মুক্তিযুদ্ধ

৭ জুন ১৯৭১: বাংলার মানুষ লড়াই চালিয়ে যাবে: মওলানা ভাসানী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ জুন বহুল ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেশের কোনো এক মুক্তাঞ্চল থেকে সাংবাদিকদের বলেন, 'আজ বাংলাদেশ অসহায় নিরীহ মজলুম নর-নারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। এই রক্ত শহীদের আত্মত্যাগ। এই লাখো রক্ত স্রোতের বিনিময়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আসবে বাংলায়। বাঙালি আজ কারো সাহায্যের পরোয়া করে না, যদি কেউ সাহায্য নাও করে তবুও বাংলার মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। আজ ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়ে গোটা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুদের টাকায় নাকি পাকিস্তান ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এদেশের প্রতিটি মানুষ জানে কতোখানি নিপীড়িত আর নির্যাতিত হলে বন্দুক আর গুলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। ওরা আমাদের সমস্ত কিছু শেষ করে দেবে, আর আমরা চোখ বুজে সহ্য করবো?'

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ জুন বহুল ঘটনাবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেশের কোনো এক মুক্তাঞ্চল থেকে সাংবাদিকদের বলেন, 'আজ বাংলাদেশ অসহায় নিরীহ মজলুম নর-নারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। এই রক্ত শহীদের আত্মত্যাগ। এই লাখো রক্ত স্রোতের বিনিময়ের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আসবে বাংলায়। বাঙালি আজ কারো সাহায্যের পরোয়া করে না, যদি কেউ সাহায্য নাও করে তবুও বাংলার মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। আজ ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়ে গোটা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলছে ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দুদের টাকায় নাকি পাকিস্তান ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এদেশের প্রতিটি মানুষ জানে কতোখানি নিপীড়িত আর নির্যাতিত হলে বন্দুক আর গুলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। ওরা আমাদের সমস্ত কিছু শেষ করে দেবে, আর আমরা চোখ বুজে সহ্য করবো?'

বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা

৭ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে সরদার শরণ সিং পূর্ব বাংলায় চলমান মুক্তিযুদ্ধ, শরণার্থী সমস্যা, গণহত্যা ও নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, 'আজ ভারতের একার পক্ষে পূর্ব বাংলার শরণার্থী সমস্যা সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বের প্রতিটি দেশের যেমন এই মুহূর্তে ভারতের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত, পূর্ব বাংলাকে সমর্থন করা উচিত, পাকিস্তানের তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে জেগে ওঠা উচিত। নয়তো এই সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব হবে না। রাশিয়ার উচিত এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।'

৭ জুন ভারতের সর্বোদয় পার্টির নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ চার দিনের সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পৌঁছান। এই সফরে তার সিনেট ও কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।

৭ জুন ইউনিসেফের এক মুখপাত্র বলেন, থেকে ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য ইউনিসেফ ৩২ টন ওষুধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামাদি পাঠানো হচ্ছে।

৭ জুন জাপান সরকার পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য ৩০ লাখ ডলার সমপরিমাণ চাল অনুদানের ঘোষণা দেয়।

মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে রাষ্ট্রদূত আগা হিলালির চিঠি

৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি এক চিঠিতে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে বলেন, 'ভারত যদি শরণার্থীদের বাধা না দেয় তবে অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। ভারতে আশ্রয় নেয়া উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জন্য পাকিস্তান সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে' বলে কেনেডিকে আশ্বস্ত করেন আগা হিলালি। একই সঙ্গে আগা হিলালি বলেন, উদ্বাস্তুদের প্রুব পাকিস্তানে প্রেরণের জন্য পাকিস্তানকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে সহায়তা করা উচিত।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ঘটনা

৭ জুন ভারতের লক্ষ্ণৌতে জাতীয় পরিষদের সদস্য ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নেতা ফণীভূষণ মজুমদার এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সব নেতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তারা যেভাবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন তা অতুলনীয়। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করি তিনি দ্রুত মুক্তি পাবেন।'

৭ জুন ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার টোয়েনস গার্ভে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এদিন একই সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন।

ঢাকায় এদিন

৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান আগরতলা মামলার সরকারপক্ষের কৌঁসুলি টি এইচ খানকে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের স্থায়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন।

৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে ১৫০ নম্বর সামরিক আদেশ জারি হয়। মূলত ঢাকায় সামরিক বাহিনীকে আরো আক্রমণাত্মক করার জন্য সামরিক সেক্টরগুলোকে পুনর্গঠিত করার জন্য এই আদেশ জারি করা হয়।

৭ জুন মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, যে কোনো মূল্যে আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুর আগে পাকিস্তানি পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের দাবি এবং ইসলামি ও পাকিস্তানি আদর্শে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

পাকিস্তানে এদিন

১০০ ও ৫০০ টাকার নোট অচল ঘোষণা

৭ জুন পাকিস্তান সরকার ১০০ ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল করার ঘোষণা দেয়। পাকিস্তান সরকার বলে, আজ মধ্যরাতের পর থেকে এই নোট অচল বলে গণ্য হবে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান অর্থ সংক্রান্ত সামরিক বিধি জারি করেন। এতে বলা হয়, যেসব পাকিস্তানি নোটে ‘বাংলাদেশ’ অথবা ‘জয়বাংলা’ লেখা অথবা মুদ্রিত থাকবে সেসব নোট অচল বলে ধরা হবে।

৭ জুন পাকিস্তানে ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের জনৈক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংস্থাগুলোর জাতিসংঘের সাহায্য সামগ্রী বন্টন করার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পাকিস্তান পরিত্যাগ করেছে।'

দেশব্যাপী গণহত্যা, প্রতিরোধ যুদ্ধ ও বিবৃতি

৭ জুন ভোরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর একটি দল সাতক্ষীরার দেবহাটা থানা ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে শ্রীপুরের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ঘুমন্ত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দোহা কাজল, নাজমুল আবেদীন, নারায়ণচন্দ্র ধর, আবুল কালাম এসময় শহীদ হন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি হানাদার সেনারা পালিয়ে যায়।

৭ জুন ফেনীর ফুলগাজীর বন্দুয়া রেলস্টেশনের পাশের সিলোনিয়া নদীর তীরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এরপর সারারাত দুই পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে যুদ্ধ চলে।

৭ জুন বগুড়ার সেন্ট্রাল হাইস্কুল মাঠে জেলা শান্তি কমিটির ডা. হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন প্রিন্সিপাল মওলানা নজিবুল্লাহ, বগুড়া জেলা জামায়াত নেতা মওলানা আবদুর রহমান সহ অনেকে। সভায় বক্তারা বলে, 'ভারতের চর মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ দেশ ও জাতির শত্রু। এদেরকে যে কোনো মূল্যে বিনাশ করতেই হবে।'

৭ জুন ঝালকাঠিতে শান্তি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শান্তি কমিটির সভাপতি খান ফজলে রব চৌধুরী ও এমএনএ নূরুল ইসলাম সিকদার। খান ফজলে রব চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, 'যারাই মুক্তিযুদ্ধের কথা উচ্চারণ করবে তাদেরকে ধরে আটক করতে হবে। এরাই এখন পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সাধারণ মানুষকে।'

সূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র নবম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ খণ্ড।

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৮ জুন ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ৮ জুন ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka’s Toxic Air: High levels of cancer-causing elements found

The concentration of cancer-causing arsenic, lead and cadmium in Dhaka air is almost double the permissible limit set by the World Health Organization, a new study has found.

8h ago