মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে এত আইন কেন?

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বা বলা যায় তাকে দমন করে রাখার জন্য দেশে অনেক আইন আগে থেকেই আছে; এরপরও নতুন নতুন আইন কানুন পাস করার যে তোড়জোড় চলছে, তাতে কারো মনে হতে পারে সরকার যে খাতগুলোকে আটকে দেওয়া দরকার বলে ভাবছে, তার মধ্যে সবার আগে সাংবাদিকদের ‘স্থবির’ করা দরকার।
journalism1.jpg

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, বা বলা যায় তাকে দমন করে রাখার জন্য দেশে অনেক আইন আগে থেকেই আছে; এরপরও নতুন নতুন আইন কানুন পাস করার যে তোড়জোড় চলছে, তাতে কারো মনে হতে পারে সরকার যে খাতগুলোকে আটকে দেওয়া দরকার বলে ভাবছে, তার মধ্যে সবার আগে সাংবাদিকদের 'স্থবির' করা দরকার।

কিন্তু কেন? স্বাধীন গণমাধ্যম যে গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রাণশক্তি, সে কথা কেন কখনোই মেনে নেওয়া হয় না? কেন এটি স্বীকার করা হয় না, 'উন্নয়নশীল' স্তরে যে দেশগুলো যাচ্ছে, তারা শুধুমাত্র উচ্চতর জিডিপি দিয়ে সেখানে যাচ্ছে না, বরং তার সঙ্গে উচ্চতর স্তরের মানবাধিকার এবং সব ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ও আছে। শুধুমাত্র অর্থনীতিতে উন্নয়ন হলেই হবে না, সমাজেও উন্নয়ন বা অগ্রগতি আসতে হবে। উন্নয়নকে অর্থপূর্ণ হতে হলে তাকে অবশ্যই সামগ্রিক অর্থে উন্নত হতে হবে।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা বিশ্ব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবসের বিলম্বিত উদ্‌যাপন হিসেবে গত শনিবার দেশের সাংবাদিকদের সব শীর্ষ সংগঠন এবং মালিক ও সম্পাদকদের প্রতিনিধিত্বকারীরা যৌথভাবে বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যমের অবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে এই শিল্পের চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আড়িপাতা প্রযুক্তি এবং ট্র্যাকিং ডিভাইস দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করছে এবং সেটি অসহনীয় ও বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। এই বিষয়গুলো কর্মরত সাংবাদিকেরা তুলে ধরেছেন। আমাদের মফস্বল সংবাদদাতাদের মধ্যে কেউ কেউ বড় শহরের সাংবাদিকদের তুলনায় বেশি মাত্রায় নজরদারির শিকার হন। তারা আরও সরাসরি এবং আরও স্থূলভাবে হুমকি-ধমকির শিকার হন। কখনও কখনও তাঁদের খোলাখুলিভাবে বলে দেওয়া হয়, অমুক অমুক লোককে তাঁরা 'দেখতে' পারেন না এবং বিরোধী রাজনীতিবিদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁদের ডেকে পাঠানো হয় এবং তাঁদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়। কখনও কখনও, তথ্য সরবরাহকারী বা সোর্সদের ডেকে কর্মকর্তাদের সুনজরে না থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে সতর্ক করা হয়। যে লোকদের কর্তৃপক্ষ নিশানা করে বিব্রত করতে চায়, তাঁদের অনেকের ব্যক্তিগত টেলিফোন আলাপ পাবলিক ডোমেইনে মাঝে মাঝে ফাঁস হয়ে যায়। এটি প্রমাণ করে, কর্তৃপক্ষ তার সমালোচনাকারী ও বিরুদ্ধমতের লোকদের টেলিফোনে আড়ি পাতার বিশদ জাল বিছিয়ে রেখেছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে পুলিশ আটক করার পর ওই সময় তার এক নারী সহকর্মী এবং তাঁর (ওই সহকর্মীর) বাবার মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথন হয়েছিল। ওই কথোপকথনে রোজিনা ইসলাম প্রসঙ্গে কিছু মন্তব্য ছিল। সেই কথোপকথন কে বা কারা ইন্টারনেটে ফাঁস করে দেয়। রোজিনার ভাবমূর্তিকে খারাপভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে এটি ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, রোজিনা এবং তার সহকর্মী—উভয়ের ফোনই ট্যাপ করা হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কতজন সাংবাদিকের ফোনে নজরদারি চালানো হচ্ছে? আমরা অনুমান করি, অনেক সম্পাদকের ফোনগুলোও নজরদারি করা হয়। এই অপারেশন কি কারও দ্বারা অনুমোদিত? যদি হয়ে থাকে তাহলে সে কে? কোন আইনে এটা হচ্ছে? নজরদারির অধীনে থাকা ব্যক্তিদের কোন মানদণ্ডের দ্বারা বেছে নেওয়া হয়? নাকি এটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত নিভৃতির অবস্থা তাহলে কী অবস্থায় আছে? এই চর্চার অপব্যবহার সম্পর্কে কী বলা যায়? এ বিষয়ে কোনো জবাবদিহি আছে কি? ক্ষমতাসীনরা টেলিকথোপকথন ফাঁসের 'সুফল' উপভোগ করেন। যখন পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়ায়, তখন তাঁরাই এর সবচেয়ে খারাপ শিকারে পরিণত হন।

এখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে এমন কতকগুলো আইনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিচ্ছি: ১.) পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২.) ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩.) অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪.) আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫.) প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬.) প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭.) সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮.) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯.) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০.) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১.) ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড্ সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২.) (খসড়া) ম্যাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২।

মানহানির আইনটি যে কেবল অহরহ ব্যবহৃত হয়, তা-ই নয়; এই আইনটির অপব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, শুধুমাত্র মানহানির শিকার হয়েছেন এমনটি মনে করা ব্যক্তিই এই আইনে মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং একাধিক মামলা দায়ের করা যাবে না। বাস্তবে দেখা যায় উল্টোটা। দেখা যাচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই যে কেউ এই ধরনের মামলা দায়ের করতে পারে এই দাবি করে যে, 'আমার নেতার মানহানি হওয়ার কারণে আমার মানহানি হয়েছে।' এই যুক্তিতে বা এই জাতীয় যুক্তিতে মামলার আবেদন করা হচ্ছে।

ট্র্যাজেডি হলো, নিম্ন আদালত এই সব মামলা গ্রহণ করছেন এবং একাধিক জায়গায় সেই মামলা নেওয়া হচ্ছে। ফলে সাংবাদিক/সম্পাদকদের দেশের বিভিন্ন জেলায় হাজিরা দিতে এবং আদালতের শুনানিতে অংশ নিতে এবং জামিন চাইতে দেখা যায়। সৌভাগ্যবশত, মানহানির মামলার ঘটনা কমেছে। তবে এই গত পরশুও ভোরের কাগজের সম্পাদক এবং প্রকাশককে একটি সন্দেহজনক মানহানির মামলার শিকার হতে হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর এর বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। এর ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো প্রতিদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যা আমাদের সাংবাদিক এবং সম্পাদকদের টিকে থাকার জন্য সেল্ফ-সেন্সরশিপ বা স্বনিয়ন্ত্রণ অনুশীলন করতে বাধ্য করছে।

সাংবাদিক নিবর্তনের নিরন্তর অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থাগুলোর এ সংক্রান্ত অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, 'কিছু বাড়াবাড়ি' হয়ে থাকতে পারে। আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো সাংবাদিককে সরাসরি গ্রেপ্তার করা হবে না এবং প্রথমে তাঁদের তলব করা হবে। আমরা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম এবং আশা করেছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিটি থানায় এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেওয়া হবে। তবে আমাদের জানা মতে, এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায়নি।

এই মুহূর্তে, তিনটি খসড়া আইন পাইপলাইনে রয়েছে—একটি তথ্য সুরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং তৃতীয়টি মিডিয়া কর্মীদের পরিষেবার শর্তগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তথ্য সুরক্ষার জন্য যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তার অনেকগুলো ভালো দিক রয়েছে, তবে এর বিপজ্জনক অংশটি হলো এতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সমস্ত অধিকার লঙ্ঘন করে, যে কোনো উপায়ে ব্যক্তিগত উপাত্ত স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য খসড়া আইনটি শৈল্পিক সৃজনশীলতা এবং চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করে প্রণয়ন করা হয়েছে।

খসড়া আইনটি গণমাধ্যম কর্মীদের চাকরির অবস্থার উন্নতি ঘটাতে তৈরি করা হয়েছে বলে বোঝানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি ঠিক তার বিপরীত কাজটি করবে। সংবাদকর্মীদের যেসব সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ওয়েজ বোর্ড, ইত্যাদি ইতিমধ্যে বিদ্যমান আছে। সেগুলো এই খসড়ায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তবে, আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো এটি প্রতিটি জেলায় এখন পর্যন্ত বিদ্যমান নেই এমন মিডিয়া আদালতের প্রবর্তন করতে পারে।

উচ্চ স্তরের মিডিয়া আপিল আদালতে তাদের যোগ করা হবে। এই ধরনের আদালতের কাজ এবং উদ্দেশ্য আমাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট।

আমরা যারা মিডিয়াতে কাজ করি তারা বুঝতে পারছি এবং সম্পাদক, মালিক এবং কর্মরত সাংবাদিক ইউনিয়ন সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, এই আইনটি 'অসুখের চেয়েও ক্ষতিকারক ওষুধ' এর মতো এবং এটি মিডিয়াকে জটিল এবং প্যাঁচানো আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলবে।

বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিবেদন দাখিলের মতো শর্ত জুড়ে দিয়ে মিডিয়া হাউসের পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বাড়ানোর অসংখ্য বিধান রাখা হয়েছে। এটি বেসরকারি খাতে শিল্প পরিচালনার স্বাভাবিক ধরনের সম্পূর্ণ বিপরীত।

মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিবর্তনের সময় এসেছে। গণমাধ্যমকে সব সময় 'শত্রু' হিসাবে দেখার, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার বা অন্ততপক্ষে নজরদারিতে রাখার পরিবর্তে এটিকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের 'মিত্র' হিসাবে দেখা উচিত।

আমি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও ইউনিয়ন নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, 'আজ বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করা কুমির ভরা পুকুরে সাঁতার কাটার মতো।' আমরা হয়তো কিছুক্ষণের জন্য এই কুমিরগুলোর চারপাশে সাঁতার কাটতে পারব, কিন্তু কখন যে তাদের কেউ এসে আমাদের কাকে গিলে ফেলবে, আমরা তা জানি না।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার এবং সভাপতি সম্পাদক পরিষদ

দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মতামতটি অনুবাদ করেছে প্রথম আলো। পাঠকদের জন্য তা প্রকাশ করা হলো।

Comments