প্রতিশ্রুতি যেন প্রবঞ্চনায় পরিণত না হয়

‘নজিরবিহীন’ শব্দটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্ভবত এখন আর প্রযোজ্য না। কারণ এ দেশে এখন সবকিছুরই নজির তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা ঘটল, যা ঘটার কথা না। আন্দোলন সূচনার প্রসঙ্গে আসার আগে অনশন ভাঙানোকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, সে বিষয়ে কিছু কথা-প্রশ্ন।

'নজিরবিহীন' শব্দটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সম্ভবত এখন আর প্রযোজ্য না। কারণ এ দেশে এখন সবকিছুরই নজির তৈরি হয়ে যাচ্ছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা ঘটল, যা ঘটার কথা না। আন্দোলন সূচনার প্রসঙ্গে আসার আগে অনশন ভাঙানোকে কেন্দ্র করে যা ঘটল, সে বিষয়ে কিছু কথা-প্রশ্ন।

১. 

ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ২৬ জানুয়ারি রাত ৩টায় শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে অনশন-আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে পৌঁছান। তিনি সিলেটে যাচ্ছেন, গণমাধ্যমে সেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শাবিপ্রবির শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির তা না জানার কথা নয়। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার আগে ড. জাফর ইকবাল ও ড. ইয়াসমীন হকের বাসায় গিয়ে সরকারের 'উচ্চ পর্যায়ের' নীতিনির্ধারকরা আলোচনা করেছেন। এই তথ্যও রাজনীতিক কাম শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু রাত ৩টায় বা অনশন ভাঙানোর সময় শাবিপ্রবির কোনো শিক্ষক উপস্থিত থাকলেন না। অথচ তাদের শিক্ষার্থীরা ১৬৩ ঘণ্টা অনশনে ছিলেন।

২. 
শাবিপ্রবির শিক্ষকদের কয়েকজন 'মর্নিং ওয়াকে' বেরিয়েছিলেন। তখন ড. জাফর ইকবালের সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে। অনশন ভাঙানো উপলক্ষে কেউ আসেননি। শিক্ষকদের কয়েকজন অবরুদ্ধ উপাচার্যের জন্যে রাতের খাবার নিয়ে এসেছিলেন। শিক্ষার্থীরা তাদের উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকতে দেননি। তবে পুলিশের মাধ্যমে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। শিক্ষকরা যখন উপাচার্যের খাবার নিয়ে এসেছেন তার কয়েক ঘণ্টা আগে ক্যাম্পাসের ভেতরের সবগুলো খাবারের দোকান পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল। যে দোকানগুলো ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খাবারের উৎস। শিক্ষার্থীদের খাবারের অর্থ যোগান দেওয়া সাবেক ৫ জন শিক্ষার্থীকে আগের রাতে আটক করে পুলিশ। শিক্ষকরা যখন উপাচার্যের জন্যে খাবার নিয়ে এসেছেন, তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অভুক্ত। শিক্ষার্থীদের কথা শিক্ষকরা ভাবেননি। খাবারের দোকান বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে তারা কোনো কথা বলেননি। অনশনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা একটি কথাও বলেননি তা নিয়ে। এসব পুলিশি কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তথা উপাচার্যের চাওয়া বা পরামর্শ ছাড়া হয়নি।

৩. 
ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি লেখা লিখেছেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সিলেটে গিয়ে অনশন ভাঙিয়েছেন। একজন দায়িত্ববান সংবেদনশীল শিক্ষকের কাজ করেছেন। মার্জিত ভাষায় উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনকে 'দানব' হিসাবে পরিচিতি দিয়েছেন। তিনি নিজে আন্দোলনকারীদের ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন, সাবেক ৫ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। পুলিশি নিপীড়ন নিয়ে কথা বলেছেন জাফর ইকবাল। পুলিশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে—শতভাগ বিনা প্রয়োজনে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, 'পুলিশ বাধ্য হয়েছে'। যা প্রমাণ করে, ফরিদ উদ্দিনের নির্দেশেই পুলিশ পিটিয়েছে, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়েছে।

৪. 
ড. জাফর ইকবাল পুলিশের আচরণকে নিষ্ঠুর, অমানবিক বলেছেন। উপাচার্যের নির্দেশে পুলিশ শিক্ষার্থীদের পেটাল, সেটা তো পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল। কিন্তু আন্দোলনে সহায়তাকারী সাবেক ৫ শিক্ষার্থীকে আটক করল কার নির্দেশে? মামলা দেওয়ার নির্দেশ কে দিলেন? চিকিৎসাসেবা ও ক্যাম্পাসের সব খাবারের দোকান বন্ধ করে দিল কার নির্দেশে? স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, এসব নির্দেশ শুধু উপাচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নয়। সরকারের নির্দেশনা ছাড়া পুলিশ বিকাশ-রকেট বা নগদ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারত না। সাবেক শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও মামলা দিতে পারত না। সুতরাং আলোচনা যদি 'পুলিশ করেছে', 'উপাচার্য করেছের' মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে মূল সমস্যাটা অন্তরালেই থেকে যাবে। ড. জাফর ইকবাল যখন দায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, তখন তার মুখ থেকে এসব প্রসঙ্গে বক্তব্য প্রত্যাশিত।

৫. 
পুলিশি নিপীড়নের সময় বা পরে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়নি শাবিপ্রবির শিক্ষক, শিক্ষক সমিতি। যদিও শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির বিবৃতিটি মোটামুটি গঠনমূলক ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক একটি বিবৃতি দিয়ে আলোচনায় আসে। তারা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে 'তৃতীয় পক্ষ' এবং 'সরকারবিরোধী আন্দোলন' হিসাবে দেখেছে। প্রথমত তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী-বিক্ষুব্ধ মনোভাব বোঝার চেষ্টা না করে বায়বীয় 'তৃতীয় পক্ষ' খুঁজে শিক্ষকসত্তার প্রতি সুবিচার করেননি। দ্বিতীয়ত যদিও এই আন্দোলন সরকারবিরোধী নয়। তবুও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যদি সরকারবিরোধী হয়েও থাকে, তা দেখার দায়িত্ব ঢাবি শিক্ষক সমিতিকে কে দিল? আন্দোলন সরকারবিরোধী হলে শিক্ষক সমিতির সমস্যা কী? শিক্ষার্থীরা সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে পারবেন না, এমন কোনো নিয়ম তো নেই। যদি সরকারবিরোধী আন্দোলন করে, তা দেখবে সরকার। শিক্ষক সমিতি কেন? ঢাবি শিক্ষক সমিতিকে সেই দায়িত্ব কে দিল?

৬. 
বাংলাদেশের অন্য সব পেশার মতো শিক্ষকতা পেশাও রাজনীতি দ্বারা কলুষিত। শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষকরা নিজেদের আরও বহু নিচে নামিয়ে নিলেন। বিশেষ করে, শাবিপ্রবির কয়েকজন শিক্ষক যেভাবে শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে মানববন্ধন করলেন, তা ছিল চূড়ান্ত রকমের দৃষ্টিকটু। তাদের শিক্ষার্থীদের পুলিশ পেটাল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে আহত করল। তা নিয়ে শিক্ষকদের কোনো প্রতিবাদ থাকল না। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের 'অসম্মান করেছে' কল্পিত অভিযোগ এনে মানববন্ধন করলেন। সম্মান ফেরত চাইলেন। শিক্ষার্থীদের মনোজগতে আঘাত দিয়ে সম্মান হারিয়ে, গেটের বাইরে মানববন্ধন করে তা ফেরত পাওয়া যায়! শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা কোন পর্যায়ে গেল ফুটবলে 'ফরিদ' লিখে শিক্ষার্থীরা খেলতে পারে!

৭. 
দাবি পূরণ প্রসঙ্গ দিয়ে লেখা শেষ করি। বুধবার সকালে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ড. জাফর ইকবাল অনশন ভাঙিয়েছেন, সেদিন সন্ধ্যায় শিক্ষামন্ত্রীর সুর তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। শিক্ষার্থীরা সবশেষ ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করলেও, মূলত তাদের তাদের দাবি একদফা, উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণ। 'সব দাবি মানা হবে' প্রতিশ্রুতির পর শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, উপাচার্যের পদত্যাগই তো সমাধান নয়। একজন উপাচার্য গেলে আরেকজন আসবেন। তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না। হ্যাঁ, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন চলে গেলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে মনে রাখা দরকার, উপাচার্যের পদত্যাগ বা অপসারণ এবং সমস্যার সমাধান দুটি ভিন্ন বিষয়। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের চলে যাওয়া মানে দাবি পূরণ হওয়া, প্রতিশ্রুত দাবি মেনে নেওয়া। উপাচার্যকে বিদায় করেই সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে। উপাচার্যকে রেখে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

৮. 
সরকার যদি সত্যি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে সমস্যা কী—সেটা আগে অনুধাবন করতে হবে। সেই অনুধাবনের প্রথম ধাপ হবে সরকারকে 'দলীয় রাজনৈতিক নেতারূপী' শিক্ষকদের উপাচার্য বানানোর প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসা। চাকরি দিয়ে অর্থ নেওয়া, ক্যাম্পাসে না থেকে সুযোগ সুবিধা নেওয়া তথা আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে অভিযুক্ত অসৎ উপাচার্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষ, আর্থিক-মানসিকভাবে সৎ ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সংবেদনশীল শিক্ষককে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে। গণরুম, গেস্টরুম তথা হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডি গড়তে হবে সৎ-দক্ষ-যোগ্য শিক্ষকদের দিয়ে, দলীয় ক্যাডার সদৃশ্যদের দিয়ে নয়। 

পরিশেষে বলি, আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য মানুষের বড় বেশি অভাব। সেখানে সরকার একজন ড. জাফর ইকবালকে পেয়েছেন, এটা সৌভাগ্য। ড. জাফর ইকবালের গ্রহণযোগ্য অবস্থান আরও পোক্ত হবে, না প্রশ্নের মুখে পড়বে— তা নির্ভর করছে সরকারের প্রতিশ্রুতি পালনের ওপর। যা দেখার অপেক্ষায় দেশের মানুষ।

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

4h ago