চট্টগ্রাম বন্দর: নিরবচ্ছিন্ন সেবা চালু রাখাই চ্যালেঞ্জ

করোনা সংক্রমণের শুরুতে গত বছরের ২০ মে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয় ‘করোনায় চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম মৃত্যু’। মৃত্যুবরণ করা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী আবদুল হালিম ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে কাজ করতেন। ১৮ মে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। জ্বর ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ না থাকায় প্রথমে চিকিৎসকরা হৃদরোগে মারা গেছেন বলে জানান। কিন্তু পরিবারের অনুরোধে পরীক্ষা করে জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। এ খবর তার সহকর্মীদের কাছে পৌঁছলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার দাবিতে বন্দরের ওয়ানস্টপ সার্ভিসের কর্মচারীরা প্রায় তিন ঘণ্টা সেবাদান কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পুনরায় চালু হয় সেবাদান কার্যক্রম।
ফাইল ছবি

করোনা সংক্রমণের শুরুতে গত বছরের ২০ মে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয় 'করোনায় চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম মৃত্যু'। মৃত্যুবরণ করা চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মচারী আবদুল হালিম ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে কাজ করতেন। ১৮ মে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। জ্বর ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ না থাকায় প্রথমে চিকিৎসকরা হৃদরোগে মারা গেছেন বলে জানান। কিন্তু পরিবারের অনুরোধে পরীক্ষা করে জানা যায়, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। এ খবর তার সহকর্মীদের কাছে পৌঁছলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার দাবিতে বন্দরের ওয়ানস্টপ সার্ভিসের কর্মচারীরা প্রায় তিন ঘণ্টা সেবাদান কার্যক্রম বন্ধ রাখেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে পুনরায় চালু হয় সেবাদান কার্যক্রম।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির ঘোষণা করে সরকার। রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাসহ সব ধরনের শিল্প-কারখানা ও অফিস এতে বন্ধ রাখা হয়। তবে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থে চালু রাখা হয় চট্টগ্রাম বন্দর। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেবাদানের জন্য বন্দরের কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যেও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হন। ফলে দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেবা প্রদানের চ্যালেঞ্জ নিতে হয় বন্দরকে। মে মাসের শেষের দিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নমুনা পরীক্ষার জন্য বন্দর হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার বুথ চালু করা হয়। এর আগে, শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিআইটিআইডি এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ ছিল। ১ জুলাই বন্দর হাসপাতালে চালু করা হয় করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় আলাদা ইউনিট। নিয়োগ করা হয় চিকিৎসকসহ প্রায় ১৫০ জন নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। এরপরও মৃত্যু থেমে থাকেনি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বন্দরে কর্মরত ১৪ জনসহ ৩৭ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পোষ্য এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন। তালিকায় আছেন বন্দর হাসপাতালের উপ-প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলীও।

নিরবচ্ছিন্ন সেবাদানে সাধারণ ছুটিতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চালু রাখা হলেও বার বার পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হতে হয় বন্দরকে। সাধারণ ছুটি চলাকালীন পণ্য আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কার্যক্রম চালু না থাকায় মূলত এই সমস্যার উদ্ভব হয়। বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনার ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৯ হাজার। আমদানিকারকরা খালাস না নেওয়ায় সাধারণ ছুটির শুরু থেকেই ক্রমান্বয়ে কনটেইনারের স্তূপ জমতে থাকে। এতে ধারণক্ষমতার প্রায় পুরোটাই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী কনটেইনার হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতির চলাচলে ৩০ শতাংশ ইয়ার্ড খালি রাখতে হয়। একপর্যায়ে জাহাজ থেকে খালাস করা কনটেইনার রাখার জায়গা সংকট দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও এনবিআরসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ২৩ এপ্রিল ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার স্থানান্তরের অনুমোদন দেয় এনবিআর। ফলে উদ্ভূত সমস্যার পরিত্রাণ মিলে। তবে এনবিআর ৩০ জুন পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই সেবা চালু রাখার অনুমতি দিয়েছিল।

এরপর দ্বিতীয় দফা লকডাউনে রপ্তানিমুখী সব শিল্প-কারখানা ও পণ্য খালাসে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের অফিস চালু থাকায় বন্দর কার্যক্রমে তেমন বিরূপ প্রভাব পড়েনি। চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনার জটের কারণে আবারো আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম বন্দর। বাংলাদেশের বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়ে এসব বন্দরে গিয়ে খালাস হয়। এসব কারণে ফের পত্রিকার শিরোনাম হয় চট্টগ্রাম বন্দর। মূলত পোশাক রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় কনটেইনার সংকটের কারণে এই সমস্যার উদ্ভব হয়। রপ্তানি পণ্যের প্রায় শতভাগ হ্যান্ডলিং করা বেসরকারি আইসিডিগুলোতে রপ্তানি পণ্যের স্তূপ জমে যায়। ৬ জুলাই পর্যন্ত এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজার কনটেইনারে। সমস্যা সমাধানে ৭ জুলাই ঢাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান ও বন্দর ব্যবহারকারীরা একগুচ্ছ প্রস্তাবনা দেন। এগুলোর মধ্যে ছিল শিপিং কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে অন্য শিপিং লাইনের কনটেইনার পরিবহন, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের দেওয়া কার্গো প্ল্যান দ্রুততম সময়ে উত্থাপন। এ ছাড়া, আইসিডির সংখ্যা বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়। প্রকৃতপক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো জাহাজ ও কনটেইনার জট নেই বলেও সভায় জানান নৌপরিবহন সচিব। এসময় বলা হয়, এটি চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো সংকট নয়, এ সংকট বৈশ্বিক। কিছু শিপিং কোম্পানি ভারত হয়ে বিকল্প পথে ইউরোপে পণ্য পরিবহন করে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করে।

এখানেই শেষ নয়। একটি সংকটের সমাধান বের করতে না করতেই নতুন সংকট সামনে চলে আসে। করোনা মহামারির সংক্রমণ ঠেকাতে ঈদুল আযহার ছুটিকে কাজে লাগিয়ে লকডাউন কার্যকরের ঘোষণা দেয় সরকার। এতে আবারো শিল্প কারখানা ও বন্দর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে পুরনো কনটেইনার জট সমস্যার উদ্ভব হয়। অথচ বন্দর কর্তৃপক্ষ জটের আশঙ্কায় আমদানিকারক, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ট্রেড বডিগুলোকে সতর্ক করে চিঠিও দিয়েছিল ঈদের ছুটির আগে। তাতেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। আবারো কনটেইনারের স্তূপ জমে গেল বন্দরের ইয়ার্ডে। সমস্যা সমাধানে পুরনো পথেই হাঁটতে হয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে। এবারো এনবিআরের অনুমতিক্রমে আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার ডিপোগুলোতে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। আপাতত সমস্যার সমাধান হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর কী সমাধান হবে, তা নিয়ে ভাবার এখনই উত্তম সময়।

বিশ্বের উন্নত বন্দরগুলোতে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাস করা হয় না। জাহাজ থেকে নামানোর পর কনটেইনার সরাসরি ওয়্যারহাউজ বা আমদানিকারকের প্রাঙ্গণে পণ্য খালাস করা হয়। এতে বন্দরকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ কনটেইনারবাহী পণ্য খালাস করা হয়। অবশিষ্ট পণ্য খালাস করা হয় আইসিডি ও আমদানিকারকের ইয়ার্ডে। এই বিশাল পরিমাণ পণ্য বন্দরের ভেতরে কনটেইনার খুলে খালাস না করা হলে আরও ৩০-৪০ শতাংশ বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা যেত।

করোনা মহামারি বিবেচনায় সেবার মান নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত রাখতে হচ্ছে, পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সামনে থেকে কাজ করতে হচ্ছে। জনবলের সর্বোত্তম ব্যবহার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে, একইভাবে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার তাগাদা রয়েছে সক্ষমতা বাড়াতে। ফলে কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগুতে হচ্ছে। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ একা সাফল্য অর্জন করতে পারবে না, এগিয়ে আসতে হবে স্টেকহোল্ডারদেরও।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Hilsa remains a luxury

Traders blame low supply for high price; not enough catch in rivers even after 2-month ban

1h ago