ফোরজি কি জীবনের গতি বাড়াবে?

ফোরজি আসছে, ফোরজি আসছে—গোটা টেলিকম বা ডিজিটাল সেক্টরেই যেন আনন্দে হৈ হৈ অবস্থা।
বাংলাদেশে ফোরজি সার্ভিস

ফোরজি আসছে, ফোরজি আসছে—গোটা টেলিকম বা ডিজিটাল সেক্টরেই যেন আনন্দে হৈ হৈ অবস্থা।

ফোরজি’র ন্যূনতম গতি কত তা নিয়েও অনেকের মধ্যে আছে নানা শঙ্কা। কারণ পেছনে দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেছে থ্রিজি’র অভিজ্ঞতা। সেক্ষেত্রে অবশ্য অপারেটর—হ্যান্ডসেট আমদানিকারকদের পক্ষে বিপক্ষে মত আছে। কার জন্যে থ্রিজি ব্যর্থ হয়েছে সেটা নিয়েও জম্পেশ তর্ক—বিতর্ক হতে পারে।

ফোরজি সেবার খরচ নিয়েও গ্রাহক মনে আছে নানা প্রশ্ন। দ্রুতগতির ডেটা ব্যবহারে গ্রাহক পর্যায়ের খরচ কি বাড়বে?

একটা প্রজন্ম যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন গতি তো বাড়বেই। তাই গতি কি হবে না হবে সেটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। খরচ নিয়েও তেমন কিছু বলতে চাই না। আমার শুধু প্রশ্ন ফোরজি দিয়ে আমরা কি করব? ফোরজি কি আমাদের জীবনের গতি বাড়াবে নাকি শুধু ইউটিউব দেখা বা বিদেশি মুভি দেখার জন্যে খরচ হবে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার এই অবকাঠামো? নাকি অন্য সুবিধাও ঘরে তোলা যাবে?

দেশে থ্রিজি আছে ২০১২ সাল থেকে। সবমিলে এখন সাড়ে পাঁচশ জিবিপিএস-এর চেয়ে বেশি ব্যন্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে এই বাজারে। কিন্তু এখনো স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের কনটেন্ট বলতে গেলে নেই-ই। ব্যান্ডউইথের পুরোটাই খরচ হয় ভিনদেশি কনটেন্টে। থ্রিজি সেবার ইকোসিস্টেমই তো আমাদের হাতে নেই। ফোরজিতে সেটি সুদূর পরাহত এক চিন্তা।

তাতে যেটা দাঁড়াচ্ছে তা হল, রাস্তা চওড়া আর মসৃণ হয়েছে কিন্তু সে রাস্তায় চলার জন্যে নিজেদের কনটেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ইনফোটেইনমেন্টের পুরোটা জায়গা দখল করে নিয়েছে অন্যরা। আমাদের থালা এখানে শূন্য। এই সুযোগে অন্যদেশের নাম সর্বস্ব কোম্পানিও বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে, কারো নজরেই আসছে না।

সন্দেহ নেই ইন্টারনেটের এই রাস্তা ফোরজি’র মাধ্যমে আরও চওড়া আর মসৃণ হবে, যেটাকে আমরা বলছি মোবাইল ইন্টারনেটের এক্সপ্রেস ওয়ে—সেখানে কী চালাবো আমরা? শুধুই বিদেশি কনটেন্ট নাকি আমরাও সেবার দরজা—জানালাকে খানিকটা প্রসারিত করব যেন ঘরটা আলোময় হয়ে ওঠে।

দেশে ই-কমার্স এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি, আশা করি সেটা হবে। এখানে ফাইন্যান্সিয়াল খাতের ডিজিটাইজেশন মানেই হল কেবল এটিএম থেকে টাকা তোলা আর মোবাইল ফোন থেকে গৃহকর্মীর বেতন বাড়িতে পাঠানো। অনলাইনে যে গেম খেলি তার কয়টাই বা দেশি? ই-শিক্ষা বা ই-স্বাস্থ্য সেবার কথা আসছে, কিন্তু সেটার জন্যেই কি আমরা তৈরি? তাহলে কী করব আরেকটা “জি” বাড়িয়ে?

আমাদের সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কি সুযোগ দেবে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের? মোবাইল ফোনের গ্রাহক কি তার ডিভাইসটি দিয়েই সিনেমার টিকিট নিতে পরবেন বা রেস্টুরেন্টের রিজার্ভেশন নিশ্চিত করতে পারবেন? বন্ধ থাকা নানা দরজা কি খুলবে? বিদ্যুৎ-পনির বিল পরিশোধকেই তো আমরা ডিজিটাইজ করতে পারলাম না এতো দাবি করি কি করে।

অনেকেই জানেন, অন্তত বছর পাঁচেক আগে মোবাইল ফোনের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস (ভ্যাস) নীতিমালার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাতে করে স্থানীয় পর্যায়ে যে ভ্যালু অ্যাড করার মতো কনটেন্ট তৈরি হবে সেই রাস্তায় কিন্তু বড় একটা বাধা পড়ে আছে। এই বাধা দূর করতে না পারলে কিন্তু ফোরজি খুব একটা কাজে আসবে না।

সরকার সম্প্রতি তথ্য প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার নির্দেশনা জারি করেছেন। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু স্থানীয় বাজারেও যাতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা কিছু একটা করতে পারে তার জন্যে অন্তত ভ্যাস গাইড লাইনটার দিকে মনোযোগ দেন। না হলে দেখবেন কেবল ইউটিউব আর ফেসবুক মুখী হয়েই থাকবে ফোরজি। এর বাইরে অবশ্য গোপন সাইটগুলোতেও ভিড় বাড়বে। নাম করার জন্যে হয়তো মাঝে মাঝে কয়েকশ সাইট বন্ধ করবেন কিন্তু বিপরীতে আরও হাজার হাজার এসে জড়ো হবে নেটওয়ার্কে।

গোপন স্ট্রিমিংকে প্রকাশ্য করতে হলেও উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কথা হল, রপ্তানি বাড়ানো যেমন বড় দায়িত্ব আবার স্থানীয় বাজার থেকে টাকার বহির্মুখী প্রবাহ বন্ধ করারও কি রপ্তানির চেয়ে কম বড়?

কোনো অবস্থাকেই বিদেশিদের বিপক্ষে বলছি না। কিন্তু দেশীয় তরুণদেরকেও তো কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তারা যেন ফোরজি’র সুবিধা আমার মোবাইলে এনে দিতে পারে তার জন্যেও তো কাজ করতে দিতে হবে। আর এক্ষেত্রে সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থারই প্রধান দায়িত্ব। ফাইববার অপটিকের যে বিশৃঙ্খল অবস্থা আছে সেটিও গোছানোর কাজে হাত দিতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। বিস্তীর্ণ ফাইবার নেটওয়ার্কবিহীন ফোরজিও কিন্তু অলিক কল্পনা।

ফোরজি’র সাফল্যের ক্ষেত্রে মোবাইল হ্যান্ডসেট আরেকটি বিষয়। আমদানিকারকরা বলছেন, তাদের হিসাবে গত তিন বছরে দেশে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ ফোরজি ব্যবহার উপযোগী হ্যান্ডসেট এসেছে। এর সবই যদি এখনো ব্যবহার উপযোগী থেকে থাকে এবং দেশে হ্যান্ডসেটের সংখ্যা যেখানে ১০ কোটি তাহলে সেটি কোনো অবস্থাতেই চার শতাংশের বেশি নয়।

এই অবস্থায় ফোরজি নেটওয়ার্ক কতটা কাজে লাগবে সেখানে থেকে যাচ্ছে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে চলতি বাজেটে বাড়ানো হয়েছে হ্যান্ডসেটের আমদানি শুল্ক। ফলে কম দামে গুণগত মানের ডিভাইস এখন সাদা-কালো স্বপ্ন। স্থানীয় পর্যায়ে হ্যান্ডসেট সংযোজনের জন্যেই শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু সেই হ্যান্ডসেট বাজারে আসতে তো আরও সময় লাগবে। সেই সময় পর্যন্ত অন্তত শুধুমাত্র ফোরজি ব্যবহার উপযোগী সেটের মূল্য কিছুটা হলেও গা-সওয়া করতে সরকার কিন্তু এই ডিভাইসটির ওপর থেকে শুল্কটা একটু কমালেও পারে।

তাতে আখেরে ডিজিটাইজেশনেরই লাভ। আর তাতে ফোরজি দিয়ে লাভটা আসবে জীবন যাপনেরও।

Comments

The Daily Star  | English
No respite from heat wave for five days: BMD

Heat takes a toll on expecting mothers

The ongoing heatwave has exacerbated the challenges faced by everyone in the country, but the situation has become particularly difficult for expecting mothers.

1h ago