শিশুকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তার ওপর শ্রম আইন অনুযায়ী যেসব কাজ শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব কাজও তাদেরকে দিয়ে করানো হতো। দৈনিক আট থেকে ১২ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে অতি সামান্য পারিশ্রমিক দেওয়া হতো তাদের। বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থা কতটা হতাশাজনক, এর মাধ্যমে তা আবারও সামনে এলো।

দেশে সামগ্রিকভাবে শিশুশ্রমের চিত্র খুবই শোচনীয়। ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের প্রায় এক দশমিক দুই মিলিয়ন শিশু ভয়াবহ ধরনের শিশুশ্রমের ফাঁদে আটকে আছে। এ সংখ্যা যে এখন আরও বেড়েছে, তা ধরেই নেওয়া যায়। বিশেষ করে মহামারিকালে যখন অনেক দরিদ্র পরিবারের আর্থিক সংকট বেড়ে চলেছে, তখন শিশু শ্রমিক বাড়ারই কথা।

বিষয়টি নিয়ে সরকারকে কথায় যতটা আন্তরিক মনে হয়, কাজের বেলায় সেই আন্তরিকতা দেখা না গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।

দেশে রূপগঞ্জের ফুড কারখানার মালিকদের মতো এমন লোভী উদ্যোক্তার অভাব নেই, যারা প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের লাভের পাল্লা ভারি করে। কিন্তু, শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে নজর না রাখার বিষয়টি তাদের অপরাধের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আগুন তিনি লাগাননি— এ ধরনের একটি  উদ্ভট কথা বলার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছেন কারখানাটির মালিক। অবশ্যই তিনি গিয়ে আগুন লাগিয়ে আসেননি। কিন্তু, প্রবেশ ও বের হওয়ার গেটে তালা দেওয়ার ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন তিনি।

এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার আশ্বাস পাওয়া যায়। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, টাকা বা যোগাযোগের সূত্র ধরে বেশিরভাগ অপরাধীই পার পেয়ে যায়। কোনোমতেই যা হওয়া উচিত না।

কারখানার মালিক ও অন্য অপরাধীদের অবশ্যই এমন অন্যায় কাজের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া এবং আহত হওয়া মানুষের দায় অবশ্যই নিতে হবে তাদের।

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

4h ago