পাঁজর, করোটি, স্কন্ধের মালা

যে কয়েকজন তরুণ টিভি চিত্রনির্মাতা চলতি সময়ে তাদের কাজ দিয়ে আলোচিত, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। চিত্রনির্মাতার পাশাপাশি কবি, চিত্রশিল্পী ও লেখক। আনন্দধারার জন্য প্রথমবারের মতো লিখলেন উপন্যাস...

যে কয়েকজন তরুণ টিভি চিত্রনির্মাতা চলতি সময়ে তাদের কাজ দিয়ে আলোচিত, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। চিত্রনির্মাতার পাশাপাশি কবি, চিত্রশিল্পী ও লেখক। আনন্দধারার জন্য প্রথমবারের মতো লিখলেন উপন্যাস...

 

এক.
এই জনপ্রিয়তার কী কী কারণ থাকতে পারে? হুম...সুন্দরী, সুন্দরী তো বটেই। সঙ্গে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব! সেটা কিন্তু অন্তত এই বয়সী ছেলে-মেয়ের কাছে জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটা কারণ হতে পারত! সিঙ্গেল লেডি, সেটাও একটা ব্যাপার! যদিও সত্যিকারের সিঙ্গেল নন, স্বামীর অকালমৃত্যুর পর থেকে সিঙ্গেল। দেশের বাইরের কয়েকটা ভালো ডিগ্রি থাকার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপিকা হতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি অনরা মালিকের। ৩৫ বছর বয়সেই এই পদ তিনি পেয়েছেন। বোঝাই যায় পূর্ণাজ্ঞ অধ্যাপিকা হতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে নিজের সহকর্মী কারো সঙ্গেই পারতপক্ষে কথা বলতে দেখা যায় না তাকে। কিন্তু যখন তিনি ক্লাসে পড়ান সবাই গো-গ্রাসে সেই লেকচার গিলতে থাকে। তারপরও এমন কিছু ছাত্র সব ক্লাসেই থাকে, যারা লেকচারের ভালোমন্দের ধার ধারে না, ক্লাস ফাঁকি দেয়াকে গুরুদায়িত্ব মনে করে। তারাও কিন্তু পারতপক্ষে অনরা মালিকের ক্লাস মিস করে না। মোট কথা অনরা মালিকের ক্লাস মানেই অন্তত ৯০-৯৫ ভাগ উপস্থিতি! ব্যাপারটি নিয়ে শিক্ষক মহলে যে কথা হয় না তা নয়। কয়েকজন প্রবীণ শিক্ষক এর নেপথ্যের কারণ অনুমান করতে পারলেও মুখ ফুটে কোনো মন্তব্য করতে পারেন না। আর অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদেরও মোটামুটি ছাত্রদের কাছাকাছি অবস্থা, সবাই তার অঘোষিত ভক্ত-অনুরক্ত। সুতরাং তাকে নিয়ে যেসব কথাবার্তা হয়, সেগুলোকে সমালোচনা বলা যায় না, কেবলই আলোচনা, সেই আলোচনায় কারণে-অকারণে কেবলই প্রশংসার ছড়াছড়ি থাকে। তৃতীয় বর্ষের জিনতত্ত্বের ক্লাস নিয়ে থাকেন অনরা মালিক। আজকে সদ্য তৃতীয় বর্ষে ওঠা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তার প্রথম ক্লাস। বেশিরভাগ ছাত্রই বেশ আগেভাগে উপস্থিত। সিনিয়র স্টুডেন্টদের কাছে ক্রমাগত তার গল্প শুনে শুনে সবার মনেই তার সম্পর্কে কৌতূহলের অন্ত নেই। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সবারই চোখ দরজার দিকে। একটু দূরে করিডোর ধরে তাকে এগিয়ে আসতে দেখে ছাত্রদের ভেতরে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। অফ হোয়াইট রঙের শাড়িতে খুবই হালকা ক্যালিগ্রাফির কাজ। মাথায় কোনোমতে খোঁপার মতো করে পেঁচিয়ে রাখা চুল, সেই চুল আবার রঙতুলি দিয়ে বানানো চুলের কাঁটা দিয়ে গেঁথে রাখা। চোখে মন্টে ব্ল্যাংকের বাই ফোকাল চশমা। বাই ফোকাল চশমা সাধারণত একটু বৃদ্ধ বয়স্কদেরই পরতে দেখা যায়, অনরা মালিকের এই বয়সেই বাই ফোকাল লেন্স লাগে। অবশ্য একজন সহযোগী অধ্যাপিকার সঙ্গে ব্যাপারটি দারুণ মানিয়ে যায়। অসম্ভব কোঁকড়ানো চুলের এক গোছা কপালের সামনে চলে এসেছে, সেটি বারবার সরিয়ে দেয়ার অভ্যাস নেই তার। ক্লাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রী স-সম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে গেল। তাদেরকে যেন লক্ষই করল না অনরা। এই রকম শিক্ষকরা সাধারণত খুবই বোরিং হয়ে থাকে। তথাপি তার এই জনপ্রিয়তার কারণ নির্দিষ্ট করে বলাটা একটু দুরূহই বটে। কোনোপ্রকার কালক্ষেপণ না করে তিনি বোর্ডে লিখলেন, ‘জিনম’/জেনেটিক্স। এটা লেখার পর এই প্রথম তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতঘড়ি দেখে নিয়ে বলেন, (অনরা যা বলছেন সেটা মোটামুটি পেছনের দিকে বসে থাকা দু’একজন ছাত্র তার আগেই নিচু কণ্ঠে মুখস্থ বলছে) ‘আমাদের ক্লাস ঠিক একটা চল্লিশে শুরু হচ্ছে, আমার ৪৫ মিনিট ক্লাস নেয়ার কথা। ৪৫ মিনিটের পরও যদি আমি শেষ করতে না পারি তাহলে, যাদের থাকতে ইচ্ছে না হবে তারা চাইলেই চলে যেতে পারবে, আমার অনুমতিরও দরকার হবে না। পেছন দিকে বসে থাকা তমাল, আসিফ আর ত্রেতা নিচুস্বরে হাসছে। ত্রেতা অবাক হয়ে মুখ টিপে বলছে, ম্যাডামের সঙ্গে আজকে প্রথম ক্লাস, অথচ উনার ডায়লগ তুই কীভাবে মুখস্থ বললি আসিফ! সে একটা কৃতিত্বের হাসি দিয়ে বলল, মনে প্রেম থাকলে সবই সম্ভব বস! ত্রেতা তার মাথায় মৃদু একটা আঘাত করে বলল, ফালতু কোথাকার, টিচারকে নিয়ে কেউ এসব বলে! তমাল ফিসফিস করে বলে, টিচার না, দিস ইজ অ্যা অনরা মালিক। পেছনে যে এত কথা হচ্ছে তা নিয়ে কোনো বিরক্তি বা ভ্রুক্ষেপ নেই অনরার, তিনি ক্লাস নিতে শুরু করলেন, জীবন্ত প্রাণীর বংশগতির আণবিক একককে জিন বলা হয়। জিন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ জিনেসিস থেকে, যার অর্থ ‘জন্ম’ বা জিনোস থেকে, যার অর্থ ‘অঙ্গ’। জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স হলো এক জীবের সঙ্গে অন্য জীবের জন্মগত চারিত্রিক মিল বা পার্থক্য সম্পর্কিত বিজ্ঞান। ১৯০৫ সালে উইলিয়াম বেটসন জেনেটিক্স শব্দটি প্রবর্তন করেন। জীব মাত্রই যে তার বাবা-মায়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের জানা এবং মানুষ যেহেতু অনাদিকাল থেকেই তার বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করতে শিখেছে, তাই সে নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে তার কাক্সিক্ষত গুণাবলির সমাবেশ শস্য এবং গৃহপালিত পশুর মধ্যে ঘটিয়েছে। তবে বংশগতি বা আধুনিক জিনতত্ত্বের বয়স খুব বেশি নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়ান ধর্মযাজক গ্রেগর মেন্ডেলের গবেষণার ভেতর দিয়ে এই বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। মেন্ডেল তার পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করেছিলেন যে বাবা-মায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। বংশগতির বৈশিষ্ট্যগুলোকে কিছু একক দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, যাকে আমরা জিন হিসেবে জানি। ডিএনএ’র নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে এই জিন। এখন প্রশ্ন হলো ডিএনএ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? তোমরা কি কেউ বলতে পারবে ডিনএনএ আসলে কী? প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে উত্তরের আশায় ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে চোখ বুলালেন অনরা। তৃতীয় বেঞ্চে বসা বেশ পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো একটা ছেলে হাত তোলে। তার দিকে তাকিয়ে অনরা বললেন, হ্যাঁ বল। সে মোটামুটি একজন অধ্যাপকের মতো গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, ডিএনএ’র ইলাবরেশন হলোÑডাইঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। বেসিক্যালি ডিএনএ এমন একটা অণু, যা চারটি ভিন্ন প্রকৃতির নিউক্লিওটাইডে তৈরি, যাদের বিন্যাসই কোনো অর্গানিজমের জিনেটিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দেয়। ডিএনএ সাধারণত দুটো সর্পিল তন্তুর মতো বিন্যস্ত থাকে; যেখানে কোনো একটা নিউক্লিওটাইড অন্য তন্তুতে অবস্থিত নিউক্লিওটাইডের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
Ñ একটু দম নিয়ে ছেলেটা এক হাতের আঙুল আরেক হাতে ঢুকিয়ে খুবই পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলতে থাকেÑ ডিএনএ প্রতিলিপি করার সময় প্রতিটি তন্তুই তার পরিপূরক তন্তুর জন্য ছাঁচ হিসেবে কাজ করে, যা কিনা উত্তরাধিকার সূত্রে জিন প্রতিলিপি করার ভৌত পদ্ধতি!
পুরো ক্লাস মোটামুটি স্তব্ধ হয়ে ছেলেটির কথা শুনছিল। ত্রেতা ফিসফিসিয়ে তমালকে জিজ্ঞেস করলÑ এটা কেরে...হুট করে কোত্থেকে এলো? গত দুই বছর তো একটা ক্লাসেও দেখিনি! তমাল উত্তর দেয়ার আগেই আসিফ বলল, মালটা বাবার চাকরি সূত্রে মিডলইস্টে থাকত, ক্রেডিট ট্রান্সফার করেছে। তমাল বলে, শালা এই খবরও জানে! আসিফ বলে, শোন বাবা-মা জোর করে সায়েন্স না পড়ালে আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হতাম, আমার হিপ পকেটে থাকত রহস্যের দুনিয়া! (এরপর হুট করে প্রসঙ্গ বদলে) উফফ, তুমি এত সুন্দর কেন গো! ত্রেতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কে সুন্দর! আসিফ মুখে এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে বলে, আর যে-ই হোক তুই অন্তত না। ত্রেতা আসিফের চুল টেনে বলে, তোর কাছ থেকে আমার সৌন্দর্যের সার্টিফিকেট নিতে হবে না শালা, হঠাৎ কার কথা বললি সেটা জিজ্ঞেস করলাম! খুবই মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে অনরার দিকে তাকিয়ে বলে, হেলেনের জন্য যদি ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে থাকে, অনরার জন্য গুলিস্তান ভস্ম হয়ে যাওয়া উচিত! ত্রেতা রাগি দৃষ্টি দিয়ে বলে, আবারো টিচারকে নিয়ে...!
ছাত্রের পারদর্শিতা দেখে অনরার অভিব্যক্তিতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। অপরিবর্তিত অভিব্যক্তি নিয়ে সে বলল, ভালো বলেছ। হাতের ইশারায় ছেলেটাকে বসতে বলে সে বলল, ‘কী নাম তোমার’? অসম্ভব ফর্সা ছেলেটার মাথাভর্তি কালো চুল, সম্ভবত ননস্টিক হেয়ার অয়েল বা ওয়েট জেল দিয়ে পাট পাট করে আঁচড়ানো, বেশ তীক্ষè সবুজাভ চোখ। এত পরিপাটি থাকার পরও তার ভেতরে একধরনের উ™£ান্ত ব্যাপার আছে। সে উত্তর দিল, জায়েদ, জায়েদ বিন ফরহাদ ম্যাম। দূর থেকে হাতে তালি দেয়ার ভঙ্গি করে আসিফ বলে, একেবারে পারফেক্ট শেখ মামা, নির্ঘাত ওর বাপের উটের ব্যবসা আছে, বলা যায় না হেরেম খানাও থাকতে পারে। ত্রেতা আবারো তাকে মারতে গেল। নিজের মাথা বাঁচিয়ে আসিফ বলল, তোর নামের সঙ্গে বিনতে-ফিনতে কিছু একটা থাকলে আমরা তোর নামটা ওর বৌ হিসেবে সুপারিশ করতে পারতাম!
ত্রেতা হতাশ হয়ে বলে, অসহ্য! জায়েদ বসে পড়ে। অনরা আবারো লেকচার শুরু করার আগে বোর্ডে লেখেÑ ‘অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রোটিন, জেনেটিক কোড। তারপর বলতে শুরু করেÑ
জিনের নিউক্লিওটাইডের পরম্পরা অনুযায়ী জীবকোষ অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে প্রোটিন উৎপন্ন হয়, প্রোটিনে অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রম আর জিনে নিউক্লিওটাইডের ক্রম অভিন্ন রকম হয়ে থাকে। নিউক্লিওটাইডের ক্রম আর অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমের এই সম্পর্ককে জেনেটিক কোড বলে।
বেশ নার্ড টাইপের একটা মেয়ে প্রশ্ন করে, ম্যাম জিনম তাহলে কি এই জাতীয় কোডের পারমুটেশন কম্বিনেশন? অনরা একই নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি নিয়ে বলেন, অনেকটা তাই-ই। প্রতিটি প্রাণীর শরীরে ৪০,০০০ জিনম রয়েছে। এই ৪০,০০০ জিনমের ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাসে প্রাণিকুলের আচরণ আর জীবন প্রণালীর পার্থক্য তৈরি হয়। উত্তরটা দিতে দিতে হাতের ইশারায় মেয়েটিকে বসতে বলে আবারো লেকচার শুরু করে অনরাÑ প্রোটিনে অবস্থিত অ্যামিনো অ্যাসিড নির্ধারণ করে প্রোটিনের থ্রিডাইমেনশনাল স্ট্রাকচার কোন ধরনের হবে। মজার ব্যাপার হলো এই গঠনই আবার প্রোটিনের কাজ কী হবে তা নির্ধারণ করে!
ঠিক এখান থেকেই প্রকাশিত হতে শুরু করল অনরার অধ্যাপনার পারদর্শিতা। তার কথা বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে তিনি কোনো একটা টান টান উত্তেজনার চলচ্চিত্রের গল্প বলছেন। অভিব্যক্তিতে সেটা খুব একটা প্রকাশিত না হলেও তার কণ্ঠের ওঠানামাটা অসম্ভব নাটকীয়, শ্রোতা মোহিত হতে বাধ্য। এমনকি আসিফের মতো মহা দুষ্টু ছেলেকেও একটু নড়েচড়ে বসে মনোযোগী হতে দেখা গেল। অনরার কথা বলার ভঙ্গিতে কিছু একটা আছে যেখানে প্রতিটি কথাতেই একধরনের দৃশ্যায়ন তৈরি হয়, যা কিনা শ্রোতাকে অন্য একটা জগৎ ভ্র্রমণের অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম! সহজাত ভঙ্গিমায় আবারো লেকচার দিতে শুরু করলেন অনরাÑ জিনে অবস্থিত ডিএনএ’র যে কোনো ছোট্ট পরিবর্তন প্রোটিন গঠনকারী অ্যামিনো অ্যাসিডের আকার ও কাজে বড় ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে, যা কিনা ওই কোষ এবং সম্পূর্ণ জীব দেহে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম। যদিও জিনম জীবের বাহ্যিক গঠন ও আচরণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কিন্তু পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে জীবসত্তার অভিজ্ঞতা আর জিনমের সমন্বয়ে নির্ধারিত হয়।
এই কথাটি বলে একটু দম নেন অনরা। তারপর বলেন, এতক্ষণ আমি একাডেমিক পড়া পড়ালাম। ৪৫ মিনিট হয়ে গেছে, কেউ চলে যেতে চাইলে চলে যেতে পারো। এখন আমি আমার নিজস্ব ভাবনা আর গবেষণা নিয়ে কথা বলব, পরীক্ষায় ভালো করার জন্য যেটা খুব বেশি জরুরি নয়। কথা শেষ করে সমস্ত ক্লাসের দিকে একবার চোখ বুলালেন অনরা। কারো মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেখা গেল না! অনরা আবারো বলতে শুরু করলÑ দেখ আমার নিজের স্টুডেন্ট লাইফ আর কয়েক বছর টিচার হিসেবে কাজ করার সময় যতবার এই ‘অভিজ্ঞতা’ শব্দটা উচ্চারণ করি, ততবার মনে হয় জীবনটাকে কেবল নিরেট বিজ্ঞানের আলোকে না দেখে ফিলোসফিক্যালি দেখাটাও জরুরি। একটা শিশুর জন্ম প্রক্রিয়াÑ বেড়ে ওঠা, যৌবনপ্রাপ্ত হওয়া এবং ক্রমেই বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মরে যাওয়া, এই পুরো জার্নিটাতে (একজন শিশুর বেড়ে ওঠা থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত) যে জগৎ তাকে আবিষ্কার করে, সেই জগতে নিজেকেও একটু একটু করে আবিষ্কার করে সেই শিশু। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! ধর একটা শিশুর যতদিন পর্যন্ত ভাষাজ্ঞান না হয়, ততদিন তার বাবা-মা বা চারপাশের মানুষ তার বিভিন্ন আচরণের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, এসব ব্যাখ্যার অধিকাংশই থাকে ব্যাপারটাকে যে যেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। হতে পারে শিশুটি তখন এসব অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যার ধারেকাছ দিয়েও হাঁটেনি! তারপরও এই যে অন্যের দৃষ্টিতে নিজেকে দেখতে দেখতে বড় হওয়া, সেটা কিন্তু একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে গভীর প্রভাব ফেলে। সুতরাং আমরা বলতেই পারি নাথিং ইজ অ্যাবসলুট ইন দিস ওয়ার্ল্ড। কিন্তু এই কথাটা ফিলোসফিক্যালি ডিল করা যতটা সহজ, সায়েন্টিফিক্যালি ততটা নয়। কারণ একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের জিনের বিন্যাস, ডিএনএ, আরএনএ সবই আলাদা, তাই প্রত্যেকটা মানুষের আচরণ অভিব্যক্তিও আলাদা। কেবল জিনগত কিছু মিলের কারণে কিছু আচরণ পূর্বপুরুষের সঙ্গে মিলে যায়। তারপরও মানুষের সামাজিক আচরণ এবং জিনগত আচরণের একধরনের মিক্সড পারসোনালিটির মানুষকেই আমরা তার সামাজিক নাম দিয়ে মূল্যায়ন করি। শূন্য দৃষ্টি মেলে বেশ অন্যমনস্ক কণ্ঠে অনরা বলেন, এই সামাজিক নাম সমেত একজন মানুষ একদিন মরে যায়। আর কখনোই ফিরে আসে না। এই ফিরে না আসায় জীবিতরা তাকে মিস করে, তার হাসি, কান্না, আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিস করে। কিন্তু সেই মৃত মানুষটিও আমাদেরকে মিস করছে কি না সেটা আর বোঝার উপায় থাকে না! কারণ কোনো ধরনের সোশ্যাল স্ট্রাকচারে তাকে আর আমরা দেখি না। অথচ এই মাটির পৃথিবীতেই তার ডিএনএ পুনর্বিন্যস্ত হয়, এই মাটির পৃথিবীতেই তার জিনম নতুন কোনো পারমুটেশন-কম্বিনেশনের ভেতর দিয়ে যায়। এজন্যই জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে কবিতার ‘হয়তো বা শঙ্খচিল-শালিকের বেশে’ পঙ্্ক্তিটা আমাকে এত ভাবায়। জিনমের পুনর্বিন্যাসের কারণে আসলেই তো কোনো মানুষ শঙ্খচিল-শালিকের বেশে এই পৃথিবীতে থেকে যেতে পারে! তোমাদেরকে একটা মজার এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি। বিজ্ঞানীরা একবার ল্যাবরেটরিতে একটা ইঁদুরের জিনমের বিন্যাস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সময় সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা লিম-১ নামে একটা জিন না দিয়েই ইনকিউবেটরে একটা ইঁদুরের জন্ম দেবে। নির্দিষ্ট সময় পর ঠিকই একটা জীবিত ইঁদুর জন্ম নিল, কিন্তু সেই ইঁদুরটার মাথা জন্মালো না। এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বোঝা গেল লিম-১ জিনটির কাজ ছিল মাথা তৈরিতে সহযোগিতা করা। সুতরাং বুঝতেই পারছ, জিনম মানেই কোডস, এসব কোড কীভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে সেটি কোন প্রাণী হবে, তার পার্সোনালিটি কী হবে? জায়েদ হাত তুলল। অনরা তাকে অনুমতি দিলেন। জায়েদ বলল, ম্যাম আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, ‘লাইফ নেভার এন্ডস?’ প্রশ্নটা শুনে একটু চুপ করে গেল অনরা। তারপর গভীর কণ্ঠে বলল, আমার তো তাই-ই মনে হয়। খুব চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে পড়ল জায়েদ। সেদিনের মতো ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে গেল অনরা।

দুই.
অয়ন তার স্ত্রী রিমিকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছে। গাইনোকোলজিস্টের কাছে গেলে বোঝা যায় সাধ্যের অতীত চিকিৎসা সেবা কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী! রিমিকে নিয়ে গত সাড়ে আট মাস নিয়মিত ফলোআপে আসতে হয়েছে। প্রতিবারই ১০০০ টাকা ভিজিট! চারিদিকে তাকিয়ে অপেক্ষমাণ মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবে অয়ন। সবারই যে এখানে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আছে তা কিন্তু নয়। একটু দূরে বোরখা পরা একটা মেয়ের সঙ্গে বসে থাকা ছেলেটা নিশ্চয়ই ওর স্বামী হবে, তার চোখে-মুখে রাজ্যের উদ্বেগ, পায়ে খুবই সস্তার একজোড়া স্যান্ডেল, যা অন্তত এই ফাইভস্টার স্ট্যান্ডার্ডের হাসপাতালের সঙ্গে একেবারেই মানানসই না! হয়তো এই ক্ষুদ্র জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে সে তার স্ত্রীর নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে চায়। ওদিকে অ্যাটেনডেন্ট টাইপের একজনকে স্যার স্যার করতে করতে এক ভদ্রলোকের মুখে ফেনা উঠে যাওয়ার উপক্রম। তার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে হাসপাতালে কোনো কেবিন ফাঁকা নেই, তার স্ত্রীর ডিউ ডেট আগামীকাল বা পরশু। হয়তো গ্রাম বা মফস্বল থেকে আসা এই ভদ্রলোক ইউনিফর্ম পরা অ্যাটেনডেন্টকেই মহা ক্ষমতাবান লোক ভাবছেন, অ্যাটেনডেন্টও শত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের এই ক্ষুদ্র পেশায় নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবার সুযোগ পেয়ে দিশেহারা প্রায়। একটু পরপর ধমকের সুরে সে ভদ্রলোককে বলছে...আরে ভাই আপনে চুপ কইরা ওইখানে বসেন তো আগে, কইছি তো চান্স পাইলে আপনেরটা দেখুম, কথা বুঝে না! আরে ভাই আমারে কাম করতে দেন। এর মধ্যে হঠাৎ রিমি ফিক করে হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে ফিরে তাকায় অয়ন। রিমি তার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে একজন নারীকে দেখিয়ে বলে, ‘দেখ কা-, এখনো পেট ফোলে নাই, কিন্তু এমনভাবে কোমরে হাত দিয়ে বসেছে যে মনে হচ্ছে একটু পরেই ডেলিভারি হবে, নির্ঘাত গতকাল প্রথম শুনেছে যে ও প্রেগন্যান্ট!’ দৃশ্যটা দেখে অয়নেরও হাসি পেয়ে যায়, এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে ডেস্কে বসে থাকা নার্সের কঠোর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি সামলে নেয় অয়ন। সেটা দেখে রিমির আরো বেশি হাসি পায়। অয়ন তার হাতে চাপ দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে। কারণ রিমির ভীতিকর হাসির বাতিক আছে, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলা বা বমি করে দেয়ার রেকর্ডও তার আছে। একবার এক মরাবাড়িতে গিয়ে তো রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থা! কোনো এক ফ্যাশনেবল মহিলার অদ্ভুত কান্নার ভঙ্গি দেখে রিমির হাসির বাই উঠল, সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে হাসিটা যেন শুরু না হয়, কেউ যেন দেখে না ফেলে! কিন্তু শেষমেশ শেষ রক্ষা হলো না, বিকট শব্দ তুলে রিমির হাসি বেরিয়ে গেল! মুহূর্তের মধ্যে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে সবগুলো চোখ ঘুরে গেল। সেই মুহূর্তে মাটির নিচে লুকানোর ব্যবস্থা থাকলে অয়ন নির্ঘাত সেখানেই চলে যেত! নার্সের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রিমির কনসেনট্রেশন ডাইভার্ট করার জন্য সে বলল, নার্সগুলো এমন পাথরের মতো কেন! নার্স না হয়ে জেলার হলে আরো বেশি মানাত! এটা শুনে রিমির আবারো হাসি পেয়ে গেল। তাও শেষ রক্ষা যে সেই মুহূর্তেই নার্স যান্ত্রিক কণ্ঠে রিমির নাম ধরে ডাকল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের ফাইলপত্র নিয়ে উঠে দাঁড়াল অয়ন। রিমিও উঠে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকেই তারা ডাক্তারকে সালাম দিল। ডাক্তার তাদেরকে বসতে বলে রিমির দিকে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, কেমন আছেন? রিমি হাসতে হাসতে বলল, ভালোই তো আছি মনে হয়, পৃথিবীর সব কিছু খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়, বিশেষ করে আইসক্রিম! আইসক্রিম খেতে খেতে গলা বসিয়ে ফেলেছি প্রায়। ডাক্তার বলেন, প্রেগন্যান্সির সময় একেকজনের একেক ধরনের খাবারের ক্রেভিং হয়, এটা খুবই স্বাভাবিক। এরপর রিমিকে উঠে পর্দার আড়ালে যেতে ইঙ্গিত করেন ডাক্তার। রিমি পর্দার আড়ালে গিয়ে নির্দিষ্ট বিছানায় শুয়ে পড়ে। এ সময়টা এলে গত সাড়ে আট মাস ধরে অয়নের দম বন্ধ হয়ে যায়। কারণ একটা যন্ত্র দিয়ে ডাক্তার বাচ্চার হার্টবিট শোনেন, সেটা শুনতে যত দেরি হয়, অয়নের দম ততই বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। যন্ত্রটাও অদ্ভুত, বাইরে থেকে লাউড স্পিকারের মতো ঢিব...ঢিব শব্দ শোনা যায়। যতক্ষণ না এই শব্দ শোনা যায়, অয়ন যত দোয়া-কালাম জানত, পড়তে থাকে! যখন ঢিপ...ঢিপ করে শব্দ ভেসে আসে, অয়নের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর চলে যায়। এই ডাক্তারকে তাদের দু’জনেরই খুব পছন্দ। উনি খুব যতœ নিয়ে রোগী দেখেন। এমনভাবে রোগী দেখেন যে, মনে হয় আজকে এই রোগীই উনার একমাত্র রোগী। এই মুহূর্তে তিনি রিমির সঙ্গে গল্প করতে করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। উনার হার্টবিট মাপার যন্ত্র থেকে দীর্ঘক্ষণ খসখস শব্দ আসছে, বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে, উনি যন্ত্রটাকে নানা দিকে ঘুরিয়ে হার্টবিট খুঁজছেন। অয়নের আজকে একটু বেশিই অস্থির লাগছে, বাচ্চা উল্টে-টুল্টে থাকলে সাধারণত হার্টবিট পেতে একটু দেরি হয়, কিন্তু এতক্ষণ তো লাগে না! সে বুঝতে পারছে ওখানে শুয়ে রিমিরও তার মতো অস্থির লাগছে, মন চাইছে ভেতরে ঢুকে রিমির হাত ধরে বসে। বার বার চুলের ভেতরে হাত চলে যাচ্ছে অয়নের, সে সমানে দোয়া-কালাম পড়ে চলেছে। এর মধ্যে শুরু হয় সেই কাক্সিক্ষত ঢিপ...ঢিপ শব্দ! যেন প্রাণ ফিরে পায় অয়ন। পর্দার ওপাশ থেকে ডাক্তারের পিছু পিছু বেরিয়ে আসে রিমি। এরই মধ্যে তার চেহারায় উদ্বেগ আর ক্লান্তি ভর করেছে। অয়নের পাশের চেয়ারে এসে বসার সময় আস্তে করে রিমির হাত চেপে ভরসা দেয় অয়ন। রিমি শক্ত করে তার হাত আঁকড়ে ধরে। হাত মুছতে মুছতে নিজের চেয়ারে এসে বসেন ডা. ফারহানা নাজনিন। তিনি বলেন, মায়ের পেটে থাকতেই বাচ্চা যে চঞ্চল, শুধু উল্টে যায়, হার্টবিট পেতে আজকে জীবন বেরিয়ে গেছে! অয়ন বলে, ডাক্তার সব ঠিক আছে তো? ডাক্তার বলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। তবে ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছে, এটা খুবই কমন একটা প্রবলেম, এ ধরনের সমস্যা প্রায়ই হয়, ভয়ের কিছু নেই। ‘সমস্যা’ শব্দটা শুনে দু’জনেই ঘাবড়ে যায়। ডাক্তার বলেন, বললাম তো, এটা ভয় পাওয়ার মতো কিছু না। মায়ের পেটে বাচ্চা ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না, টাইম অনুযায়ী গ্রোথ হচ্ছে না! প্লাসেন্টাল ফাংশান ঠিকমতো কাজ না করায় এমন হচ্ছে! খুবই ভয়ার্ত কণ্ঠে অয়ন বলে, তাহলে ডাক্তার এখন কী করতে বলেন? ডাক্তার বলেন, সিম্পল, যেহেতু সে মায়ের পেটে ঠিকমতো খাবার পাচ্ছে না, তাই তার গ্রোথ হচ্ছে না, সুতরাং তাকে বের করে বাইরের খাওয়া দিয়ে গ্রোথ ঠিক করতে হবে। রিমি বলে, আপনি কি আর্লি ডেলিভারির কথা বলছেন? ডাক্তার বলেন, সেটা ছাড়া তো আর কোনো অপশন নেই। অয়ন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তাহলে কবে নাগাদ ডেলিভারি করতে চান? ডাক্তার বলেন, ম্যাক্সিমাম এক সপ্তাহ ওয়েট করা যেতে পারে, তার বেশি হলে বাচ্চার ক্ষতি হবে! রিমি অনেক কষ্টে কান্না চেপে বলে, কিন্তু এ রকম তিন সপ্তাহ আগে ডেলিভারি হয়ে গেলে বাচ্চাকে কি ইনকিউবিটরে রাখতে হবে! ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে, ইনকিউবেটরে রাখতে হবে কেন! আমি তো বাচ্চার তেমন কোনো কমপ্লিকেসির চান্স দেখছি না, সে তো এখন ম্যাচিওরড অ্যানাফ! অয়ন আবারো জিজ্ঞেস করে, তাহলে আপনি বলছেন আগামী সপ্তাহের মধ্যেই...? ডাক্তার হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে প্রেসক্রিপশনে তার নির্দেশনা লিখতে লাগেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আর অন্যান্য করণীয় জেনে নিয়ে অয়ন আর রিমি বেরিয়ে আসে। কিছুক্ষণ আগেও যেই রিমি হাসি আটকাতে পারছিল না, তার বিষণœ মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। অয়ন প্রাণপণে শক্ত থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু নানারকম দুশ্চিন্তায় সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। লিফটের কাছাকাছি আসতেই তার ফোন বাজল। ফোনে নাম দেখে নিয়ে খুবই বিষণœ কণ্ঠে সে বলল, আপা বল। ফোনের ওপাশ থেকে নিজের অফিস রুমে বসে অনরা বলল, ডাক্তার কী বলল, সব ঠিক আছে? প্রায় ধরা গলায় অয়ন বলল, না আপা ঠিক নেই। অনরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ঠিক নেই মানে! কী বলেছে ডাক্তার? অয়ন বলে, ডাক্তার বলেছে নেক্সট উইকেই ডেলিভারি করাতে হবে, বাচ্চার নাকি গ্রোথ হচ্ছে না। অনরা নিজের উদ্বেগ লুকিয়ে বলে, ওহ এটা তো হতেই পারে, এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন? দে তো, রিমিকে একটু ফোনটা দে। অয়ন রিমিকে ফোন দেয়। রিমি অনরাকে সালাম দিয়ে বলে, আপু এটা কী হলো? অনরা বলে কিচ্ছু হয়নি, একদম ঘাবড়াবে না, এসব ঘটনা অহরহ হচ্ছে, ডেলিভারিটা হয়ে গেলে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। রিমি ধরা গলায় বলে, গত সাড়ে আট মাসে আমি এক সেকেন্ডের জন্য অসাবধান হলাম না, এতদিনে একটা কমপ্লেইনও ছিল না, হঠাৎ কী হয়ে গেল আপু! আমি এত কিছু খাচ্ছি, আমার বাচ্চা নাকি খাওয়াই পাচ্ছে না! অনরা বলে, তোমরা শুধু শুধু ঘাবড়াচ্ছ, এটা অতটা বড় কিছুই না। সন্ধ্যায় তোমরা বাসায় থেকো, আমি আসব। এখনই আসতে পারতাম, সিন্ডিকেটের খুব ইমপর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে, অ্যাটেন্ড করতেই হবে। তুমি নিশ্চিন্তে বাসায় যাও, রেস্ট করো, আমি সন্ধ্যায় আসছি। অয়নকে ফোনটা দাও। রিমি অয়নের হাতে ফোন দেয়। অনরা বলে, রিমি অনেক ঘাবড়ে গেছে, এর ভেতরে তুই ঘাবড়ালে চলবে না। আজকে আর অফিস বা বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, ওর কাছে থাক। আর আমি সন্ধ্যায় আসছি। ঠিক আছে, বলে ফোন রেখে লিফটে উঠে গেল অয়ন আর রিমি।

তিন.
কার্জন হলের লাল দালানগুলোর ভেতর দিয়ে তির্যকভাবে দুপুরের হেলে পড়া সোনালি আলো পড়েছে। এই আলোটাই এমন যে, প্রাণহীন দালানগুলোকে অসম্ভব স্বপ্নময় আর নাটকীয় লাগে। ডিপার্টমেন্টের সিঁড়িতে বসে তুমুল আড্ডায় মেতেছে তমাল, আসিফ আর ত্রেতা। তমাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে থামিয়ে দিয়ে দূরের একটা নির্জন বারান্দার দিকে আসিফ সবাইকে ইশারা দিয়ে তাকাতে বলল। নির্জন বারান্দায় দুটো ছেলে-মেয়ে প্রেম করছে এবং তাদের হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে এখনই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ছেলেটা যতবার মেয়েটার মুখ ধরতে যায়, সে আলতো করে তার হাত সরানোর চেষ্টা করে। বোঝা যাচ্ছে তার মৌন সম্মতি আছে, কিন্তু সঙ্গে এটুকু নাটকীয়তা ব্যাপারটাকে আরো একটু সুন্দর করে তোলে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ত্রেতা বলল, আমার চৈতালী ধরতে হবে, আমি উঠলাম, তোরা মনের সাধ মিটিয়ে ওইসব দেখ। আসিফ কটাক্ষ করে বলল, তোমার মতো বন্ধু থাকলে আমাদের সারা জীবন ওইসবই দেখে যেতে হবে। তমাল বলে, আরে আরেকটু পরে যা না! ত্রেতা বলে, বললাম না চৈতালী ধরতে হবে। আসিফ বলে, একদিন না হয় সিএনজি অটোরিকশায় গেলি, চৈতালীতে এখন আর জায়গা পাবি না, দাঁড়িয়ে যেতে হবে। ত্রেতা বলে, সিএনজি অটোরিকশার ভাড়াটা কে দেবে শুনি? আসিফ ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বলে, দোস্ত তুই যা তো, চৈতালী-মিতালী যেইটাতে ইচ্ছা সেইটাতে যা। একটা বাঁকা হাসি দিয়ে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় ত্রেতা। দু’পাশের লাল দালানের ওপরে হঠাৎ গাঢ় মেঘ জমা হতে শুরু করে। গাঢ় মেঘের ভেতর দিয়ে তীক্ষè একটা রোদ বেরিয়ে আছে, সেই রোদ পড়ছে লাল ইটের দেয়ালে আর চলন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে। এই রকম আলো-ছায়ার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ত্রেতা। চারপাশটাকে একেবারেই বাস্তব মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কোনো অ্যানিমেটেড ছবি। এমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি যখন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তখন বোটানি আর ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পাশের গলি দিয়ে বেরিয়ে এলো জায়েদ। তাকেও একটা অ্যানিমেটেড চরিত্র মনে হলো ত্রেতার। মাথার কালো চুলগুলো সেই একইভাবে পরিপাটি হয়ে পড়ে আছে। মৃদু বাতাস শুরু হয়েছে, তবুও তার চুলের অবস্থান খুব একটা বদলাচ্ছে না। একটু বেলবটম টাইপের প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট পরায় তাকে আরো বিচিত্র লাগছে। এই যুগ হচ্ছে ন্যারো কাটের প্যান্ট পরার যুগ, সেখানে কেউ যদি খুব সিরিয়াস একটা মুখ নিয়ে ৭০ দশকের বেলবটম প্যান্ট পরে হাঁটে, তাহলে তাকে তো বিচিত্র দেখাবেই। তবে তার এই প্যান্ট কিন্তু শতভাগ বেলবটম নয়, ন্যারো কাট, বুট কাটের মাঝামাঝি কিছু একটা হয়ে নিচের দিকটা একটু ছড়িয়ে গেছে। এমন প্যান্ট পরার বুদ্ধি তার মাথায় কেন এলো সেও এক প্রশ্ন! এই রকম ভীষণ লেখাপড়া করা সিরিয়াস স্টুডেন্টের তো এ রকম ফ্যাশন সচেতন হওয়ার কথা না, মানে ফ্যাশন নিয়ে আর যা-ই হোক এক্সপেরিমেন্ট করার কথা তো না! যা-ই হোক, বিপুলা পৃথিবী, কিছুই অসম্ভব নয়। জায়েদের হাঁটার ভঙ্গিও বিচিত্র ২৩-২৪ বছরের একজন ছেলে, কিন্তু হাঁটার ভঙ্গি বৃদ্ধ অধ্যাপকদের মতো। তার সাদা শার্টে মেঘের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা তির্যক রোদ খেলছে, অসম্ভব ফর্সা হওয়ার কারণে সেই রোদেও প্রতিফলনে তাকে একটা চলমান পিতলের মূর্তি মনে হচ্ছে। ত্রেতা মনে মনে এই ছেলের একটা নাম ঠিক করে ফেললÑ ‘ড. জিভাগো’, পাশাপাশি সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এখন সে ড. জিভাগোর সঙ্গে কথা বলবে। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ত্রেতা তার হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিল। বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণের ভেতর ড. জিভাগো বাম দিকের রাস্তা ধরবে। মোটামুটি দ্রুত পায়ে সে ড. জিভাগোর সামনে উপস্থিত হয়ে বলল, আরে ড. জিভাগো, কোথায় চললে? এভাবে হুট করে একটা অচেনা মেয়ে তার সামনে এসে বলছে, ‘আরে ড. জিভাগো কোথায় চললে’ তার একটু হলেও চমকে যাওয়ার কথা, কিন্তু ত্রেতাকে অবাক করে দিয়ে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল, ‘আমাকে ড. জিভাগো বলছ কেন! আমি তো জায়েদ, জায়েদ বিন ফরহাদ! জায়েদের এ রকম আচরণে হকচকিয়ে যায় ত্রেতা, কারণ সে ধরেই নিয়েছিল, এই ছেলেটা সারাক্ষণ লেখাপড়া নিয়ে থাকে, বাস্তব জীবনে সে একটু বোকাসোকা হবে, কিন্তু এ তো দেখা যাচ্ছে মহা ট্যাটন টাইপের ছেলে! মুহূর্তেই নিজেকে অপ্রস্তুত দশা থেকে ফিরিয়ে এনে ত্রেতা বলল, তোমার হাঁটার ভঙ্গি প্রফেসরদের মতো হওয়ার কারণে মনে হলো তোমার নামের সঙ্গে একটা ‘ড.’ না থাকলেই নয়, কিন্তু ড. জায়েদ ঠিক জমছিল না, তাই ঠিক করলাম তুমি বোরিস পাস্তেরনাকের ড. জিভাগো। জায়েদ রোবটের মতো কণ্ঠে বলল, তুমি অনেকক্ষণ ধরে আমাকে ফলো করছ নাকি! এবার সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল ত্রেতা। কী উত্তর দেবে খুঁজে পাচ্ছে না! জায়েদই তাকে বাঁচিয়ে দিল। রোবটের মতো একটা হাসি দিয়ে সে বলল, অ্যানি ওয়েস ইউ ক্যান কল মি ড. জিভাগো, ওটা আমার প্রিয় ক্যারেক্টার। মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ত্রেতা। সে বলল, খুব অদ্ভুত এনভায়রনমেন্ট না! মেঘের ফাঁকে খুব মিস্টিরিয়াস রোদ, সবাইকে অ্যানিমেটেড ক্যারেক্টার মনে হচ্ছে! জায়েদ একই রোবটিক ভঙ্গিতে বলল, এসব আমি খেয়াল করি না, কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়। ইনফ্যাক্ট বছর দুয়েক আগে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি গ্যালাক্সি আর আর্থ নিয়ে আমি কিছু ভাবব না। বলেই খুবই স্বাভাবিক গতিতে সে হাঁটতে শুরু করে, এমন ভঙ্গিতে হাঁটা যে, সে একজন অধ্যাপক, ত্রেতা তার অনুগত ছাত্রী, সে এখন তার পাশাপাশিই হাঁটবে। ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই হলো, ত্রেতা তার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করল। সে বেশ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি বসবাস কর পৃথিবীতে, কিন্তু বলছ গ্যালাক্সি আর আর্থ নিয়ে তুমি ভাবতে চাও না, তাহলে ভাববেটা কী নিয়ে! এসব নিয়ে ভাবার জন্যই আমি প্রথমে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছিলাম। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর মনে হলো অনেক বড় ভুল করেছি, গ্রহ-নক্ষত্র, বিগব্যাং, সৃষ্টি রহস্য এসব রাউন্ড শেপের জিনিস নিয়ে ভাবনা আমার কাজ নয়। এই যে তুমি আর আমি হাঁটছি, আমরা কিন্তু ভার্টিকাল অ্যালাইনমেন্টে আছি, সো এটার রহস্য ভেরিমাচ ফ্যামিলিয়ার টু মি। সো আই ডিসাইডেড টু এনরোল ইন জুয়োলজি। কথা শেষ করেই একটা তৃপ্তির হাসি হাসল সে। তার এই কথা শুনে এতটাই অবাক হলো ত্রেতা যে, কয়েকটা মুহূর্ত সে নিশ্চুপই রইল। এরপর একটু টেনে টেনে সে বলল, তার মানে একটা জটিল ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে একটা সামনের সারির সাবজেক্টে চান্স পেয়ে সেটা বছর খানেক পরে আবারো জটিল একটা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তুমি সাবজেক্ট চেঞ্জ করলে! মাই গড আই জাস্ট ক্যান্ট বিলিভ দিস! খুবই আক্ষেপের সুরে জায়েদ বলল, সাবজেক্ট চেঞ্জ করা এত ইজি হয়নি। আমাদের পরীক্ষা কমিটি ভাবল অ্যাডমিশন টেস্টে ফার্স্ট হওয়া একটা ছেলেকে র‌্যাংকিংয়ে ওপরের দিকে সাবজেক্টে দিতেই হবে, তাছাড়া আমি যদি কমপারেটিভলি পেছনের দিকের কোনো সাবজেক্ট নেই, তাহলে ওয়েটিং লিস্টে থাকা একজনের কপাল পুড়তে পারে! আরেকজনকে বঞ্চিত করে লেখাপড়া করার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল না, বাবা-মাও চাচ্ছিলেন আমি তাদের সঙ্গে মিডলইস্টে গিয়ে লেখাপড়া করি। ওখানে অবশ্য জুয়োলজি পেতে আমার এত যুদ্ধ করতে হয়নি! পুরো ঘটনা শুনে মোটামুটি মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় ত্রেতার। একটু ধাতস্থ হয়ে সে বলল, তো ভার্টিক্যাল অ্যালাইনমেন্টের জিনিসে তোমার এত আগ্রহ, তুমি তো মেডিক্যালে পড়লেই পারতে! জায়েদ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, আরে বোকা খালি মানুষই কি ভার্টিক্যাল অ্যালাইনমেন্টের, পশুপাখি আছেÑ এই বিশাল প্রাণিকুল আছে। ত্রেতা বলে, বুঝতে পেরেছি ড. জিভাগো, দিস ইজ অ্যানাফ ফর মি টু ডে! মেঘ আরো গাঢ় হয়েছে। তারা দু’জনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে।
নিজের সিন্ডিকেটের সভা থেকে বাইরে বেরিয়েই ছাতা মেলে ধরতে হলো অনরার, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কার্জন হল হুট করেই কেমন যেন সুনসান হয়ে গেছে। মেঘের ফাঁকের সেই আশ্চর্য রোদ এখনো খেলা করছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে রোদ বিকিরিত হওয়ায় মনে হচ্ছে চোখের সামনে স্ফটিক গড়িয়ে পড়ছে, চাইলেই হাত ভরে কুড়িয়ে নেয়া যায়। মনের অজান্তেই স্ফটিকময় বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখল অনরা। হঠাৎ মনটা বিষণœ হয়ে গেল রাহাতের কথা মনে পড়তেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রাহাত তার দু’বছরের বড় ছিল। সে ছিল ফার্মেসির ছাত্র। ওদের ক্লাস কার্জন হলে হতো না। ফার্মেসি ডিসিপ্লিনের বিল্ডিং হলো জিমনেশিয়ামের উল্টো দিকে। সুতরাং দুই ভুবনের এই দুই বাসিন্দার ভেতরে প্রেম হওয়ার সুযোগ থাকার কথা নয়। দু’জনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ক্লাবের সদস্য হওয়ায় তাদের নানা কারণে প্রায়ই দেখা হয়ে যেত। রাহাত ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা একজন মানুষ। চারিদিক মাতিয়ে রাখা ছিল তার স্বভাব। অনরা ছিল রাহাতের একেবারেই বিপরীত স্বভাবের। স্বল্পভাষী-ধীরস্থির রাশভারি স্বভাবের এই মেয়েটিরই এক পর্যায়ে রাহাতকে ছাড়া নিজের জীবন অসম্ভব মনে হতে লাগল। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটাই তাদের কেটেছে পরিপূর্ণ প্রেমে। এরপর বিয়ে, দু’বছরের ছোট্ট একটা দুর্দান্ত সংসার! আর এর পরেরটুকু আর ভাবতে চায় না অনরা! বৃষ্টি একটু একটু বাড়ছে। তার দৃষ্টিসীমায় মাত্র দু’জন ছেলে-মেয়ে আছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা ভীষণভাবে গল্পে মশগুল, বৃষ্টি নিয়ে বিচলিত হওয়ার মতো সময় তাদের হাতে নেই। ছেলেটার হাঁটার ভঙ্গি তার বেশ পরিচিত লাগছে। কিছুক্ষণ পর সে বুঝতে পারল ছেলেটা আজকের ক্লাসের সেই অসম্ভব ব্রাইট ছেলেটা। আরো একবার ভেবে দেখল ছেলেটি কোনো অবস্থাতেই টিপিক্যাল গুড স্টুডেন্ট নয়, তার ভাবনা আর পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী। অথবা নিছকই পাগলাটে কোনো ছাত্র হবে। তাকে এভাবে বৃষ্টিস্নাত বিকেলবেলায় একজন তরুণীর সঙ্গে দেখতে পাওয়া একটু আশ্চর্যই বটে! স্ফটিক জলে একটা দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়ে দিয়ে অনরার তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসম্ভব পাগলাটে রোম্যান্টিক একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলÑ সেদিন দু’জনেরই ক্লাস শেষে চানখাঁরপুলের নীরব রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার কথা। ক্লাস শেষ করে অনরা মেইন গেটের দিকে এগোচ্ছে। তখন সবেমাত্র মোবাইল ফোন চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে সেসব ফোন দেখা যায়। ফোনে এক সেকেন্ডের জন্য কথা বললেও ৭ টাকা বিল ওঠে। অনরা আর রাহাত দু’জনেরই দুটো সেল ফোন আছে। কিন্তু পারতপক্ষে তারা ফোনে কথা বলে না। মিসড কল ব্যাপারটাকে তারা সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে, অনরা যদি একটা মিসড কল দেয় তাহলে রাহাতকে বুঝতে হবে যে তার ক্লাস শেষ, দুটো মিসড কল দিলে বুঝতে হবে যে সে গেটের কাছে পৌঁছে গেছে। দুটো মিসড কল পেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল রাহাত। অনরা একেবারেই অপেক্ষা করতে পছন্দ করে না, এটা জানে বলেই সচরাচর রাহাতের পৌঁছতে দেরি হয় না। হাঁটার গতি প্রায় দৌড়ের পর্যায়ে যখন সে নিয়ে যাবেÑ শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। অনেকক্ষণ ধরে আকাশ মেঘলা ছিল। কিন্তু কার্জন হলের গেটে পৌঁছানোর আগেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় নিজেকে আর রক্ষা করতে পারল না রাহাত। মুহূর্তেই কাকভেজা হয়ে গেল সে। দৌড়ে কোনোমতে কার্জন হলের গেটে পৌঁছে দেখে সেখানে অনরা নেই। মনে মনে ভয় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে দেখে কার্নিশের নিচে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনরা। মুহূর্তেই নিজের করণীয় ঠিক করে ফেলল রাহাত। কোনোরকম অজুহাত বা জবাবদিহিতার সুযোগ নিজেকে না দিয়েই অনরার হাত ধরে সে নিয়ে এলো খোলা আকাশের নিচে। রাহাতকে থামানোর কোনো সুযোগই পেল না অনরা! রাহাত যতই প্রেমিক হোক না কেন, এভাবে জনসম্মুখে সিনেমার মতো একটা ছেলের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা তার জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা! সুতরাং অস্বস্তিতে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে গেল সে। তবুও কোথায় যেন সূক্ষ্ম এক ভালোলাগা খেলে গেল তার ভেতরে। আর রাহাত কি আর জড়োসড়ো হয়ে থাকতে দেয়ার মানুষ! মুহূর্তেই বৃষ্টির মতো চারিদিক মাতিয়ে সে অনরাকে নিয়ে গেল এক ব্যক্তিগত পৃথিবীতে! ক্যামেরার লেন্সে যেমন ফোকাল লেংথের বাইরের জিনিসকে ঝাপসা দেখা যায়, আশপাশের মানুষগুলো ঝাপসা হতে হতে বৃষ্টির জলে গলে গেল! এখন কেবলই তারা দু’জন, আর মোৎজার্টের ‘দ্য ম্যারেজ অব ফিগারো’ অপেরার মতো বৃষ্টি। এমনই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো যে, দু’জনেরই রীতিমতো চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে। রাহাত চিৎকার করতে করতে বলল, চলো কলা ভবনের সামনের রাস্তায় যাই। ওখানে রাস্তার দুই দিকে মশারির মতো জারুল ফুল ফুটেছে! অনরা চিৎকার করে বলে, একটা ফুল কী করে মশারির মতো ফোটে বুঝলাম না! রাহাত বলে, আরে নীলক্ষেতের মশারির দোকানে যাওনি কখনো, গেলেই বুঝবে জারুল ফুলের কালার কম্বিনেশন আর মশারির কালার কম্বিনেশন একইরকম। কলা ভবনের জারুল গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় রাস্তার ওপরে হাজার হাজার মশারি টানানো রয়েছে। চাইলেই যে কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে, পুরো রাস্তাটাই একটা বেডরুম! অনরা বলে তোমার বিশাল বেডরুমে এখন বৃষ্টি পড়ছে। রাহাত আরো গলা চড়িয়ে বলে, আরে বেডরুমের সেই রেয়ার বৃষ্টি দেখতেই তো যেতে চাচ্ছি! কথা বলতে বলতে একটা রিকশা ডেকে নেয় তারা। রিকশায় উঠেই রাহাত তার পেছন দিক দিয়ে হাত দেয়। অনরা শাসনের সুরে বলে, হুম...হাত সরাও। রাহাত বলে, আরে আমার কোনো বাজে ইনটেনশন নেই! রিকশায় উঠলেই মনে হয় যদি তুমি পড়ে যাও, তাই আপনাতেই আমার হাত পেছনে চলে যায়। গাঢ় দৃষ্টিতে অনরা রাহাতের দিকে তাকায়- দু’জনেরই মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবারিত বৃষ্টির ধারা। গভীর কণ্ঠে অনরা জিজ্ঞেস করেÑ ‘আমাকে সত্যিই এত ভালোবাসো!’ রাহাত কোনো উত্তর না দিয়ে শক্ত করে অনরার কোমর আঁকড়ে ধরে। অনরার চোখ আপনাতেই বন্ধ হয়ে আসে। সে শক্ত করে রাহাতের অন্য হাত আঁকড়ে ধরে। উপাচার্যের বাংলোর বাইরের বিশাল রেইনট্রির নিচে এসে রিকশা থামিয়ে তারা নেমে পড়ে। বৃষ্টির ঝাপটা এতটাই বেড়ে গেছে যে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। রাস্তায় ইতোমধ্যেই পানি জমে নদীর আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে অবাক বিস্ময়ে রাহাতের হাত আঁকড়ে ধরে সারি সারি জারুল গছের দিকে তাকিয়ে অনরা বলে, আরে সত্যি সত্যিই তো হাজার হাজার মশারি! এর মধ্যে একটা গাড়ি তাদের গায়ে কাদাপানি ছিটিয়ে চলে যায়। এই ঘটনায় রাগ হওয়ার বদলে দু’জনেই হাসিতে ফেটে পড়ে। তারপর যেই গাড়িই আসতে দেখে, দু’জনে পা দিয়ে সজোরে পানি ছিটাতে থাকে, বাড়তে থাকে হাসির রোল! অতীতের এই অসম্ভব জীবন্ত স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে করতে কখন যে সে গোরস্তানে পৌঁছে গেছে লক্ষ করেনি অনরা। বৃষ্টি আগের চেয়ে একটু বেড়েছে, কিন্তু সেটাকে ঝুম বৃষ্টি বলা যায় না। অনরা লক্ষ্য করল, এতটা পথ সে গাড়ি না নিয়ে হেঁটেই চলে এসেছে! গাড়ির কথা মনে পড়তেই ব্যাগ থেকে সেল ফোনটা বের করে সে ড্রাইভারকে গোরস্তানে চলে আসতে বলল। ফোন নামিয়ে রেখে সে গোর খোদক আজিজ চাচার ঘরের দিকে উঁকি মেরে খুঁজল। পরে দূরে যেদিকে রাহাতের কবর সেদিকে তাকিয়ে দেখল কবরের ওপরে ছাতা মেলে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন আজিজ চাচা। এই বৃদ্ধ গোর খোদক অসম্ভব স্নেহ করেন অনরাকে। এই গোরস্তানেই আজিজের বেড়ে ওঠা। প্রায় ৬৮ বছর ধরে তিনি কবর খুঁড়ছেনÑ কবরের দেখভাল করছেন। রাহাতের কবর দেখাশোনার জন্য মাসে মাসে কিছু টাকা তাকে দেয় অনরা। কিন্তু অনরা নিয়মিত এখানে আসার কারণে আজিজের সঙ্গে তার এমন এক অদৃশ্য আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে যে, আজিজ মাস শেষে আজকাল আর টাকা নিতেই চায় না! টাকা দিতে গেলেই সে বলে বাপজানরে পাহারা দেই এইডা তো নিজের কাম আম্মা, এই কামে টেকা নেই ক্যামনে! তখন অনরা বলে, আমি তো এটার জন্য আপনাকে টাকা দেই না চাচা, আপনার নিজের মেয়ে থাকলে আপনাকে হাতখরচ দিত না! মনে করেন আপনার মেয়ে আপনাকে হাতখরচ দিচ্ছে। এটা শুনলেই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় আজিজ। অনরার হাত থেকে টাকা নিয়ে চোখে-মুখে লাগিয়ে চুমু খায়। আজিজকে ওভাবে ছাতা হাতে রাহাতের কবরের কাছে দেখে একটু অবাক হলো অনরা। সে এগিয়ে গেল সেই দিকে। আজিজের কাছে গিয়ে সে বলল, চাচা আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে কেন! দীর্ঘদিন গোরস্তানে থাকার কারণেই কিনা, আজিজের চেহারা খুব একটা সাধারণ লাগে না! তামাটে কালো চেহারা, তৈলাক্ত চকচকে মুখে গভীর বলিরেখা, কোটরগত চোখ, আর কোঁকড়ানো লালচে চুলে তাকে বেশ আধ্যাত্মিক লাগে। তার হাসিও অনেক কঠোর দেখতে। সেই কঠোর হাসি দিয়ে সে বলে, বৃষ্টি হইতাছে তো আম্মা, ভাবলাম বাপজানের কষ্ট হইব। একটু চুপ হয়ে যায় অনরা, তারপর বলে, এত এত কবর ভিজছে, শুধু একটাতে ছাতা ধরে কী লাভ! আজিজ বলে, আপনেরে প্রতিদিন চিঠি দিতে দেইখা আমারো মনে হয় বাকি মুর্দাদের থেইকা বাপজান সব কিছু একটু বেশিই টের পায়! একটা বিষণœ হাসি দিয়ে অনরা বলে, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে এত এত মৃত মানুষ সব কিছু টের পায়? আজিজ একই রকম বিশ্বাস নিয়ে বলে, এই কথা কি কম দিন আপনেরে বুঝায় কইছি আম্মা! মুর্দারা জ্যাতা মানুষরে বিশ্বাস করে না, তাই তারা জ্যাতা মাইনষের সামনে ধরা দেয় না। আমি ৬৮ বছর মুর্দা নিয়া আছি, আমারে তারা বিশ্বাস করে। আজিজের এই জাতীয় কথাবার্তা আর যা-ই হোক অনরার মতো একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে অনরার ভালো লাগে, ইনফ্যাক্ট সে বিশ্বাস করতে চায়ও। মনে আছে, রাহাতের মৃত্যুর পরপর সে যখন নিয়মিত কবর জিয়ারত করতে আসত একদিন আজিজ তার পাশে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, মুর্দারে ডাকার মতো ডাকলে সে টের পায়। এসব কথা আমি সবাইরে কই না। আপনেরে কইতাছি কারণ আমি ৬০-৬৫ বছর গোরস্তানে কাম করতাছি, কাউরে দেখলাম না প্রতিদিন কবরখানায় আহে। যেই মানুষডা মরার আগের দিনও সবার জন্য দরকারী মানুষ আছিল, মরল তো সব শেষ হইয়া গেল! প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজন প্রতি জুমা বারে আইব, এরপর শবে বরাতে, ঈদে আইব, তারপর আস্তে আস্তে আর খোঁজ থাকব না! খালি আপনেরেই দেখলাম প্রতিদিন আইসা ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাড়াইয়া থাকেন! অনরা আজিজকে বলতে পারে না যে সে পারলে প্রতিদিন এক কাপ চা আর টোস্ট বিস্কুট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতে তাদের দু’জনেরই প্রিয় মুহূর্ত ছিল এক কাপ চায়ে টোস্ট বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া। বিয়ের পর তারা কোনোদিন আলাদা কাপে চা খায়নি। তখন অনরা সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে, আর রাহাত ফার্মাসিস্ট হিসেবে একটা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করছে। স্বাভাবিকভাবেই রাহাতের অনেক আগেই অনরা বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে ঘর গোছানো তার কাছে নেশার মতো লাগে! গুনগুনিয়ে গান গাওয়া, ঘর গোছানো আর রাহাতের ফেরার অপেক্ষা, খুব পরিপূর্ণ একটা জীবন। আর রাহাতও এমন একজন মানুষ যে সে যতই ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরুক, সেই ক্লান্তি সে প্রকাশ করবে না! ঘরে ইচ্ছে করেই ময়লা জুতো নিয়ে ঢুকে পড়ে অনরাকে ক্ষ্যাপাবে, তারপর ময়লা পা নিয়ে বিছানায় উঠে বকা খাবে, এই তার স্বভাব। সেদিন বেশ রাত করে ফিরেছিল রাহাত, বছরের মাঝামাঝি সময়ে তাদের একটু কাজের চাপ বেশি থাকে। এত রাত করে ফিরে তার একই খুনসুটি। পায়ের জুতা নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। পড়েই বলল, লম্পট স্বামী বাজে এলাকা থেকে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে, তুমি এখন দুঃখিনী বউ হিসেবে চোখের জল মুছতে মুছতে তার জুতো খুলে পা বিছানায় তুলে দিয়ে মাথার কাছে বসে ফুঁঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। অনরা কপোট রাগ নিয়ে চোখ ছোট করে দাঁত কিটমিটিয়ে তাকে বলে, আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ঝেঁটিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করব। রাহাত উঠে বসে বলে, ও হো, আপনের ঝাড়ি শুইন্যা নেসাভি কাইট্যা গেছে উস্তাদ, যান চা নিয়া আহেন। অনরা বলে এখন কিসের চা, ডিনার করব না আমরা! রাহাত আবারো বলে, হালায় আমি তো বাইজিপাড়া থিইক্যা খাইয়া আইছি। অনরা বলে উফ রাহাত, যাও তো ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসো, ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার! ডিনার শেষে প্রতিদিনের মতো দু’জনে আয়েশ করে টিভি ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। রাহাত কেবলমাত্র স্পোর্টস চ্যানেল দেখে, আর অনরার পছন্দ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। দু’জনের রিমোট নিয়ে কাড়াকাড়ি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। যেহেতু ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল চলছে, সুতরাং টিভির ওপরে এখন একক আধিপত্য রাহাতের। আজকে আবার রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার খেলা! সে স্পোর্টস চ্যানেল ছেড়ে বলে, এই রে আজকে তো দেখি ঘুম পেয়ে যাচ্ছেÑ আমরা কি চা খাব না? অনরা বলে, দাঁড়াও আনছি। রাহাত বলে, এখন দাঁড়াতে পারব না সোনা! অনরা ‘উফ’ বলে চা আনতে কিচেনে চলে যায়। বেশ আয়োজন করে চা বানানোর স্বভাব অনরার। অনেকক্ষণ ধরে দুধ জ্বাল দিয়ে, একগাদা চা পাতা দিয়ে লিকার গাঢ় হওয়ার পর শেষ হয় তার চা বানানো। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফিরে এসে সে দেখে, টিভি চলছে, এই মাত্র বার্সেলোনা একটা গোল দিয়েছে মনে হয়। রাহাত বার্সেলোনার ঘোরতর সমর্থক, এখন তার চিৎকার করে ঘর ফাটিয়ে দেয়ার কথা! রাহাতের হাতে রিমোট, তার চোখ বন্ধ, এক হাত বুকে, বন্ধ চোখ, আর ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে আছে, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে! তাকে এ অবস্থায় দেখে মায়া লাগে অনরার, কতটা ক্লান্ত হলে প্রিয় দলের খেলা রেখে কেউ ঘুমিয়ে যায়! সে মনে মনে বলে, ‘রাহাত তোমাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি।’ বেড সাইড টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সে রাহাতকে ঠিকমতো শুইয়ে দেবে বলে হাত থেকে রিমোটটা নিতে গিয়ে একটু চমকে যায়। মনে হয় বরফশীতল হাতের স্পর্শ লাগল তার হাতে। বুক থেকে হাতটা সরিয়ে মাথার বালিশ ঠিক করতে গিয়ে দেখে মাথাটা খুব ভারী হয়ে একদিকে কাত হয়ে গেল, আর তার হাতটা ঠিক বরফের মতো শীতল নয়, ২৪ ঘণ্টা বরফে চুবিয়ে রাখলেও এই শীতলতার সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যাবে না, খুবই অস্বাভাবিক শীতল সে হাত! আঁতকে উঠল সে! একটু সন্ত্রস্ত গলায় সে রাহাতকে কয়েকবার ডাকল। রাহাত কোনো সাড়াশব্দ না করায় সে বলল, রাহাত প্লিজ শয়তানি করো না, আমার ভয় করছে কিন্তু! অল্পতেই অসম্ভব ভয় পেয়ে যায় অনরা এটা রাহাত জানে, তাই সে পারতপক্ষে দুষ্টুমি করেও কখনো অনরা ভয় পেতে পারে এমন কিছু করে না। অনরা আবারো বলে, রাহাত প্লিজ আমার ভয় করছেÑ বলেই রাহাতের কাঁধের নিচে ঝাঁকি দেয়, সঙ্গে সঙ্গে রাহাতের মাথা কাটা গাছের মতো বালিশ থেকে পড়ে যায়। অনরা বুঝতে পারে ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুলে নিয়ে অয়নকে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানায়, অয়ন ওই রাতে ইস্কাটন থেকে ছুটে আসে ধানম-িতে! আসার সময় সে বুদ্ধি করে অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়ে আসে। দ্রুততম সময়ের ভেতরে রাহাতকে হাসপাতালে নেয়া হয়। ইমার্জেন্সির ডাক্তার তার ঘাড়ের কাছে হাত রেখেই নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেন, সরি, হি ইজ নো মোর। অদ্ভুত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনরা বলে, নো মোর মানে! একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে নো মোর বলে দিলেন মানে! আপনি ঠিকমতো দেখেন! দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে অয়নের হাত আঁকড়ে বলে, কী বলছে ডাক্তার, অয়ন! তুই এক্ষুনি তোর ভাইয়াকে অন্য হাসপাতালে নে, উনি ভুল বলছেন! জীবনে জ্বরও হয় না তোর ভাইয়ার! ডাক্তার অয়নের দিকে তাকিয়ে বলেন, খুব অল্প সময়ের ভেতরে সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে উনার, এটাকে বলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন। মানে খুব সিম্পল ভাষায় বললে যেই রক্তনালীগুলো দিয়ে হার্ট রক্ত পাম্প করে, সেগুলো চর্বি দিয়ে ব্লকড হয়ে কলাপস করেছে, এসব কেসে সাধারণত রোগী ট্রিটমেন্টেরও কোনো চান্স দেয় না, কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে বিপদটা ঘটে! সো আনফরচুনেট! অনরা আবারো বিড়বিড় করে বলে, ওর তো মাপা ফুড হ্যাবিট, রেগুলার এক্সারসাইজ করে, অয়ন কী বলে ডাক্তার এসব! মাথায় হাত দিয়ে রাহাতের পাশে বসে পড়ে অনরা। অয়ন তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। মধ্যরাতে একটা টগবগে মৃত লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দুই ভাই-বোন।
অনরা এসব মনে করে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিল যে আজিজ কী বলছিল সে শুনতেই পাচ্ছিল না। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে দেখল রাহাতের কবরে লাগানো কামিনী গাছটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেছে। গভীর বিষাদ নিয়ে সে বলে, অনেক ফুল ফুটেছে চাচা। আজিজ পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে বলে, আব্বাজানে অনেক খুশি আম্মা! মনে আছে আজিজ সেইদিন আরো বলেছিল, এই যে আমরা একলগে এক জায়গায় কিছু মানুষ বাস করি বইলা হেইডারে সমাজ কয়, তাইলে এই যে শত শত মুর্দা পাশাপাশি এক লগে পইড়া আছে হেইডা কি কোনো সমাজ না? এই সমাজেও নিয়মনীতি আছে, সুখ-দুঃখ আছে। মুর্দার সামনে আপনে যখন দুঃখ করেন হে খুশি হয়। ভাবে দুনিয়াতে তারে আপনি ভালোবাসছেন, তার জন্য আপনের মন পুড়ে। মুর্দার জ্যাতা মাইনষের সামনে দেখা দেয়ার নিয়ম নেই, কিন্তু সে সব টের পায়! এই কথাতেই অনরার মাথায় আসে যে রাহাতের প্রিয় ছিল কামিনী ফুল, একটা ঝাঁকড়ানো কামিনী গাছ যদি ওকে ছায়া দেয়, তাহলে ওর ভালো লাগবে। তখন সে আজিজকে কিছু টাকা দিয়ে অনুরোধ করে একটা কামিনী গাছ লাগিয়ে দিতে। সেই কামিনী গাছ এখন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। দুই বছরের ক্ষুদ্র সংসার জীবনে অনরা তার কর্মজীবনের খুঁটিনাটি ঘটনা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সব কিছু রাহাতের সঙ্গে শেয়ার করত। বুকিশ আর ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার কারণে অনরার তেমন কোনো বন্ধু-বান্ধব কোনোকালেই ছিল না, রাহাতই ছিল তার একমাত্র বন্ধু আর এমন একজন কথা বলার মানুষ, যার কাছে সব বলা যায়। রাহাতের মৃত্যু তার কাছে আজো অবিশ্বাস্য! এই তো গেল মে মাসের ২৩ তারিখে রাহাতের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হলো। খুব অনাগ্রহ নিয়ে কাজটা করল অনরা কেবল চারপাশের মানুষ যাতে তাকে ভুল না বোঝে। কিন্তু সে আদৌ রাহাতের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে আগ্রহী নয়, কারণ সে কোনোভাবেই রাহাতের মৃত্যুকে স্বীকার করে না। এটা হয় নাকি, চা বানিয়ে ফিরে এসে যাকে দেখেছে ঘুমিয়ে পড়েছে, তাকে কেন মৃত মানুষ ভাবতে হবে! কই চোখ বন্ধ করলে তো রাহাতের কোনো মৃত্যুর স্মৃতি তার চোখে ভাসে না! তাই সে প্রতিদিন গোরস্তানে এসে আগের মতো তার কর্মজীবন আর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা বলে, বলে তার একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার কথা, এটা বলতেও সে ভোলে নাÑ ‘রাহাত তুমি এমন একটা জায়গাতে থাকো যেই জায়গা আমার মতো ভীতু একটা মানুষকে প্রচ- সাহসী করে তুলেছে! আকাশে বাজ পড়লে আমি ভয়ে তোমার বুকের ভেতরে লুকিয়ে যেতাম, এখন সারা রাত্তিরে বাজ পড়ে, আমি একটুও ভয় পাই না জানো! ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে মোম জ্বালাতেও আলসেমি লাগে, অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকি, তোমার সঙ্গে কথা বলি। আসলে আমার মনে হয় কী জানো, আগের চেয়ে এখন আরো বেশি তুমি আমার সঙ্গে থাকো, তাই আর ভয় করে না! অয়ন প্রায়দিনই রীতিমতো ঝগড়া করে ওর বাসায় নিয়ে যাবে বলে, রিমিও তাই চায়। ওদেরকে আমি কীভাবে বোঝাই তুমি যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্তে ফিরে আসতে পারো, আমার এই বাড়িতেই থাকতে হবে! আমি এসব কথা কাউকে বলতে পারি না রাহাত, একমাত্র আজিজ চাচার সঙ্গে মাঝে মাঝে এসব নিয়ে কথা হয়, কথা হয় বলব না, আজিজ চাচা বলেন, আমি শুনি। কী দারুণ আমার ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় আজিজ চাচার কথা। কিন্তু আমি নিজে যে একই বিশ্বাস করছি, আমি যে বিশ্বাস করছি তুমি সব শুনতে পাও, আমি কখনো আজিজ চাচাকে বলি না! এটা কেবল তোমার আর আমার কথা। আজিজ অনেক আগেই কবরের কাছ থেকে দূরে নিজের ঘরের কাছে চলে গেছে। সে চায় অনরা নিজের কথা সব উজাড় করে রাহাতকে বলুক। মাঝরাতে অনেক মৃত মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়। ৬৮ বছর এখানে বসবাস করে সে অধিকাংশ মৃতের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কথা সে কাউকে বলে না! সে জানে এমন কথা বললে লোকে তাকে পাগল বা ভ- বলে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে এই মেয়েটাকে যেহেতু অসম্ভব স্নেহ করে, তাই সে প্রাণপণে দোয়া করে যেন কোনো একদিন তার স্বামী তাকে দেখা দেয়। তার নিজের কখনো রাহাতের সঙ্গে দেখা হয়নি। সে জানে কোনো না কোনো দিন সময় হলে ঠিকই দেখা হবে। নতুন নতুন কোনো মুর্দাই দেখা দিতে পারার ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, অনেক বছর হয়ে গেলে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করে, পাশাপাশি এও বুঝতে শুরু করে যে আজিজই একমাত্র লোক যে মৃত মানুষের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারে, তখন তারা দেখা দেয়। আজিজের হিসাবমতে, রাহাতের সে সময় এখনো হয়নি! কিন্তু যখন সে দেখা দেবে সে ঠিকই বলবে, আব্বাজান বউ একখান পাইছিলেন, প্রতিটা দিন খালি আপনেরে নিয়াই থাকল, আল্লায় চায় তো আপনে তার কাছে ফিরা যান। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অনরা খেয়াল করল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়, তার অয়নের বাসায় যেতে হবে, ওদের অনেক বিপদ! সে ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে দেখে নিল, সেখানে তেমন কিছু লেখা নেইÑ কাহলিল জিবরানের কয়েকটা লাইন লেখাÑ ‘ইউ উইল বি টুগেদার হোয়েন দ্য হোয়াইট উইংগস অব ডেথ স্ক্যাটার ইওর ডেইজ’। চিঠিটা রাহাতের কবরে গুঁজে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়, তারপর গাঢ় কণ্ঠে বলে, গুডবাই। প্রতিদিন ঠিক এই মুহূর্তটা এলে তার চোখে কোথা থেকে রাজ্যের জল এসে জড়ো হয়, সে সেটাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা না করে হাঁটতে শুরু করে। আজিজের ঘরের কাছে এসে বলে, চাচা আজকে তাহলে যাই। আজিজ ঘর থেকে বেরিয়ে স্ব-¯েœহে বলে, সাবধানে যান আম্মা। টকটকে লাল চোখ নিয়ে একটা মলিন হাসি দিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে। পেছন থেকে আজিজ বলে, মন থেইকা কিছু চাইলে সেইডা একদিন না একদিন ঘটেই আম্মা, আল্লাহ ভরসা। আজিজের কথাটা বেশ গভীরভাবে দাগ কাটে অনরার মনে। পার্কিং লটে রাখা গাড়ির কাছে যেতেই ড্রাইভার একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে দরজা খুলে দেয়। অনরা গাড়িতে উঠে বসে। এই আরেক অস্বস্তিকর মুহূর্ত। রাহাতের মৃত্যুর পর থেকে এই ড্রাইভারটা একটু একটু করে বেয়াদব হয়ে উঠল। যতক্ষণ সে গাড়িতে থাকবে রিয়ার ভিউ মিররে সে একটু পরপর অনরার দিকে লক্ষ করবে। দু’দিন সুপারশপ থেকে আনা বাজারের ব্যাগ দিতে গিয়ে ইচ্ছে করেই তার হাত স্পর্শ করে দিল। ব্যাপারটা এতটাই ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে যে, অনরা মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে দেবে। কিন্তু এসব অভিযোগ তুলতে গেলে নিজেকেই অসম্মান করা হয়। তাই সে অপেক্ষা করছিল ভালো কোনো সুযোগের। তবে আজকে সে পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে আগামী মাস থেকে আর কোনো ড্রাইভারই রাখবে না। বিশ্ববিদ্যালয়, গোরস্তান আর বাড়ি ছাড়া তার কোথাও তেমন একটা যাওয়া হয় না, এটুকু ড্রাইভিং সে নিজেই করতে পারে। পাথরের মতো কণ্ঠে সে ড্রাইভারকে বলল, ইস্কাটন যাও। ড্রাইভার চুইংগাম চিবাতে চিবাতে বলল, কই যামু অয়ন ভাইয়ার বাড়ি? তার কথার কোনো উত্তর দিল না অনরা। ড্রাইভার নির্বোধ শয়তানের মতো একটা হাসি দিয়ে হুশ করে সামনে টান দিল।

চার.
হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠল রিমি। সে অয়নকে ডাকলÑ আরে এদিকে এসো, এদিকে এসো। অয়ন কিচেনে কিছু একটা করছিল, এক দৌড়ে সে রিমির কাছে চলে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কী হয়েছে, কী হয়েছে রিমি! রিমি তার হাত টেনে নিয়ে নিজের পেটে দিয়ে চাপা আনন্দ নিয়ে বলল, দেখ নড়ছে, অয়নও নড়ছে ! অয়ন রিমির পেটে বাচ্চার নড়াচড়া অনুভব করে বলল, ও তো নড়বেই, জাস্ট খাওয়াটা কম পাচ্ছে এই যা! এভাবে কেউ ডাকে, আমি ঘাবড়ে গিয়েছি! অয়নের হাত আঁকড়ে রিমি বলে, ‘আমার বাচ্চাটা আরো এক সপ্তাহ না খেয়ে থাকবে অয়ন’! অয়ন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, এভাবে ভাবে না বোকা, সব ঠিক হয়ে যাবে। দরজার বেল বেজে ওঠে, অয়ন গলা চড়িয়ে কাজের মেয়েটােেক ডাকেÑ রতœা, রতœা দরজাটা খোল। রতœা কোনো উত্তর দেয় না দেখে সে নিজেই উঠে যায়। দরজা খুলে সে অনরাকে দেখে বলে, কী হয়েছে আপা, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন! অন্যমনস্ক অনরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ? হুমম...কই কিছু না তো, রিমি কোথায়? অয়ন বলে বেডরুমে, রেস্ট করছে। অনরার হাতভর্তি আইসক্রিম, আর ফলমূল। রতœা কোত্থেকে এসে সেসব অনরার হাত থেকে নিয়ে খুশি খুশি গলায় বলে, খালা শ্যাষম্যাশ আইন্নে আইছুন! অনরা বলে কেমন আছিস তুই? তোর জন্যে কাউফল আর লটকন এনেছি, খাস। রতœা আনন্দে রীতিমতো চিৎকার দিয়ে উঠে বলে, কাউফল আইনছুন খালা...,উমা লটকনও আইনছুন! তারদিকে তাকিয়ে হেসে সে ভেতরের দিকে চলে যায়। অনরাকে দেখে উঠে বসতে যায় রিমি। তাকে থামিয়ে দিয়ে তার কাছে গিয়ে বসে অনরা। তারপর বলে, এবার বলো তো ডাক্তার কী বলেছে? রিমি আর অয়ন মিলে ব্যাপারটা অনরাকে সবিস্তারে বলে। সব কিছু শুনে অনরা বলে, ডাক্তারকে তো আমার লজিক্যাল মনে হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে না এতে কোনো বিপদ হওয়ার কথা! রিমি বলে, আপু তারপরও আমাদের দেশের যেই অবস্থা, বলা তো যায় না আগেভাগে একটা ভয় দিয়ে সিজারিয়ান করার জন্য ডাক্তার এটা বলছে। অনরা বলে, কেন তোমরা না এই ডাক্তারের অনেক প্রশংসা কর। একটু দ্বিধায় পড়ে যায় রিমি, সে বলে, হ্যাঁ সেটাও ঠিক! তাছাড়া আমার নরমাল ডেলিভারির পেইন নেয়ার সাহস নেই বলে আমি নিজেই বলে রেখেছি সিজারিয়ান করতে চাই, উনিই উল্টো ধমক দিয়ে বলেন, যদি নরমাল হয়, তাহলে অযথা সিজারিয়ান করতে কেন হবে।’ অনরা বলে, তাহলে শুধু শুধু এই দুশ্চিন্তা কেন! অয়ন বলে, না করতে চাইলেও দুশ্চিন্তা চেপে বসে আপা। অনরা ওদের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বলে, আচ্ছা শোন আমার একটা স্কুল ফ্রেন্ড ছিল রিপা, ও নাকি বেশ নামকরা গাইনোকোলজিস্ট। আমার সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ হয় না। তবুও তোরা ওভার কনফার্ম হওয়ার জন্য যদি ওকে দেখাতে চাস, আমি বলে দিতে পারি। রিমির চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠেÑ সে বলে তাহলে খুব ভালো হয় আপু। অনরা সঙ্গে সঙ্গে রিপাকে ফোন দিয়ে ওদের দেখানোর ব্যাপারটা কনফার্ম করে দেয়। অয়ন বলে আপা রাতে খেয়ে যাও, আমি খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ রান্না করছি। অনরা বলে, তোর রান্না মুখে তোলা যাবে তো! অয়ন বলে, আরে খেয়েই দেখ না, যে কোনো বড় শেফের চেয়ে কম না আমার রান্না। অনরা বলে এই জন্যই তো সাকুল্যে পারিস একটাই রান্না, খিচুড়ি। অয়ন বলে, ওটা আমার স্পেশাল আইটেম। বলে সে কিচেনের দিকে চলে যায়। রিমি অনরার দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বলে, আপু জানেন ও একটু আগেও জোরে জোরে পেটে লাথি মারল! মাঝে মাঝে এমন জোরে লাথি মারে যে মনে হয় এক্ষুনি পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে! অনরা কেমন যেন দূরাগত কণ্ঠে বলে, মা হওয়ার ফিলিংটা আসলে কেমন রিমি, তুমি এটা এক্সপ্লেইন করতে পারো? রিমি প্রশ্নটাতে একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর বলে এটা এমন এক অদ্ভুত ফিলিং আপু, চাইলেই এক্সপ্লেইন করা যায় না! খুব কৌতূহলী ভঙ্গিতে অনরা বলে, না ধর প্রথম যেদিন তুমি জানলে যে তুমি মা হচ্ছো, তখন তো সেই অর্থে ওর কোনো অস্তিত্বই ছিল না, জাস্ট একটা স্পার্ম আর এগের মিলিত রূপ হিসেবে অ্যানাদার মাইক্রো ডট। অথচ খালি চোখে দেখতে না পাওয়া এই অলমোস্ট অস্তিত্বহীন একটা প্রাণের উপস্থিতিকে তুমি নিজের সন্তান হিসেবে জানো, সেটাই তোমাকে সুখী করে, মা হতে তোমাকে রেডি করে। এটার নাম কিন্তু বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই কিন্তু এই অতি ক্ষুদ্র কণাটাকে তিলে তিলে তোমার সন্তানকে মানুষ হিসেবে তৈরি করতে থাকে। প্রথমে তার একটা হার্ট তৈরি হয়, ধীরে অতি ধীরে ৯টা মাস ধরে একটু একটু করে বাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরি হতে থাকে। ৯টা মাস তুমি প্রতিটা সেকেন্ড অপেক্ষা কর এই সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবে বলে! হঠাৎ অনরার এই জাতীয় কথাবার্তায় একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় রিমি। তবুও সে আন্তরিক আগ্রহে অনরার কথা শুনতে থাকে। তারা সবাই জানে অনরার কথা বলা দরকার! কথা বলতে বলতে সে একদিন হয়তো তার এই শোক কাটিয়ে উঠবে! অনরা বলে যেতে থাকেÑ যেই সন্তান তোমার পেটের ভেতর সব থেকে বেশি নিরাপদ, তাকে তুমি নাড়ি কেটে বাইরে নিয়ে আসো, আতঙ্কে সে কাঁদে! সে সবসময় তোমার সঙ্গে মিশে থাকতে চায়, তোমার উষ্ণতা তাকে আশ্বস্ত করে তুমি আছ। এরপর পুরোটা সময় তুমি তাকে একা থাকার শিক্ষা দিতে দিতে বড় করতে থাক। প্রথমে সে একটা বেবি কটে থাকে, পরে আরো বড় হয়ে গেলে আলাদা ঘরে থাকে। আর যখন তার চলে যাওয়ার সময় হয়ে আসে আমরা তাকে রেখে আসি অন্য এক ঠিকানায়, যেখানে আছে অন্তহীন নিস্তব্ধতা! জন্ম আর মৃত্যুর জার্নিটা কিন্তু একই রকম রিমি। নাড়ি কেটে একজনকে আমরা আলো দেখাই, সব মায়া ছিন্ন করে তাকে আমরা রেখে আসি অতল অন্ধকারে। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে এই বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারটা কিন্তু কমন! বোবা হয়ে রিমি অনরার কথা শুনছে, ভীষণ মায়া হচ্ছে তার অনরার জন্য! এভাবে কথা বলা অনরার ব্যক্তিত্ব বিরুদ্ধ, সেটা খেয়াল হতেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, কি যা-তা কথা বলা শুরু করে দিয়েছি তোমার সঙ্গে দেখ তো! আমি অয়নের একটা খোঁজ নিয়ে আসি, কি খিচুড়ি রান্না করছে গড নোজ! রিমি বলে, ও ভালোই রান্না করে আপু। আজকাল তো পারতপক্ষে আমাকে কিচেনেই ঢুকতে দেয় না। আরেকজন আছে আমার মা, প্রতিদিন গাদা গাদা খাবার রান্না করে পাঠায়। এ তো বলি যে তিনজন মানুষের জন্য এত খাবার দিও না, কে শোনে কার কথা! অয়ন এসে বলে রান্না শেষ। গন্ধ পাচ্ছ আপা? বলেই নিজেই আহা-উহু শুরু করে। এটা দেখে হেসে ফেলে অনরা। অয়ন বলে, আপা আমরা এখানে বসেই খেয়ে ফেলি, ওর এখন বিছানা থেকে না ওঠাই ভালো। রিমি ব্যস্ত হয়ে বলে, আরে না, তোমরা ডাইনিংয়ে আরাম করে খাও, আমি পরে খেয়ে নেব। অনরা বলে, তুই খাবার-দাবার সব নিয়ে আয় তো, এখানেই বসে একসঙ্গে খাব। অয়ন রতœাকে বলে সব খাবার-দাবার নিয়ে আসতে। অনেকদিন পর আপনজনদের সঙ্গে এক খাটে বসে খেয়ে খুব ভালো লাগে অনরার! খাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করে দিল অনরা। সন্ধ্যার পর বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে তার অস্থির লাগতে লাগে। এই অস্থিরতা কারো সামনে প্রকাশ না করার ব্যাপারে সে যথেষ্ট সচেতন এবং এই অস্থিরতার কারণ সে জানে।
আসলে রাহাতের মৃত্যুকে মৃত্যু হিসেবে মেনে নেয়া অনরার জন্য আজো অনেক কঠিন। সে তো কিচেনে চা আনতে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে রাহাত ঘুমিয়ে গেছে! এর থেকে গুরুতর কোনো স্মৃতি তো তার মাথায় নেই। যদি এমন হতো দীর্ঘদিন রাহাত কোনো অসুস্থতায় ভুগছিল, যদি এমন হতো রাহাতের ক্যান্সার বা কিডনি ড্যামেজড বা সে কোনো রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে, সেটাকে একবাক্যে মৃত্যু হিসেবে মেনে নেয়া যেত! কিন্তু একজন পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ ঘুমিয়ে আছে, তাকে মৃত বলে মেনে নেয়া যায়! এই কারণেই সন্ধ্যার পর তার অস্থিরতা শুরু হয়, মনের গভীরে অতি গভীরে এক ধরনের অপেক্ষা কাজ করে, মনে হয় একদিন বাড়ি ফিরে দেখবে রাহাত ময়লা জুতো নিয়ে বিছানায় শুয়ে বলছে, ‘মাতাল স্বামী বাজে পাড়া থেকে ফিরেছে, দুঃখিনী বধূ চোখে জল নিয়ে এখন তার জুতো খুলে দেবে’, অথবা দেখবে ‘তাকে খ্যাপানোর জন্য ইচ্ছে করে নাকের লোম টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করছে’। নিজের মনে তো যা খুশি ভেবেই নেয়া যায়। কিন্তু তার বিজ্ঞান মনস্ক মন একপর্যায়ে তাকে শাসন করতে চায়, তাকে বলে অ্যাকসেপ্ট দ্য রিয়েলিটি অনরাÑ ‘একদিন তুমিও থাকবে না, কেউ বেঁচে থাকবে না পৃথিবীতে’। কিন্তু সেই বিজ্ঞানেরই গভীর বিশ্লেষণ আজকাল রাহাতের কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকার ফ্যান্টাসিকে সত্য প্রমাণ করার পাঁয়তারা করে। ক্লাস এইটের বিজ্ঞান বইয়ের কথা তার মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় শক্তির নিত্যতার সূত্রÑ ‘শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি কেবল এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে প্রতিস্থাপিত হয়।’ আবার জিনতত্ত্বের শিক্ষিকা হওয়ার কারণেও সে জানে দেহের মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিএনএ, আরএনএ পুনর্বিন্যস্ত হয়, এই পুনর্বিন্যস্ত সত্তা মর্তলোকেই রয়ে যায়। কিন্তু এই বিন্যাস প্রক্রিয়ায় মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই যে চলে যায়, সে চিরতরেই চলে যায়! হুট করে হাসিও পায় এই ভেবে, যদি এই বিন্যাস প্রক্রিয়ায় মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকত তাহলে সবাই তার মৃত প্রিয়জনকে আবারো জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনত, তখন কী বিপত্তিই না ঘটত পৃথিবীতে! নতুন প্রজন্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন পৃথিবীও তৈরি হতে হতো। বিজ্ঞান আবারো তাকে শাসন করেÑ অ্যাকসেপ্ট দ্য রিয়েলিটি অনরা, ইউ হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট দ্যা রিয়েলিটি। হাহ্, আবারো সূক্ষ্ম একটা মুচকি হাসি খেলে যায় তার চোখেমুখে, ঝলমল করে ওঠে সে, নিজেই শুনতে পায় মনের ভেতরে উইন্ডচাইমের শব্দ হচ্ছে, অসংখ্য অযৌক্তিক মুহূর্তের মতো সে আবারো নিশ্চিত হয়ে যায়, পায়ের জুতো সমেত বিছানায় শুয়ে, ম্যানইউ ভার্সাস রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখতে দেখতে চিৎকার করছে রাহাত। সুতরাং ভাইয়ের বাড়ি আর এক মুহূর্তও নয়। এই রাতটা শুধু থেকে যাওয়ার জন্য রিমি কেবল তার পা ধরতে বাদ রাখে, তবুও সে শুনবে না। অয়ন নিজের বোনকে খুব ভালো করে জানে বলে খুব বেশি জোরাজুরি করে না, শুধু বলে, রাতটা থেকে গেলেই পারতে আপা, ও এত করে বলছে! অনরা বলে না রে, লেকচারশিট রেডি করতে হবে বাসায় গিয়ে, সকালে ক্লাস। গাড়ি পর্যন্ত অনরাকে এগিয়ে দিয়ে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে ভেতরে চলে আসে অয়ন। ঘড়ি দেখে বলে, ওরে বাবা, সাড়ে ১০টা বেজে গেছে! চল শুয়ে পড়ি, রাত জাগা যাবে না। টুকটাক হাতের কাজ সেরে, বেডসাইড টেবিলের বাতি জ্বেলে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে রিমির পাশে এসে শোয় সে। একটা দম নিয়ে রিমি বলে, যাই বল আপুকে এভাবে তোমাদের একা রাখা ঠিক হচ্ছে না! অয়ন হতাশ হয়ে বলে, আপা নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে এক চুলও নড়ার মানুষ না, ও নিজে না চাইলে ওকে কেউ কিছু বোঝাতে পারবে না! রিমি বলে, তুমি যখন কিচেনে ছিলে, তখন আপু আমাকে এত বিচিত্র সব কথা বলা শুরু করল, আমার কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক লাগেনি! অয়ন অবাক হয়ে বলে, কী বলেছে! রিমি অনরার বলা কথাগুলো অয়নকে বলল। খুবই চিন্তিত মুখ নিয়ে অয়ন বলল, কথা তো একটাও অযৌক্তিক বলেনি, কিন্তু ভাবনাগুলো এতটাই জটিল যে, সেটাকে স্বাভাবিক ভাবলে ভুল হবে বলেই মনে হচ্ছে! রিমি বেশ আশাবাদী হয়ে বলে, আপাকে কিছুদিন কানাডায় বড় ভাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলে হতো না, মাও ছিলেন সেখানে! অয়ন বলে, সে চেষ্টা আমি কম করেছি নাকি! কী অদ্ভুত কা- দেশে এই সমস্যা সেই সমস্যা বলে যে দেশে থাকতেই চাইত না, রাহাত ভাই সমেত কানাডা সেটেল করার জন্য যে উঠেপড়ে লাগল, সে এখন দেশ ছেড়ে কোথাও নড়তে চায় না! রিমি বলে, যা-ই বল, ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগছে না, সময় থাকতে আমাদের কিছু একটা করা উচিত। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অয়ন স্ত্রীর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে সিলিংয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।

পাঁচ.
সরুকণ্ঠে দূর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। এই শব্দে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আজিজের! বৃদ্ধ বয়সের ঘুম এমনিতেই খুব পাতলা, তার ওপরে এই কান্নার উৎপাত সহ্য হয় নাকি! ৬ ব্যাটারির পুরনো টর্চলাইটটা হাতে নিয়ে রাজ্যের বিরক্তি সমেত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে আজিজ। মধ্যরাত, এমনিতেই শহর নিঝুম, গোরস্তানের নির্জনতা একটু বেশিই তীব্র! নিরেট নিস্তব্ধতা ভেদ করে, দূর থেকে ভেসে আসছে রাত্রি জাগা কুকুরের করুণ চিৎকার। গোরস্তানে লাশ চুরি করা শেয়ালেরও তো অভাব নেই, তারাও যে যার মতো ডেকে চলেছে। এসব শব্দ ভেদ করে মানব শিশুর কান্না ঠিকই ভেসে আসছে আজিজের কানে। হাতে টর্চ থাকা সত্ত্বেও সেটা জ্বালানোর কথা মনে নেই আজিজের, অথবা সে সহসা টর্চ জ্বালাতে চায় না। তার ধারণা আলোতে মুর্দাদের কষ্ট হয়, তাই খুব একটা দরকার না হলে টর্চ জ্বালে না সে। হুম গোরস্তান কর্তৃপক্ষের দেয়া কিছু বড় স্ট্রিট ল্যাম্প ঠিকই আছে, কিন্তু আজিজ যেদিকে থাকে সেদিকটা একটু অন্ধকারই বটে। তবুও খুব দরকার না পড়লে আজিজ টর্চ জ্বালায় না। কান্নার সূত্র ধরে আজিজ সামনে এগোতে থাকে। একটু দূরে কাফনের কাপড় পরিহিত কিছু মুর্দা তাকে আসতে দেখে কবরে ফিরে যায়। এসব দেখে মোটেও চমকায় না আজিজ। এসবের সঙ্গেই ৬৮ বছর ধরে তার বসবাস। রাতের অন্ধকারে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বেরোলে প্রতিদিনই কারো না কারো সঙ্গে দেখা হয় তার। কিন্তু কখনো কারো সঙ্গে কথা হয় না। শত হলেও আজিজ একজন জীবিত মানুষ, মৃতরা তাকে বিশ্বাস কেন করবে! অবশ্য ৬৮ বছর ধরে তাকে দেখতে দেখতে একটু-আধটু বিশ্বাসও মুর্দারা করে বলেই বিশ্বাস আজিজের। মৃতদের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কেও কম-বেশি ধারণা রাখে সে। মৃতরা কেউ কখনো দলবদ্ধ হয় না। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। ক্ষুধা-তৃষ্ণার ব্যাপার না থাকায় তাদের কোনো কর্মব্যস্ততা নেই, তাই হাঁটার গতি হয় শ্লথ। কেবল রাতের অন্ধকারে তারা কেউ কেউ বেরিয়ে আসে। তখন তার প্রিয়জন যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের প্রশ্বাস সে অনুভব করতে পারে। পৃথিবীর সঙ্গে এই সংযোগটুকু ছাড়া আর কোনো সংযোগ অনুভব করার ক্ষমতা তাদের থাকে না। তবে প্রিয়জনের সঙ্গে প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ার এই ক্ষমতা এতটাই তীব্র যে, কেবল সেই প্রশ্বাসের সূত্র ধরে তারা নতুন প্রজন্মকেও চিনতে পারে, চিনতে পারে নিজের প্রতিটি কোষের অনুলিপি। পৃথিবীতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিচরণের নিয়ম থাকলেও এখানে সময়ের কোনো ছক নেই, এটা এক অসীম জগৎ, প্রতিটি মুহূর্ত এখানে অপরিমাপযোগ্য। কান্নার শব্দ বেড়েই চলেছে। শব্দের সূত্র অনুসরণ করে সামনে এগোতে থাকেন আজিজ। চলার পথে আরো দু-একজন মুর্দার সঙ্গে দেখা হয় তার। তিনিও কোনো কথা বলেন না, মুর্দারাও নিঃশব্দে কবরে মিলিয়ে যায়। কান্নার শব্দ উত্তর দিক থেকে আসছে দেখে সেদিকেই এগোয় আজিজ। যত এগোচ্ছে, তত বেশি স্পষ্ট হচ্ছে কান্নার শব্দ। আরো কিছুদূর হাঁটার পর কান্নার উৎস খুঁজে পায় সে। পুরনো একটা কবরের পাশে শতছিন্ন কাফনের কাপড় গায় জড়িয়ে ৭-৮ বছর বয়সী একটা মেয়ে শিশু কাঁদছে। কবরটা আজিজের চেনা। এদিকে সব কবরই তার চেনা। ৬ জন গোর খোদকের মধ্যে আজিজ সব থেকে প্রবীণ। কেবল তার জন্যই একটা ছনের ঘর আছে, বাকিরা যে যার মতো থাকার ব্যবস্থা করে নেয়। গোরস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশের দায়িত্ব তার। এই শিশুর কবরটি বছর ছয়েক আগে তিনিই খুঁড়েছিলেন। মনে আছে কবরের কাছে তার মা বিলাপ করতে করতে বলছিল, আমাকেও ওর সঙ্গে দিয়ে দাও! দাফনের সময় স্ত্রীলোকের থাকার নিয়ম নেই, কিন্তু তার মাকে রাখতে বাধ্য হতে হয়েছিল। শিশুটিকে কবরে শোয়ানোর পর বুক ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার মা বলেছিল, একটাবার আমার প্রাণের ধনকে তোমরা দেখতে দাও। সবাই মিলে তাকে ধরে বোঝাচ্ছিল কবরে নামানোর পর মুর্দার মুখ দেখানোর নিয়ম নেই। আজিজ গোর খোদক, প্রিয়জনের বিলাপ শুনেই সে অভ্যস্ত, এসব তাকে সহসা স্পর্শ করে না। হঠাৎ কী হলো কাউকে কিছু না বলে নীরবে সে শিশুটির মুখের কাপড় খুলে দিল। নিষ্পাপ শিশুটি নিথর পড়ে আছে ঘুমের অতলে! তখন তার মায়ের কান্নায় আর কোনো শব্দ হচ্ছিল না। মায়ের চোখের সামনে অসংখ্য হাত থেকে পড়া মাটি ঢেকে দেয় প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে! এতগুলো বছর পর শিশুটিকে দেখেই চিনতে পায় আজিজ। সে কান্না থামিয়ে তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে আজিজের দিকে। একটু অবাক হয় আজিজ। মুর্দাদের সঙ্গে তার দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু তারা তাকে দেখলে কবরে মিলিয়ে যায়। আর এই শিশু তীব্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকে তার কাছে। সে শাসনের সুরে বলে, কিরে কব্বর থেইকা বাইরাইছোশ ক্যান? স্পষ্ট শীতল কণ্ঠে শিশুটি বলে, আমি মায়ের কাছে যাব। মায়ের কাছে যাবি মানে! এই খানে একবার আইলে আর ফিরনের নিয়ম নাই, জানস না তুই? আমার মায়ের ডাক আমি শুনতে পেয়েছি, আমি মায়ের কাছে যাব, মা সবসময় আমাকে ডাকে, আমি এখন তাকে শুনতে পাই, আমি মায়ের কাছে যাব! আজিজ বুঝতে পারে টর্চ না জ্বেলে আর উপায় নেই, এটাই ওকে কবরে ফেরত পাঠানোর একমাত্র উপায়। টর্চ জ্বেলে সে সরাসরি শিশুটির চোখে ধরে। স্তব্ধ হয়ে যায় আজিজ, টর্চ জ্বালানোতে শিশুটির অভিব্যক্তিতে সামান্যতম পরিবর্তনটুকুও হয় না! সেই একই তীব্র দৃষ্টি নিয়ে আজিজের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আমি মায়ের কাছে যাব। আজিজ বিরাট কোনো অনর্থ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় জোর করে শিশুটিকে কবরে ফেরত পাঠানোর জন্য শিশুটির হাত ধরতে যায়। এক ঝটকায় শিশুটি তার হাত কামড়ে দেয়! আর্তনাদ করে উঠে বসে নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করেন আজিজ! ধাতস্থ হতে একটু সময় নিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, এতক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন! আমকাঠের তেলতেলে কালচে টেবিলে রাখা পুরনো অ্যালুমিনিয়ামের জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে বাম হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথার জায়গায় হাত গিয়ে একেবারেই হতচকিত হয়ে যান আজিজ। তার হাতে স্পষ্ট ছোট ছোট দাঁতের গাঢ় ছাপ। আর কালক্ষেপণ না করে জায়নামাজ নিয়ে তাহায্যুতের নামাজে দাঁড়িয়ে যান তিনি!

ছয়.
কার্জন হলের বাইরের বাসস্টপে একটা-দুটো করে অসংখ্য লাল রঙের দোতলা বাস জড়ো হয়েছে। সকালের দিকে আর বিকেলের হেলেপড়া রোদে এই জায়গাটা দেখতে অন্যরকম লাগে। বিআরটিসির পুরনো ডিজাইনের লাল ডাবলডেকার বাসগুলো যখন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মনে হয় এটা কলকাতার কোনো বড় বাজেটের সিনেমার সেট। বাস থেকে আটপৌরে শাড়ি, কাঁধে একটা রুকস্যাক, পায়ে কলাপুরি চটি পরে নেমে আসবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই অনাবিষ্কৃত ‘নীরা’। হাতে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে কবি টাইপের কোনো এক যুবক দাঁড়িয়ে থাকবে তার অপেক্ষায়। তাকে দেখে বন্ধুরা বলবেÑ ‘কী হয়েছে, হাতে ব্যান্ডেজ কেন!’ তখন সে উদাস হয়ে বলবে, ‘এই হাত ছুঁয়েছিল নীরার মুখ। এই হাতে এই নশ্বর পৃথিবীর ধুলোবালি যাতে না লাগে তাই ব্যান্ডেজ করে রেখেছি।’ বাস থেকে নামতে গিয়ে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল ত্রেতা। এটা তার নিত্যদিনের ভাবনা ভাবনা খেলা। সে খুব ভালো করেই জানে তার এই ভাবনার ধারেকাছ দিয়েও কোনো কিছু ঘটার সম্ভাবনা অন্তত এই কার্জন হলে নেই। এখানকার ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতিই এমন যে, কোনো খারাপ ছাত্র এখানে ভর্তি হওয়ারই কোনো সুযোগ নেই। তার মানে এই না যে, কাব্যিক জীবনযাপন করে খারাপ ছাত্ররা। মানে বিজ্ঞানের ছাত্রদের সমস্ত সময়টা ব্যয় হয়ে যায় লেখাপড়ায়, সেখানে কাব্য করার সুযোগ কোথায়! তাই কার্জন হলের ছেলে-মেয়েদের ভেতরে প্রেম হলে সবাই মজা করে বলে, ইহা একখানি বৈজ্ঞানিক প্রেম। আজকে বাস থেকে নামতে গিয়ে নিজের অজান্তে ফিক করে হেসে ফেলার কারণ অবশ্য অন্য। বাস থেকে নামার ঠিক আগমুহূর্তে তার কাল্পনিক ব্যান্ডেজ করা যুবকের জায়গায় সে ড. জিভাগো, মানে জায়েদকে দেখতে পেল! যথেষ্ট ম্যাচিওরড মেয়ে ত্রেতা এবং যথেষ্ট ক্যারিয়ারিস্টও বটে, প্রেম বা ইনফ্যাচুয়েশন তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই তার হাসি পেয়ে গেল। মানুষের মন কী বিচিত্র, কতই না ভাবনা খেলে যায় যখন-তখন! সব ভাবনাকে প্রশ্রয় না দেয়াটা একজন বুদ্ধিমান মানুষেরই লক্ষণ। ত্রেতা যেহেতু যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, ক্ষণিকের এই ভাবনাটুকু তাই লাল দোতলা বাসের পোড়া ডিজেলে বিসর্জন দিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে লাগোয়া গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকেই ফটোকপি মেশিনের দিকে এগিয়ে গেল। অনেক কিছু ফটোকপি করতে হবে আজকে। এত সকালে আসার পরও ফটোকপির দোকানে লম্বা লাইন! সকালে নাশতা না করায় খিদেও পেয়ে গেছে। ফটোকপির দোকানের মনির মামার সঙ্গে তার বেশ খাতির। সে মনিরের কাছাকাছি গিয়ে বলল, মনির মামা, মনির মামা...! ফটোকপি নিয়ে ব্যস্ত মনির তাকে একটা হাসি দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগল। হাত থেকে একগাদা কাগজ নিয়ে ত্রেতা মনিরের দিকে বাড়িয়ে বলল, মামা একটু ফ্রি হলে ফটোকপিগুলো করে রেখেন, আমি পরে এসে নিয়ে যাব। কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ত্রেতার হাত থেকে কাগজগুলো মনির রেখে দিল। ত্রেতা ক্যান্টিনের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে সে দেখল ডঃজিভাগো সেই একই অধ্যাপকসুলভ হাঁটার ভঙ্গি নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। তার হাতে রুবিক কিউব টাইপের কিছু একটা আছে, সেটা সে এমন নিবিড় মনোযোগের সে ঘোরাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই এবং যথারীতি আজো সে সেই একই পোশাক পরাÑ বেলবটম টাইপের প্যান্ট আর সাদা শার্ট, চুল সেই একইভাবে পাট পাট করে আঁচড়ানো। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে, ‘এখানে সময় স্থির’! তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে গিয়ে নিজেকে নিবৃত করল ত্রেতা। নিবৃত করেই সে নিজের ওপর আবারো বিরক্ত হলো! আসিফ আর তমালের সঙ্গে তো সে কোনো দ্বিধা নিয়ে মেশে না। তাহলে এই ছেলের ক্ষেত্রে দ্বিধা কাজ করবে কেন! সে আবারো ড. জিভাগোকে ডাকতে গেল, কিন্তু তাকিয়ে দেখল সে সেখানে নেই, চলে গেছে! একটু হতাশই হলো মনে হয় ত্রেতা। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে গটগট করে হেঁটে গেল ক্যান্টিনের দিকে।
দুটো সিঁড়ি টপকে পুরনো ইটের মেঝেতে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল জায়েদ। সে সাধারণত নিজের জন্য সময় বেঁধে দিয়ে রুবিক কিউব মেলাতে শুরু করে। সময়মতো মেলাতে না পারলেই নিজেকে পরাজিত বলে ধরে নেয় সে। তবে পরাজিত হওয়ার ঘটনা কম দিনই ঘটে থাকে। আজকেও সে নিজের বেঁধে দেয়া সময়ের দু’মিনিট আগেই সেটা মিলিয়ে ফেলেছে। পুরনো চামড়ার ব্যাগে নিজের ল্যাপটপটাও সঙ্গে আছে তার। দরজায় নামফলক দেখে নিল একবার, সেখানে লেখাÑ ‘অনরা মালিক’ সহযোগী অধ্যাপিকা, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। রুবিক কিউবটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতের দু’আঙুল দিয়ে ঠকঠক করে দরজায় টোকা দিল সে। ভেতর থেকে রাশভারী কণ্ঠে সে বলল, ইয়েস, কাম ইন।’ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একেবারে আরবীয় কায়দায় জায়েদ বলল, আস্সালামু আলাইকুম ম্যাম। তার দিকে না তাকিয়েই ওয়ালাইকুম আস্সালাম বলে একই রকম গাম্ভীর্য নিয়ে তিনি বললেন, কী ব্যাপার, আমি তো ক্লাসে কিছু বাদ রেখে পড়াই না, তাহলে এখানে কেন? ম্যাম আমি আসলে অন্য একটা বিষয় নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলাম। অনরা নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চায়Ñ কী বিষয় নিয়ে কথা? জায়েদ বলে, ক্যান আই সিট হিয়ার ম্যাম? অনরা বলে, হ্যাঁ বসো। বসতে বসতে জায়েদ জিজ্ঞেস করেÑ ম্যাম আপনি কখনো রুবি কিউব মিলিয়েছেন? প্রশ্নটা শুনে স্পষ্টতই বিরক্ত হয় অনরা। কিন্তু কোনো বিষয়ে সহসা রিঅ্যাক্ট করা তার স্বভাববিরুদ্ধ, তাই সে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়Ñ ‘না’ জায়েদ অনরার গাম্ভীর্যের পরোয়া না করেই বলতে থাকেÑ রুবিক কিউব কিন্তু অল অ্যাবাউট পারমুটেশন-কম্বিনেশন। যে এটা মেলাতে পারে সে জানে কোন কোন কম্বিনেশনে এটা মিললÑ আর যে এটা মেলাতে পারে না সে ভাবে এটা কোনোদিনও মেলানো সম্ভব না। এই ভাবনার ওপর বেইজ করে আমি আমার বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া এক বন্ধু আর চারুকলার এক বন্ধুকে নিয়ে একটা গেম ডিভেলপ করেছি, গেমটা আপনাকে একটু দেখাতে চাই। এটা শুনে অবাক ও বিরক্ত দুই-ই হলো অনরা। সে বলল, তোমার কেন মনে হলো যে তোমার একটা গেম টাইপের জিনিস আমাকেই দেখাতে হবে। জায়েদ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, কারণ গেমটা আপনার সাবজেক্ট রিলেটেড। গেমটার নাম ‘মেক ইওর ওন কপি’। এবারে সত্যি সত্যিই অবাক ও কৌতূহলী দুই-ই হলো অনরা। সে বলল, আচ্ছা দেখাও। রোবটের মতো চেহারা নিয়ে চামড়ার ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করল জায়েদ। ল্যাপটপ অন করতে করতে সে তার গেমটা নিয়ে বর্ণনা করতে লাগলÑ ম্যাম আমরা জিনের অঞ্চলগুলো জানিÑ যার মধ্যে একটা হলো আইডেন্টিফায়বল এরিয়া, যা বংশগতির একক ধারণ করে, তারপর আছে কন্ট্রোলিং এরিয়া, একটা আছে কপিইং এরিয়া, যেখানে প্রতিলিপি তৈরি হয়। ল্যাপটপ অন হওয়ার শব্দ শোনা যায়। অনরা দীর্ঘদিন অবাক হতে ভুলে গিয়েছে, তবুও এই ছেলের কর্মকা- অবাক হওয়ার মতোই বটে। সে বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল জায়েদ কী গেম দেখায়! জায়েদ ইতোমধ্যেই তার গেমে ক্লিক করেছে, সেখানে লোডিং দেখাচ্ছে। সে আবারো বলে, ম্যাম এ সবই আপনার জানা, তবুও গেমটার ধরন বোঝানোর জন্য আপনাকে কিছু ব্রিফ দিচ্ছি। আমার এই গেমে একটা চার বেসের ডুয়েল ডিএনএ’র রাসায়নিক গঠনের ভার্চুয়াল ইমুলেশন আছে। বাস্তবের মতো এখানেও বড় জিনগুলো এক ধরনের নিউক্লিয়ার প্রতিলিপি, যা ৫০০ কেবি (১ কেবি=১,০০০ বেস পেয়ার) বা ক্রোমোজোমাল ডিএনএ’র সমান। বড় জিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জিনটি এখানে ইমুলেটেড করা হয়েছে ডিস্ট্রোফিনের জন্য, যা ২.৩ এমবির চেয়ে বড়। এসব শুনতে শুনতে একটু নড়েচড়ে বসে অনরা। এখানে আমরা মেন্ডেলিও জেনেটিক-তত্ত্ব, এনভায়রনমেন্টাল সিলেকশন, আর নেক্সট জেনারেশন বিষয়ক ক্রোমোজোম তত্ত্বের মধ্যে যে যোগসূত্র আছে সেটাকেও ব্যবহার করেছি। গেমটা অনরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলে, ডায়লগ বক্স আর অ্যানিমেশনগুলো দেখলেই আপনি গেমটা বুঝে যাবেন। দীর্ঘদিন পর ভীষণ কৌতূহল নিয়ে অনরা গেমটা দেখতে লাগল। গেমের শুরুতেই দেখা যায় কাপড় দিয়ে মুখ বাঁধা একদল সৈন্য যিশু খ্রিস্টের চেহারার মতো একজন মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। দৃশ্যটা একটা প্রকা- বাজপাখি দেখে, সে উড়ে এসে তার ধারালো ঠোঁট দিয়ে দড়ি কেটে মৃত দেহটাকে অবমুক্ত করে চলে যায়। মাউস দিয়ে সেই মৃত দেহতে আঘাত করলে তার ডিএনএ আর আরএনএ পুনর্বিন্যস্ত হতে শুরু করে। মৃত দেহের পাশের একটা ডায়লগ বক্সে ৫০০ কেবি, ২.৩ এমবি ইত্যাদি ইত্যাদি মানের বড় থেকে ছোট মানের জিনের নিউক্লিয়ার প্রতিলিপি রয়েছে। মাউসের সাহায্যে সেগুলোর মান পরিবর্তন করলে নতুন মানুষসহ বিভিন্ন জীবিত পশুপাখির আকার ধারণ করছে। গেমটা খেলতে গিয়ে অনরার মতো রাশভারি স্বভাবের একজন মানুষ প্রচ- উত্তেজিত বোধ করতে শুরু করে। খেলার একপর্যায়ে সেই মৃত মানবদেহ শত শত পাখি হয়ে আকাশে উড়ে যায়! লাল রঙের বোল্ড লেটারে লেখা ওঠেÑ ‘ইউ লুজ, ইউ হ্যাভ টার্নড আ হিউম্যান বিইং ইনটু অ্যানাদার স্পেশিস’ মাথায় হাত দিয়ে ঘন ঘন দম নেয় অনরা। সচরাচর যার অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন আসে না, সে রীতিমতো টেবিল চাপড়ে বলে, ব্রিলিয়ান্ট! জায়েদ বলে, ম্যাম এখানে ভর্তি হয়েই আমি আপনার নাম শুনেছি, আপনার ক্লাস করেও বুঝেছি ইউ আর ভেরিমাচ কিন টু দিস সাবজেক্ট। সব থেকে মজা লেগেছিল আপনি যখন ক্লাসে বলছিলেনÑ শঙ্খচিল, শালিকের বেশে, তখন আমি ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম, কারণ আমাদের গেমটা লুজ করলে এ ধরনেরই একটা ঘটনা ঘটে! অনরা স্মিত হাসি দিয়ে বলে, হ্যাঁ সেটাই তো দেখলাম! জায়েদ বলে এজন্যই গেমটা আপনাকে দেখালাম। এটা অফিসিয়ালি ডিক্লিয়ার করার আগে এর সব ফ্লস আমরা দূর করতে চাই। এজন্য একটা কপি আপনার জন্য এনেছি। আপনি যদি এই গেমের দুর্বলতাগুলো বের করতে একটু হেল্প করতেন! অনরা সানন্দে বলে, অবশ্যই সেটা আমি করব। তোমার বন্ধুদেরকেও আমি একদিন মিট করতে চাই। এটার কোড সেটিং, অ্যানিমেশন, সব কিছু এত দুর্দান্ত হয়েছে, আই মাস্ট মিট দেম! জায়েদ খুবই আনন্দিত, কিন্তু তার রোবটসুলভ মুখে সেই আনন্দ কতটা প্রকাশিত হওয়া সম্ভব কে জানে! তবুও ভেতরের খুশিটা যত সম্ভব প্রকাশ করে সে বলল, থ্যাংইউ ম্যাম। অনরা বহু বহু দিন পর একটা প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে বলল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ল্যাপটপ ব্যাগে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল জায়েদ।
সেমিনার রুমের বারান্দায় গ্রুপ ডিসকাশনে বসেছে তমাল, ত্রেতা আর আসিফ। সামনে কয়েকটা ক্লাসটেস্ট আছে। তাই তাদের দলগত সিদ্ধান্তে আপাতত সব ধরনের আড্ডাবাজি মুলতবি করা হয়েছে। কিছু নোটপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ টিচার্স রুমের দিকে চোখ চলে গেল ত্রেতার। অনরা মালিকের রুমটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সেখান থেকে জায়েদকে বেরোতে দেখে সে অবাক-বিরক্ত দুই-ই হলো। কারণ এটা কোনো নতুন দৃশ্য নয়। ছেলেরা কারণে-অকারণে আলতু-ফালতু প্রশ্ন নিয়ে অনরা মালিকের কাছে যায়। যদিও অনরা মালিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে ত্রেতার, ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্বে ন্যূনতম প্রশ্রয়ের ব্যাপার-স্যাপার নেই। ছেলেরা বন্ধুদের আড্ডায় মজা করার জন্য নানা অজুহাতে অনরা মালিকের কাছে যায়, আর বেরিয়ে এসে বানিয়ে বানিয়ে নানারকম গল্প ফাঁদে। আসিফ আর তমালও বহুবার পরিকল্পনা করেছে অনরা মালিকের সঙ্গে দেখা করবে। সবেমাত্র ক্লাস শুরু হয়েছে বলে তারা এখনো শক্তপোক্ত কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে পারেনি বলে এখনো যাওয়া হয়নি। এসব মজাদার গল্পে কম-বেশি ত্রেতাও শামিল হয়। কিন্তু জায়েদকে ওখান থেকে বেরোতে দেখে তার মোটেও ভালো লাগল না। জায়েদ তার কেউ নয়, তবুও একটু হলেও মনটা খারাপ হয়ে গেল ত্রেতার। চুল-দাড়িওয়ালা উষ্কখুষ্ক চেহারার একটা ছেলে কোত্থেকে এসে জায়েদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল! এও এক আশ্চর্য কা-Ñ ওর মতো পরিপাটি একজন মানুষের সঙ্গে এ রকম ময়লা, বোহেমিয়ান টাইপের একটা ছেলের আলাপ কীভাবে থাকতে পারে! একটু পর ছোট করে ছাঁটা চুল আর চশমা পরা একটা ছেলেকেও যোগ দিতে দেখা গেল! বোঝাই যাচ্ছে দুটোর কোনোটাই কার্জন হলের নয়। লে বাবা, এর আবার বাইরের বন্ধুও আছে দেখছি! তমালের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল ত্রেতা। তমাল বলল, ওই তোকে কয়বার বললাম যে ভাগব এখন। একটু অপ্রস্তুত হলো ত্রেতা, তারপর বলল, এখনই যাবি? তমাল বলে, ধানমন্ডিতে একটা টিউশনির কথা হয়েছে, ভালো টাকা দেবে মনে হয়। ছাত্রের বাবা-মা বিকেলে দেখা করতে বলেছে। এটা শুনে আসিফ বলে, ওই টাকা থেকে বন্ধু ফান্ডে ২০ শতাংশ দিবি কিন্তু। তমাল বলে বন্ধু ফান্ড, তাই না? তুই নিজে আগে একটা টিউশনি কর, তারপর যত খুশি বন্ধু ফান্ড বানাস, আমি ফুটলাম। তমালের উদ্দেশে গলা চড়িয়ে আসিফ বলে, তোর টাকা ১২ ভূতে লুটে খাবে রে শয়তান, ভুখা-নাঙ্গা হয়ে হাইকোর্ট মাজারের পাশে পড়ে থাকবি...তমাল হাসতে হাসতে বলে পীর সাহেব অভিশাপ দিতে থাকেন...আপনার কথায় পৃথিবী কাঁপছে...! ওদের কা-কীর্তি দেখে হাসতে হাসতে ত্রেতা বলল, এই আমিও উঠলাম, আসিফ বিরক্ত হয়ে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘চৈতালী ধরতে হবে’ শালার আমি আজকে বেচারা হয়ে গেলাম! ক্লাসে চশমাপরা পাকনা টাইপের একটা আছে না, কী সিমি না ঝিমি নাম, ওইটাকেই একটা ব্রেক দিতে হবে মনে হচ্ছে। ত্রেতা উঠতে উঠতে বলে, ব্রেক দিতে হবে মানে, কিসের ব্রেক দিবি তুই! আসিফ খুব একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, আমার টাইম পাস হওয়া তো এক ধরনের ব্রেকই নাকি? ত্রেতা বলে তা তো বটেই, স্যান্ডেলের মাপটাও জেনে নিস, নিজে কিনে না দিলে, কী না কী জুতা মারে, তা তো বলা যায় না! আসিফ বলে, পেয়েছিলাম জীবনে দুটো বন্ধু নামের দুষ্টু গ্রহ, যাহ ভাগ তুই, আমি সিমি-ঝিমির সন্ধানে পথে নামলাম। ত্রেতা হাসতে হাসতে বলে, চল আমিও তোর সঙ্গে সিমি-ঝিমিকে খুঁজে আসি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল আসিফ। বলল, দোস্ত তুই সত্যিই এখন যাবি না? ত্রেতা বলল, না এখনই যাচ্ছি না, তবে চৈতালীতেই যাব, দেখলাম যথেষ্ট সময় আছে এখনো, তুই সিমি-ঝিমিকে কী ব্রেক দিস দেখে যাই। আসিফ বলে, দোস্ত তোর মতো বন্ধু হয় না পৃথিবীতে! একটু আগে না বললি আমরা বন্ধু নামে দুষ্টু গ্রহ! আসিফ বলে, আরে ওই তমাল ফাউলটার কারণে তুই অযথা গালি খেলি! ত্রেতা বলে বুঝলাম, এখন চল। আসিফ বলে, চলব মানে, কোথায় যাব? ত্রেতা বলে, কেন সিমি-ঝিমিকে খুঁজতে। আসিফ বলে, হ, খাইয়া কাম নাই আমার, চল চা-শিঙ্গাড়া খাই। ত্রেতা বলে, চল। দু’জনে হাঁটতে শুরু করে।
চায়ের দোকানের সামনে জায়েদ আর তার দুই বন্ধু। চুল-দাড়িওয়ালাটার নাম পার্থ, সে চারুকলায় পড়ে, আর চশমা পরাটার নাম সুদীপ্ত, সে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে। তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব সিরিয়াস কোনো আলাপ হচ্ছে। সুদীপ্ত বলল, তোর টিচার কোনো ভুলটুল ধরল না? জায়েদ বলে, ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া অ্যাবাউট হার পারসোনালিটি, হুট-হাট, ফুট-ফাট উনি কারো ভুল ধরেন বলে আমার মনে হয় না, যা বলবেন, টু দ্যা পয়েন্ট বলবেন, সো শি উইল টেক টাইম ফর দিস। তবে আজকে খুব প্রশংসা করলেন আমাদের কাজের। বিশেষ করে পার্থর অ্যানিমেশনের অনেক প্রশংসা করলেন। তবে পার্থ আমার একটা পারসোনাল অবজারভেশন হলোÑ ডেড ক্যারেক্টারটা টুমাচ আইডেন্টিক্যাল টু জিসাস ক্রাইস্ট, উই শুড চেইঞ্জ দ্য ড্রইং। অযথা কোনো কনট্রোভার্সি ক্রিয়েটেড হলে শুধু শুধু জটিলতা তৈরি হবে। পার্থ একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে খুবই গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ক্যারেক্টারটা যখন আমি করি তখন ওইরকমই একটা মুখ আমার চোখে ভেসেছিল, আমি তো ইনটেনশনালি কিছু করিনি। দূর থেকে পার্থকে সিগারেট নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলতে দেখে খুবই বিরক্ত লাগল ত্রেতার। মনে হলো জায়েদ যতই মেধাবী হোক না কেন, ওর বন্ধু-বান্ধব খুব একটা সুবিধার না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল আসিফ আর তমাল দু’জনেই রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে সিগারেট খায়। সে বুঝতে পারল সমস্যাটা বন্ধু-বান্ধবে নয়, জায়েদকে অনরার রুম থেকে বেরোতে দেখার পর থেকেই জায়েদ সংশ্লিষ্ট সব কিছুতেই তার বিরক্ত লাগছে। সে আসিফকে বলল, আজ আর চা খাব না, বাসায় চলে যাব। আসিফ বলল, হঠাৎ কী হলো আবার! তাদের সামনে দিয়ে রিকশা করে যাচ্ছিল একটা ছেলে, সে বলল, আসিফ টেবিল টেনিস খেলবি আজকে? আসিফ বুঝল কোনো কারণে ত্রেতার মুড অফ, সুতরাং টেবিল টেনিসের প্রস্তাবটাই আপাতত বেস্ট অপশন। সে বলল, দাঁড়া দাঁড়া, দৌড় দিয়ে ত্রেতাকে বিদায় জানিয়ে রিকশা চেপে বসল আসিফ। ত্রেতা প্রতিদিনকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। নিজের বন্ধুদেরকে বিদায় দিয়ে একই দিকে জায়েদ হাঁটতে শুরু করল। ত্রেতাকে দেখতে পেয়ে সে বেশ পরিচিত ভঙ্গিতে বলল, আবারো দেখা হয়ে গেল। ত্রেতা যেন কথাটা শুনতেই পায়নি। একটু ভদ্রতার হাসি দিয়ে বলল, আজকে মনে হয় কোনো ক্লাস করোনি তুমি! জায়েদ হাসতে হাসতে বলল, আজকে কোনো ক্লাস করার প্ল্যান ছিল না আমার। ত্রেতা বলে, তোমাকে তো ক্লাস ফাঁকি দেয়া টাইপ স্টুডেন্ট মনে হয়নি আমার, তাহলে ক্লাস ফাঁকি দিলে যে? আজকে ক্লাসের চেয়েও ইমপরট্যান্ট কাজ ছিল আমার। ত্রেতা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কী রকম! সেটা তো এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে একটু হিন্ট তো দেয়াই যায়, ইনফ্যাক্ট আজকে আমি ভীষণ এক্সাইটেড। মনে মনে দাঁত কিটমিটিয়ে ত্রেতা বলে, হ্যাঁ একসাইটেড হবি না, অনরা মালিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ হয়েছে, আজকে তো এক্সাইটমেন্টেরই দিন। আসলে হয়েছে কি, আমি আমার বুয়েটের এক বন্ধু আর চারুকলার এক বন্ধুকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা প্রজেক্ট করছিলাম, সেটা মোটামুটি একটা শেপে চলে এসেছে। কাজটা আমাদের সাবজেক্ট রিলেটেড, সকাল সকাল অনরা ম্যামকে দেখালাম, উনি খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করলেন। জায়েদের রোবটিক মুখে একটা সরল হাসির সঙ্গে কথাগুলো শুনতে শুনতে ভীষণ লজ্জা লাগতে শুরু করল ত্রেতার। এই বুকিশ আর কাজপাগল ছেলেটাকে নিয়ে কী সব আলতু-ফালতু ভাবনাই না ভাবল সারাটা দিন! নিজেকে মনে মনে এই ভেবে গালি দিতে লাগল, এ রকম চরম মেধাবী একটা ছেলের অযথা টিচারের সঙ্গে আড্ডা মারার খায়েস কেন থাকতে যাবে! দূর থেকে চুল-দাড়িওয়ালা ছেলেটাকেও তো বেশ রাশভারি মনে হলো, ইনফ্যাক্ট একজন আর্টিস্টের তো এমনটাই হওয়ার কথা! আর বুয়েটেরটাকে তো বোঝাই যাচ্ছে...। মোদ্দা কথা হলো, জায়েদের বন্ধুরাও সাধারণ কেউ হবে না নিশ্চয়ই। একটু লজ্জা পেলেও পুরো ব্যাপারটাতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে গিয়েছে ত্রেতা! কিছুক্ষণ আগেও জায়েদের যেই বন্ধুদেরকে তার জঘন্য আর উদ্ভট লাগছিল, তাদের জন্যই কত কত উপমা খেলছে মাথায়! সে বেশ খুশি খুশি গলায় বলল, গতকাল তোমার ঠা-া লাগেনি? জায়েদ তার রোবটিক কণ্ঠে বলে, কেন ঠা-া লাগবে কেন! ত্রেতা বলে, ওমা আমরা না বৃষ্টিতে ভিজে-টিজে একাকার হয়ে গেলাম! জায়েদ বলে, ভিজে-টিজে একাকার হওয়ার মতো বৃষ্টি তো গতকাল হয়নি! ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল ত্রেতা, নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল, না অনেকেরই দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিতেই ঠা-া লেগে যায় কিনা! জায়েদ বলে, নাহ আমার ঠা-া লাগার সমস্যা নেই। কেন তোমার ঠা-া লেগেছে নাকি? ত্রেতা বলে মাথা খারাপ! বৃষ্টি আমার খুবই প্রিয়, ঠা-া লাগার কোনো চান্স নেই। আচ্ছা তুমি সুনীলের কবিতা পড়? জায়েদ বলে, এই ভদ্রলোক কে? খুবই অবাক হয় ত্রেতা। সে বলে, সত্যিই তুমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চেন না! এটা কীভাবে সম্ভব! সত্যিই চিনি না, ভদ্রলোক আসলে কে? ত্রেতা একটু হতাশ হয়েই বলে, দুই বাংলার অসম্ভব জনপ্রিয় একজন কবি, সাহিত্যিক। জায়েদ বলে, ও আচ্ছা তাই বলো, আমার কবিতায় ইন্টারেস্ট নেই খুব একটা, লিটারেচার যে খুব একটা পড়া হয় তা না, তবে সায়েন্স ফিকশন পড়া হয় মোটামুটি। ত্রেতা বেশ সন্দেহ নিয়ে ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, এদেরকে চেন তো? এবার হেসে ফেলে জায়েদ, বলে, কী যে বল না, তাই বলে মাস্টারদেরকেও না চেনার মতো ডাম্প নিশ্চয়ই আমি না! আসলে কি আমার ভালো লাগে কোডস, ডিজিটস, ইকুয়েশন্স, কবিতা সেই ব্যাপারগুলো ঠিক...জায়েদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ত্রেতা জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা অনরা ম্যামকে তোমার কেমন লাগে? জায়েদ বলে, কেমন লাগবে আবার! শি ইজ এ গুড টিচার, অ্যান্ড আই গেস শি হ্যাজ পটেনশিয়াল টু বি অ্যা সায়েন্টিস্ট অ্যাজওয়েল। ত্রেতা বলে, উনি কিন্তু দুর্দান্ত সুন্দরী, ক্যাম্পাসের অর্ধেক ছেলের ক্র্যাশ, এই দৌড়ে টিচাররাও কম যান না! জায়েদ বিস্মিত হয়ে বলে, ব্যাপারটা তো খুবই দুশ্চিন্তার! যেখানে ইউ হ্যাভ প্লেন্টি অব অপরচুনিটি টু গ্যাদার নলেজ ফ্রম সামওয়ান, ইউ আর ওয়েস্টিং ইওর টাইম বাই ওরশিপিং হার বিউটি! সো আনফরচুনেট! নিজের নির্বুদ্ধিতায় আরো একবার বিরক্ত লাগল ত্রেতার। এই ছেলেটাকে এতরকমের পরীক্ষা করার কী আছে, সে তো আর দশটা ছেলের মতো নয়! মনে মনে সে নিজেকে গালি দেয় আর বলে, ‘তোকেই পাত্তা দেয় কিনা আগে তাই দেখ!’ বাস ডিপোর কাছাকাছি আসতে আসতে জায়েদের সামনে একটা কালো কুচকুচে টয়োটা ক্রাউন গাড়ি এসে দাঁড়ালো। জায়েদ গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, তোমাকে ড্রপ করব কোথাও? ত্রেতা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, নাহ আমি বাসে যাব। খুবই স্বাভাবিক গলায় জায়েদ বলল, ওকে দ্যান বাই, ক্লাসে দেখা হবে। ত্রেতা তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। ত্রেতাদেরও নিজেদের গাড়ি আছে। কিন্তু একটা গাড়ি হওয়ায় তার সঙ্গে প্রায়ই টাইমিংয়ের গড়বড় হয় বলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস চৈতালীতে যাতায়াত করে। সুতরাং এই বিষয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই। তবুও তার বেশ মন খারাপ লাগতে লাগল এই ভেবে যে, ঠিক একদিন আগে কী স্বপ্নময় একটা বিকেল কাটল, আর আজ তার নির্বুদ্ধিতার কারণে পুরো বিকেলটাই মাটি হয়ে গেল! মন খারাপ নিয়েই সে বাসে উঠে পড়ল। সৌভাগ্যক্রমে জানালার দিকের সিট পাওয়ায় একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে, এখন পুরোটা পথ ইচ্ছেমতো কল্পনায় বিভোর থাকা যাবে।

সাত.
কোনো এক অদ্ভুত কারণে আজকে মনে হয় ঢাকা শহরে কোনো মানুষ মারা যায়নি! অন্তত আজিজের তেমনটাই মনে হচ্ছে। সারাদিনে একটাও লাশ আসেনি গোরস্তানে! হঠাৎই এই রকম অখ- অবসরে করণীয় ঠিক করে উঠতে পারছে না আজিজ। রাতে মুর্দা শিশুর কামড় খাওয়ার পর থেকে গা-টা একটু জ্বরজ্বরও লাগছে। তারপরও আজিজের আজকে মনটা যথেষ্ট ফুরফুরে। সচরাচর এই রকম অবসর মেলে না! তাছাড়া সর্বক্ষণ কবর খুঁড়তে খুঁড়তে নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ হয় মাঝে মাঝে! এই রকম অবসর পেলে চা খেতে খেতে খোশগল্পে মশগুল হতে মন চায়। কিন্তু গোরস্তানের অন্যান্য অনুজ গোর খোদকদের সঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবেই একটু দূরত্ব রক্ষা করে চলে সে, নয়তো নিজের কর্তৃত্বপরায়ণতা জাহির করতে একটু সমস্যাই হয়। কেরোসিন স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে চায়ের পানি চড়িয়ে দেয় আজিজ। এমন সময় তার ঘরের পাশ দিয়ে অনরা যেতে থাকে। তার উপস্থিতি টের পেয়েই আজিজ বলে, আম্মা আইজকা যে বেশ আগে আগে? অনরা আন্তরিক কণ্ঠে বলে, আজকে কম ক্লাস ছিল চাচা। আজিজ বলে, আমার ঘরে বইসা একটু চা খাইয়া আব্বাজানের কাছে যান আম্মা। আজিজ চাচা এমনভাবে আব্বাজানের কাছে যান বলেন যে, কোনোভাবেই মনে হয় না উনি কোনো মৃত ব্যক্তির কথা বলছেন! এই কারণেই আজিজকে অনরার এত পছন্দ। আজিজের চায়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার কোনো মানেই হয় না, তাছাড়া তার কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। একটা আন্তরিক হাসি দিয়ে সে আজিজের ঘরে ঢোকে। এর আগেও বেশ কয়েকবার সে আজিজের ঘরে বসে চা খেয়েছে। আজিজের দার্শনিক ভঙ্গির কথাবার্তা শুনতে তার মজাই লাগে। দরিদ্র, আশিক্ষিত হলে কী হবে, ৬৮ বছর ধরে গোরস্তানে থেকে থেকে তার যে জীবন দর্শন তৈরি হয়েছে, তা বই-পুস্তকে পাওয়া যাবে না। যথেষ্ট পরিপাটি তার ঘর। পুরনো বিছানার চাদর টানটান করে বিছানো। ঘরের এক কোনায় তার রান্নার ব্যবস্থা। আরেক দিকে দড়ির সঙ্গে ছোট্ট একটা তক্তা ঝুলছে। সেই তক্তার এক দিকে রেহেলসহ কোরান শরিফ, আরেকদিকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের মগের ভেতরে গোঁফ ছাঁটার কাঁচি, নিমের ডালের মেছওয়াক, আর এপি দশনচূর্ণ। ছোট্ট একটা আয়নাও আছে। আয়নার উল্টোদিকে অর্ধেক নারীর মাথা আর অর্ধেক ঘোড়ার সম্মিলনে তৈরি একটা প্রাণীর ছবি। ইসলাম ধর্মে এই প্রাণীটিকে বলা হয় বোরাক। কথিত আছে এই বোরাকে চড়েই রাসূল (সা.) মিরাজে গিয়েছিলেন। আজিজ নিজে তার গ্লাসেই চা খায়। একটিমাত্র চিনামাটির চায়ের কাপ রয়েছে তার, সেই কাপে সে অনরাকে চা খেতে দেয়। চায়ে চুমুক দিয়ে অনরা বলে, আজকে কাজ নেই চাচা? আজিজ বলে, কী আচানক কা- আম্মা, আইজকা সারাদিনে একখানও লাশ আহে নাই। অবশ্যি ভালাই হইছেÑ শরীলডা ম্যাজ ম্যাজ করতাছে, জ্বরজ্বরও লাগতাছে একটু একটু। উদ্বিগ্ন হয়ে অনরা জানতে চায় কখন থেকে জ্বরজ্বর লাগছে? আজিজ বলতে শুরু করে, কী আর কমু আম্মা, আপনের কাছে তো আর লুকানের কিছু নাই। আপনে তো জানেনই দুই-চাইরটা মুর্দা রাইতের আন্ধারে আমার সামনে দেখাটেখা দেয়। তো কাইলকা নিশুতি রাইতে আমি বিছানায় খালি এপাশ-ওপাশ করতাছি, ঘুম আহে, আবার চইলা যায়। এর ভেতরে শুনি দূর থেইকা কুন কুন কইরা কান্দনের আওয়াজ আইতাছে। ভাবলাম কলোনির কোনো পোলাপাইন কান্তাছে মনে হয়। তবুও টর্চটা নিয়া বাইরাইলাম...আজিজ গতরাতের সম্পূর্ণ ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করে চলেছে। আজিজের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু আছে যে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই! গল্পের একদম শেষ পর্যায়ে যখন সে বলল, কামড়ের চোটে চিক্কর পাইড়া দেহি আমি নিজের বিছানায় শুইয়া আছি, তখন ব্যাপারটা তার স্বপ্ন বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হয় অনরা। সে বলে, আসলে চাচা দিনের পর দিন এ রকম পরিবেশে থাকলে এই জাতীয় দু-একটা স্বপ্ন দেখা খুবই স্বাভাবিক! আজিজ তার কোটরগত দৃষ্টি মেলে বলে, পুরো ঘটনাডারে আপনের স্বপ্ন মনে হইল আম্মা! এরপর কামড়ের দাগওয়ালা হাতটা অনরার দিকে বাড়িয়ে সে বলে, তাইলে এইডা কী? আজিজের হাতে স্পষ্ট দাঁতের দাগ দেখে রীতিমতো আঁতকে ওঠে অনরা। সত্যিই তো কামড়ের দাগ! আজিজ সেই একই দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে! নিজেকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়ে, ঠা-া মাথায় প্রথমেই তার মাথায় যেটা এলো, সেটা হলো দুঃস্বপ্নের ঘোরে আজিজ নিজেই হয়তো নিজের হাত কামড়েছে! অথবা বিছানায় থাকা শক্ত কিছুতে তার হাত চাপ খেয়েছে। অনরা বলে, চাচা আপনার বিছানায় কিছু আছে? আজিজ বলে বিছানায় কী থাকব আম্মা! অনরা বলে, চলেন দু’জনে মিলে খুঁজে দেখি। আজিজ একটু অবাক হয়, খালি চোখেই তো দেখা যাচ্ছে বিছানায় কিছু নেই, তাহলে অনরা কী খুঁজতে চায়। বিছানাটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে বালিশ উল্টালো অনরা। বালিশের নিচে এক গোছা চাবি। চাবির গোছা হাতে তুলে নিয়ে মোটামুটি হিসাব মিলিয়ে ফেলল সে। চাবিটা আজিজের হাতে তুলে দিয়ে বলল, এই যে চাচা স্বপ্নের ভেতরে কোনোভাবে এই চাবির সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আপনার হাত চাপ খেয়েছে, সেটাকেই আপনি দাঁতের কামড় ভাবছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল আজিজ। তারপর বলল, কিন্তু আম্মা এই চাবি তো আমার না! মসজিদের ইমাম সাহেব দারুল উলুম মাদ্রাসায় জোহরের নামাজের পর, যাওয়ার সময় চাবি আমার কাছে দিয়া গেলেন আসরের আগেই ফিরা আসবেন বইলা। গত রাইতে তো এই চাবি আমার কাছে আছিল না! আর কোনো কথা খুঁজে পায় না অনরা। মনে মনে বলে এটা কী করে সম্ভব! তারপর আজিজকে চায়ের কাপ ফেরত দিয়ে রাহাতের কবরের কাছে যায়। গিয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলে না রাহাতের উদ্দেশে। তারপর বলে, আজিজ চাচা এসব কী বলে রাহাত, এমন ঘটনা কি সত্যিই ঘটা সম্ভব! যদি তাই-ই হয়, তুমিও তো ফিরে আসতে পারো! আজকে আমার এক স্টুডেন্ট অদ্ভুত এক গেম দেখাল। মৃত মানুষের ডিএনএ, আরএনএ আর জিনের নতুন নতুন কম্বিনেশনে নতুন নতুন জীব তৈরি করার খেলা। এটাকে আমার নিছকই খেলা মনে হয়নি। কোনো এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পূর্ব লক্ষণ মনে হয়েছে। ডিএনএ প্রতিলিপি দিয়ে যদি ক্লোনিং হয়, যদি লিভার-কিডনি এমনকি হার্টও তৈরি করা সম্ভব হয়, আস্ত একটা মানুষ কেন নয়! পৃথিবীতে যদি এত কিছু সম্ভব হয়, তাহলে আমি তোমাকে ফেরত চাই। কথাগুলো বলতে বলতে অনরার চোখের কোণে জল জমা হয়ে গোধূলির চুরি যাওয়া রোদে চিকচিক করতে লাগল। আজকে স্পষ্ট করে সে কথাগুলো বলছে, কিন্তু রাহাতের কথিত মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটা দিন সে এই প্রার্থনাই করে এসেছেÑ রাহাত যেন ফিরে আসে! আজকে তার মন বাঁধনহারা, সে বলেই চলেছেÑ তোমাকে ফিরিয়ে আনতে এভরি পসিবল ওয়েতে আমি ট্রাই করতে চাইÑ সায়েন্স, মেডিটেশন, প্ল্যানচেট, এভরি পসিবল ওয়েতে আমি ট্রাই করব রাহাত। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। সে অনুভব করে তার কথা রাহাতের কবরে থাকা তার অবিন্যস্ত কোষগুলো ছুটে এসে এসে একত্রিত হচ্ছে ঠিক আগের কম্বিনেশনে! অনরা প্রবলভাবে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, রাহাতের ৪০,০০০ জিন আগের কম্বিনেশনে পাশাপাশি জড়ো হতে শুরু করেছে। ভূতগ্রস্তের মতো সে একটু একটু কাঁপতে থাকে। কখন যে আজিজ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে লক্ষই করেনি! স¯েœহে আজিজ বলে, আম্মা ঠিক আছেন তো ? অনেকক্ষণ ধইরা আপনের ব্যাগ থেইকা ফোনের আওয়াজ আসতাছে, আপনে মনে হয় শুনতে পান নাই! আজিজের কণ্ঠ শুনে ভয়ঙ্কর চমকে গেল অনরা, এখনো সে ঘোরগ্রস্ত! এই ঘোর নিয়েই সে ফোন বের করে দেখে অয়নের ২৩টা মিসড কল! তাড়াতাড়ি সে অয়নকে কল ব্যাক করে। অয়ন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, আপা রিমির হঠাৎ করে ওয়াটার ব্রেক করেছে, ডাক্তার বলল, আজকেই সিজার করতে হবে। আমি রিমিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এসেছি, তুমি কোথায়? অনরা এখনো ঘোরগ্রস্ত, নিজের ভাইয়ের এ রকম বিপদে তার যেই ধরনের অনুভূতি হওয়ার কথা, তেমনটা ঠিক হচ্ছে না! তবুও মোটামুটি অন্যমনস্ক কণ্ঠে সে বলল, অপারেশন কয়টায়? অয়ন বলল, সাড়ে সাতটায় আপা! অনরা বলল, চিন্তা করিস না, আমি আসছি। আরো একবার গাঢ় একটা দম নিয়ে সে রাহাতের উদ্দেশে বলল, আমি এভরি পসিবল ওয়েতে ট্রাই করব রাহাত!
গোরস্তানের বাইরে রাখা গাড়িতে চেপে ড্রাইভারকে হাসপাতালের দিকে যেতে বলে গাড়ির জানালার সঙ্গে মাথা এলিয়ে বসল অনরা। ড্রাইভার রিয়ারভিউ মিররে তাকে দেখছে, তাতে তার কিছু আসছে-যাচ্ছে না! তার মাথায় আজিজের গল্পের শিশুটির কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। একই সঙ্গে জায়েদের গেমের বিভিন্ন টেকনিক্যাল জিনিসও ঘুরছে। মনে পড়ছে একবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছিল ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক সাধু সাধনা করতে করতে মাটি থেকে ১৪ ফুট ওপরে শূন্যে ভাসার কৌশল রপ্ত করেছে! তার বার বার মনে হচ্ছে, সময় আর পরিস্থিতির সন্নিবেশ এক অদ্ভুত মায়াময় খেলা। এই খেলার গতিপথ এর পুরোটা না হলেও কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব। সাধনার বিকল্প নেই, সাধনায় সবই সম্ভব! এই রকম অসংখ্য ভাবনা মাথায় নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যায় অনরা। অয়নের কাছ থেকে কেবিন নম্বর জেনে নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখে, রিমি সমানে কাঁদছে, তাকে ঘিরে তার বাবা-মা, ছোট ভাই, অনরাদের দু-একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, অয়নের দু-একজন বন্ধু। যেই ডাক্তার অ্যানেসথেসিয়া করবেন, তিনি এলেন। পিতৃসুলভ ডাক্তার স¯েœহে রিমির মাথায় হাত রেখে বললেন, কিচ্ছু হবে না মা, আপনার ডাক্তার খুব ভালোভাবে আপনাকে দেখে গেছে, সব ঠিক আছে। ডিউ ডেটের আগে ওয়াটার ব্রেক হওয়ার ঘটনা প্রায়ই হচ্ছে, এটা তেমন গুরুতর কিছু না। এবার আমি আপনাকে কীভাবে অ্যানেসথেসিয়া করব সেটা বলব, যাতে অ্যানেসথেসিয়া করার সময় আপনি চমকে না যান। আপনাকে হাঁটু মুড়ে ঝতদূর ঝোঁকা সম্ভব ঝুঁকতে হবে, তারপর আপনার স্পাইনে আমি অ্যানেসথেসিয়া পুশ করব। এটার সময় একটু পেইন হবে, কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না। মা হতে গেলে অনেক কারেজ থাকতে হয়, কেমন। আমি তাহলে আসছি মা, ওটিতে দেখা হচ্ছে। কথা শেষ করেই ডাক্তার চলে যান। রিমির চোখে উদ্বেগের জল। সে অয়নের দিকে তাকাতেই পারছে না। অয়ন তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর একজন সিস্টার এলেন ওটির ড্রেস পরাতে। এরপর একজন এলো হুইল চেয়ার নিয়ে। সেটাতে রিমিকে বসানো হলো। তার পেছন পেছন সবাই হাঁটতে লাগল। অনরাও পাশাপাশি হাঁটছে। ওটির কাছে গিয়ে সিস্টার বললেন, আর সঙ্গে আসা যাবে না। আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন। খুব অসহায় লাগতে লাগল রিমির! অয়নেরও কেন জানি বারবার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষকে কাঁদতে দেখলে কেমন লাগবে, এই বিবেচনায় সে নিজেকে দীর্ঘক্ষণ সামলে রেখেছে। ওটিতে নেয়ার সময় রিমির হাত যখন ছেড়ে দিতে হলো তখন আর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চোখ গড়িয়ে জল পড়তে লাগল। তার গা একটু একটু কাঁপছে, অনরা হাত ধরে ভাইকে নিয়ে এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওটির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রিমিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে একেকটা মিনিট যেন একেক ঘণ্টার মতো লাগছে। এই সময় বাকিরা কে কী ভাবছে সেটা বলতে না পারলেও অনরার মাথায় অদ্ভুত সব ভাবনা খেলা করছে। সে ভাবছে যেই শিশুটি আজকে ভূমিষ্ঠ হবে, সে যখন সামান্য একটা কণার মতো ছিল তখন থেকেই তার বাবা-মা তাকে নিজের সন্তান বলেই জানে। গত সাড়ে আট-নয় মাস ধরে তাদের প্রটিটি মুহূর্ত কেটেছে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার অপেক্ষায়। এই যে ওটির বাইরে এত এত মানুষ অপেক্ষা করছে, তাও এই শিশুর আগমনের জন্য। তার মানে জন্ম মানেই অপেক্ষা। এই অপেক্ষা এক ধরনের মেডিটেশন। সার্কাস দেখানোর সময় কেউ যখন একটা চিকন দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যায় তখন দীর্ঘদিনের অনুশীলনের পর তাকে বিশ্বাস করতে হয় যে সে এই চিকন দড়ির ওপর দিয়েই ওপারে পৌঁছে যাবে। এই বিশ্বাস এক ধরনের মেডিটেশন! নিবিড় মনোসংযোগে সবই সম্ভব! এত শত ভাবনার ভেতরে শিশুর কান্না ভেসে আসায় সম্বিৎ ফিরে পায় অনরা। ওটির দরজার কাছে হাস্যোজ্জ্বল নার্সের কোলে তার ভাইয়ের শিশুপুত্র, তাদের রক্তের নতুন উত্তরাধিকার! অনরা আর অয়ন ছুটে যায় ওটির দরজার কাছে। শিশুর চেহারা দেখে অয়নের জন্ম মুহূর্তের ছবি মনে পড়ে যায় অনরার, এই একই চেহারা দেখেছিল তারা ৩২ বছর আগে! কী অদ্ভুত পরম্পরা! রিমির চোখে আনন্দাশ্রু। শিশুর মুখে স্মিত হাসি। এ রকম একটা ছবি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে অনরা। বাড়ি ফিরেও তার ভাবনা থামে না। রাতের খাওয়া যে হয়নি, সে নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই তার। সেই একইরকম সব ভাবনা তার মাথায় ঘোরাফেরা করছে। একপর্যায়ে সে জায়েদের গেমটা নিয়ে বসল। গেমটা তার নেশার মতো লাগতে লাগল। বারবার মনে হতে লাগল রাহাতের ডিনএনএ, আরএনএ পুনঃবিভাজিত হচ্ছে! কিন্তু প্রতিবারই মৃত যিশু অন্য কোনো জীবে পরিণত হচ্ছে, আর সে খেলায় হারছে, সারা রাত এ রকম করতে করতে ভোরের দিকে সে খেলায় জিতল। দেখল মৃত যিশু জীবিত হয়ে উঠেছে, তার কোলে একটি মেষ শাবক। সে দিগন্ত রেখা বরাবর হেঁটে যাচ্ছে। অনরা লক্ষ করল তার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, সঙ্গে খিদে! ফ্রিজ থেকে টক দই আর কর্নফ্লেক্স বের করে খেয়ে নিল সে। তারপর রাজ্যের অবসাদ ভর করল তার ওপরে, ঘুমিয়ে গেল সে। তখন ভোরের আলো ফুটছে।

আট.
যেহেতু ক্লাসটা অনরা মালিকের। ক্লাস শুরু হওয়ার ১০ মিনিট আগেই ক্লাস কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কিন্তু এই ১০ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও অনরার দেখা নেই! আসিফকে দেখা যাচ্ছে বেশ বিজ্ঞের মতো হাত নেড়ে নেড়ে সিমির সঙ্গে কী যেন বলছে। তমাল আর ত্রেতা পাশাপাশি বসে আসিফের জন্য জায়গা রেখেছে। ত্রেতা মনে মনে জায়েদকে খুঁজছে, তারও দেখা নেই। ক্লাসে মোটামুটি সবাই উপস্থিত, জায়েদের এখনো আসার কোনো নামগন্ধ নেই! আরো কিছুক্ষণ পর চেহারায় এক ধরনের রোবটিক উদ্বেগ নিয়ে জায়েদ ক্লাসে ঢুকল। ত্রেতা একটু নড়েচড়ে বসে মনে মনে বলল, কী আশ্চর্য আজো একই পোশাক! ওর জামাকাপড় দিয়ে তো গন্ধ বেরোনোর কথা! দেরিতে আসায় বসার কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না জায়েদ। অনেক খুঁজে পেতে ত্রেতাদের বেঞ্চে একটা জায়গা দেখে বলল, এখানে কি আমি বসতে পারি? তমাল গম্ভীর হয়ে দূরে সিমির সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন আসিফকে দেখিয়ে বলল, ও বসেছে এখানে। ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করল ত্রেতা। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, আরে বস না, নো প্রবলেম। সবাই বসলে অনেক জায়গা বেরিয়ে যাবে। জায়েদ তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে ত্রেতার পাশে গিয়ে বসল। তারপর ত্রেতাকে খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, তারপর কী খবর? ত্রেতার অভিব্যক্তি এমন হলোÑ যেন চোর ধরা পড়েছে! সে চোরা চোখে একবার তমালকে দেখে নিয়ে কোনোমতে বলল, এই তো ভালো! এটা শুনে তমালের চক্ষু চড়কগাছ, তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ত্রেতা বন্ধু বেঈমান টাইপের কিছু। তাদেরকে না জানিয়ে নতুন একটা ছেলের সঙ্গে কীভাবে আলাপ হয় ত্রেতার! সে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে ত্রেতার দিকে তাকায়। যতদূর সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ত্রেতা বলে, পরিচয় করিয়ে দেই, ও হচ্ছে জায়েদ আর জায়েদ ও তমাল। ততক্ষণে আসিফ এসে গেছে। সে খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে জায়েদকে ‘তুই’ সম্বোধন করে বলে, কিরে তুই কী মনে করে আমার জায়গা দখল দিলি! আর ত্রেতার দিকে তাকিয়ে বলে, আর তুই এ রকম নিউজ প্রেজেন্টারের মতো বলছিস কেনÑ পরিচয় করিয়ে দেই...এই হলো জায়েদ আর এই হলো...ফান্ডাটা কী হ্যাঁ? সবাইকে অবাক করে দিয়ে জায়েদ আসিফকে বলে, আমি উঠে গেলে তুই বসবি, নাকি চারজন চাপাচাপি করে বসব? হাতে তালি দিয়ে আসিফ বলে, আরে তুই তো লাইনের মাল দেখছি, হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বলে, ওয়েলকাম টু আওয়ার মাফিয়া ওয়ার্ল্ড। জায়েদ বলে, তোরা মাফিয়া নাকি? সিসিলি বেইসড, নাকি দুবাই? চারজনে এক সঙ্গে হেসে ওঠে। আসিফ গিয়ে তমালের পাশে বসে। তমাল কণ্ঠ খাদে নামিয়ে তাকে বলে, ডালমে কুছ কালা হ্যায়, ত্রেতা আগে থেকেই ওকে চেনে। ওর সঙ্গে ত্রেতার আলাপ হয়েছে, আর আমরা জানলাম না, এটা কি তোর স্বাভাবিক মনে হচ্ছে? এই কথা বলতে বলতে দরজার দিকে তারা তাকিয়ে দেখে হন্তদন্ত হয়ে অনরা এলো। এসেই ঘড়ি দেখে সে বুঝল সে ১৫ মিনিট লেট। এই ১৫ মিনিট তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার, এই প্রথম এমন হলো। দেরি হওয়ার জন্য ছাত্রদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সরাসরি লেকচার শুরু করে দিলÑ পরীক্ষামূলক জীববিজ্ঞান এবং বিবর্তনের মধ্যে একইভাবে মেন্ডেলীয় জেনেটিকÑ তত্ত্ব, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং উত্তরাধিকার বিষয়ে ক্রোমোজোম-ত্বত্ত্বের মধ্যে একটা গুরুতর যোগসূত্র এসেছিল টমাস মরগানের ফ্রুট ফ্লাই ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টের ওপর গবেষণা থেকে। উত্তরাধিকার বিষয়ে তিনি আর তার সহকর্মীরা মেন্ডেলীয় ক্রোমোজোম-তত্ত্ব ব্যক্ত করেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাদের গবেষণাপত্র ‘দ্য মেকানিজম অব মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিটেন্স’-এর ভেতর দিয়ে। এ সময়ে বহু জীববিজ্ঞানীই ক্রোমোজোমের মধ্যে জিনের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। তবে এটা কীভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন আর ক্রমিক বিবর্তনের সঙ্গে সুসঙ্গত তা পরিস্কার হয়নি! অনরা প্রায় এক নিঃশ্বাসে লেকচার দিয়েই চলেছেন। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ত্রেতা জায়েদকে বলে, আজকে ম্যামের লেকচার একটু বেশি বুকিশ লাগছে না? ঠিক উনার স্টাইলের লেকচার মনে হচ্ছে না কিন্তু! জায়েদ বলে, হিস্ট্রি তো একটু এমনই, হিস্ট্রি না জানলে অ্যাডভান্স লেভেলে কমিউনিকেট করতে সমস্যা হবে। ত্রেতা বলে সেটা বুঝলাম, কিন্তু হিস্ট্রি হোক আর যা-ই হোক উনার লেকচার এতটা বোরিং না কিন্তু! উনার চেহারা দেখেছ, কেমন বিধ্বস্ত, তার ওপরে ক্লাসে এতটা দেরি করে এলেন। জায়েদ সাধারণত লেখাপড়ার বাইরে তেমন কিছু খেয়াল করতে পারে না । কিন্তু ত্রেতা বলার পর সে লক্ষ করল, একটু ক্লান্ত বটে অনরা মালিক। অনরা বলেন, এরপর স্টেপ বাই স্টেপ আমরা জটিল থেকে জটিলতর বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকব। এই জটিল বিষয়গুলোর মধ্যে ঢোকার আগে আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করি। জীবদেহে একটা জিন রয়েছে যেটাকে বলে ‘স্বার্থপর জিন’। সহজ করে বললে যে জিন জীবগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের উপস্থিতি বাড়িয়ে তুলতে সবসময় সচেষ্ট তাদেরকেই বলা হয় স্বার্থপর জিন। রিচার্ড ডকিন্সের তত্ত্ব অনুসারে যে জিন যত স্বার্থপর হবে, মানে নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে সেই জিনই জীবজগতে বেশি করে জায়গা করে নেবে। কিন্তু জিনের তো নিজস্ব কোনো সচেতনতা নেই, তাহলে সে কীভাবে স্বার্থপর হতে পারে? আসলে যে জিনের প্রভাবে জীব নিজের জিন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে, সেই জিনই নির্বাচিত হবেÑ যেন জিন ড্রাইভিং সিটে বসে জীবকে নিজের কন্ট্রোলে এমনভাবে চালাচ্ছে, যাতে সে জিনের আরো ‘কপি’ তৈরিতে সাহায্য করে। হঠাৎ করে এই কথাগুলো নানাভাবে তার মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সে বুঝতে পারল এভাবে আর বেশিক্ষণ কথা চালিয়ে নেয়া যাবে না। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সে বলল, আমি স্যরি শরীরটা একদম ভালো লাগছে না, আজকে আর ক্লাসটা কন্টিনিউ করতে পারছি না, নেক্সট ক্লাসে এটা আমরা পুষিয়ে নেব। কথা শেষ করে চেয়ারে বসে পড়ল অনরা। মাথায় হাত দিয়ে প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সে। তার এ যাবৎকালের অর্জিত সব জ্ঞান মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। খুবই আতঙ্কিত বোধ করতে লাগল সে! সে এতটাই রাশভারী স্বভাবের যে কেউ সাহস করে তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে সবাই। অনরা সেই একইভাবে বসে থেকে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। ত্রেতাদের সঙ্গে এক সঙ্গে বেরোনোর সময় জায়েদ অনরার কাছে গিয়ে বলল, ম্যাম আপনি কি বেশি সিক ফিল করছেন, নিড অ্যানি হেল্প? অনরা কোনোমতে বলল, না হয়তো প্রেসার ফল করে থাকবে, কিছুক্ষণ বসলেই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একবার লাঞ্চের পর আমার রুমে দেখা করে যেও, তোমাদের প্রজেক্টটা আমি দেখেছি। জায়েদ খুবই স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে বলল, ওকে ম্যাম। তারপর বেরিয়ে গেল। ত্রেতার অনরার জন্য খুব মায়া লাগছিল। উনার হাজব্যান্ড মারা যাওয়ার পর থেকে কোনোদিনও উনাকে হাসতে দেখিনি বলছিল ত্রেতা, সারাক্ষণ বিষণœ থাকেন, সঙ্গে মানুষের উৎপাত তো আছেই। বাংলাদেশে একজন ডিভোর্সি বা একজন বিধবা মেয়ের তো বিপজ্জনক শুভাকাক্সক্ষীর কোনো অভাব নেই। তার ওপরে সে যদি আবার সুন্দরী হয়! যাই বল উনাকে ওইভাবে একা ফেলে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত হয়নি। আসিফের মতো দুষ্টু মানুষ কোনোরকম রসিকতা না করে বলল, আরে উনি এটা পছন্দ করবেন না যে ছাত্র-ছাত্রী উনাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে। বেটার ফিল করলে উনি একাই চলে যেতে পারবেন। তাও ত্রেতার মনে একটু খচখচ রয়েই গেল, এই খচখচানি নিয়ে সে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেল।
অনরা বুঝতে পারছে এভাবে এখানে বসে থেকে খুব একটা লাভ হবে না। কোনো একটা প্রক্রিয়া তার অবচেতনে ক্রিয়া করতে শুরু করে দিয়েছে! প্রথমটাতে একটু ঘাবড়ে গেলেও এখন সে বুঝতে পারছে যে এখন থেকে এই পরিস্থিতির সঙ্গেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। মাথায় প্রতিটি মুহূর্তে যদি এসব ক্রিয়া করতে থাকে, তাহলে একটা সময় তার ফোকাস পয়েন্টটা অ্যাবসলুট হবে। তখন হয়তো তার চাওয়াগুলো বাস্তবে ক্রিয়া করতে থাকবে। সুতরাং সে উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল। ওঠার সময় একটু পা টলে গেলেও সে নিজেকে সামলে নিল। তার মাথায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে মনোসংযোগের প্রক্রিয়া অনবরত চলতেই থাকল। নিজের রুমে ফেরার পরও বিষয়টি অপরিবর্তিত থাকায় আশ্বস্ত বোধ করল সে। ব্যাপারটা তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তার মনের ভেতরে এক ধরনের আনন্দ খেলে গেল এই ভেবে যে, সেদিন নিশ্চয়ই বেশি দূরে নয় যেদিন রাহাত তাকে শুনতে পাবে! লাঞ্চ টাইম কখন পেরিয়ে গেছে সে খেয়ালই করল না! দরজায় খট খট শুনে মনোসংযোগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেই সে বলল, ইয়েস কাম ইন। জায়েদ এলো। অনরাকে দেখে তার মতো রোবটিক চরিত্রের মানুষও যেন একটু ধাক্কা খেল! তবুও সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল, ম্যাম লাঞ্চের পর আসতে বলেছিলেন! অনরা মাথা তুলে একধরনের অর্থহীন দৃষ্টিতে জায়েদকে দেখে বলল, লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে তাই না? বস, বস। একটু দম নিয়ে সে বলল, তোমাদের গেমটা আমি অসংখ্যবার দেখেছি, ইজ দিস রিয়েলি অ্যা গেম? জায়েদ প্রশ্নটার ধরন বুঝতে না পেরে বলল, জি ম্যাম? দেখ তোমাদের কাজটার ভেতরে আমি ইনভেনশনের একটা গন্ধ পেয়েছি, এটা নিছক একটা গেমে আটকে রাখলে চলবে না। এটা দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে প্রতিটা প্রাণী ভেদে আমরা যদি তার জিনের গঠন এবং কোন জিন কোন অ্যামাউন্ট অব ভ্যালুতে ডিস্ট্রিবিউটেড হয়েছে, সেটা ফিগার আউট করতে পারলে, এমনকি মৃত মানুষকে আবারো জীবিত করা সম্ভব! এক নিঃশ্বাসে কথাটা শেষ করে বড় একটা দম নিল অনরা। তারপর বলল, আমি গেমটা খেলতে খেলতে একপর্যায়ে যখন যিশুকে বাঁচিয়ে তুললাম, তখন বুঝলাম মৃত্যুর সময় যিশুর জিনের যে বিন্যাস ছিল, সেটা হুবহু মেলাতে পারার কারণে আমি তাকে জীবিত দেখতে পেলাম। হঠাৎ কিছু একটা ধরে ফেলেছে এমন এক অভিব্যক্তি দিয়ে সে জায়েদকে বলল, তার মানে যেসব সম্ভাবনার কথা আমি তোমাকে বলছি, সেসব জেনেই গেমটা তুমি ডেভেলপ করেছ, সো তোমার কাছেও এটা নিছক কোনো খেলা নয়! জায়েদ চুপ করে অনরার কথা শুনছিল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, এ কারণেই গেমটা আপনাকে দেখিয়েছি ম্যাম। আমি আসলে গাইডলাইন খুঁজছিলাম, হাউ টু ডিক্লিয়ার দিস! অনরা বলে, ব্যাপারটা অতটা ইজি হবে না জায়েদ, তোমাকে এটা থিওরিটিক্যালি প্রুফ করার পাশাপাশি ল্যাবরেটরি প্রুফও দেখাতে হবে। সেইরকম ল্যাব সাপোর্ট বাংলাদেশে নেই এবং বিপুল পরিমাণে টাকা-পয়সাও লাগবে এটার জন্য। জায়েদ বলে, তাহলে এখন আমি কী করব ম্যাম? একটু ভেবে নেয় অনরা, তারপর বলে, প্রথম তো তোমাকে বিশ্বস্ত আর পটেনশিয়াল একটা রিসার্চ টিম তৈরি করতে হবে এবং সেটা দেশের বুকে আটকে রাখলে চলবে না, একটা স্মার্ট কোলাবরেশন লাগবে, সেটার জন্য আই ক্যান হেল্প ইউ। তবে সব কিছুর আগে এটাকে একটা থিওরি হিসেবে নিজের নামে প্যাটেন্ট করে নিতে হবে তোমাকে। জায়েদ খুবই উত্তেজিত আর কৃতজ্ঞ বোধ করতে লাগল। বার বার সে অনরাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করল তার শরীর ঠিক হয়েছে কি না? অনরা লক্ষ করল এতক্ষণ এতটা জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলার সময়ও তার মনোসংযোগ প্রক্রিয়ায় একটুও ব্যাঘাত ঘটেনি। সে একটা ক্লান্ত হাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ ঠিক আছি। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জায়েদ দরজার কাছে পৌঁছানোর পর সে পেছন থেকে লোভাতুর কণ্ঠে জানতে চাইলÑ তুমিও বিশ্বাস করো জায়েদ মৃত মানুষের ফিরে আসা সম্ভব? তার দিকে ফিরে একটু ভেবে নিয়ে ছোট্ট একটা শব্দে জায়েদ বলে, সম্ভব। তারপর সে বেরিয়ে যায়।

নয়.
ওই দিনের পর থেকে অনরার জীবনযাপন আমূল পাল্টে গেছে। জাগ্রত অবস্থায় তো বটেই, এমনকি ঘুমেও চলে তার মনোসংযোগের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ভেতরেই সেসব স্বাভাবিক কাজকর্ম করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, ক্লাস নেয়। ছোট ভাইয়ের বাচ্চাটা ধেই ধেই করে বড় হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে হচ্ছে মহা দুষ্টু। বাচ্চাটার কারণে অয়নের বাসায় যাওয়া বেড়ে গেছে অনরার। বিশ্ববিদ্যালয়ে আগেও তাকে নিয়ে আলোচনা হতো, এখনো আলোচনা হয়, কিন্তু আলোচনার ধরন খানিকটা বদলেছে। সবার ধারণা অনরা মানসিকভাবে খুব একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই। কোনো কোন অতি উৎসাহী সহকর্মী সমব্যথী হয়ে তার পাশে ভেড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অনরার দৃঢ়তার কাছে মুহূর্তেই পরাস্ত হয় সেই উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষে প্রতিদিন গোরস্তানে যাওয়ার ব্যাপারটাও একই আছে। আজিজের সঙ্গে কথা হলেই সে জানতে চায় আর কোনো মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তার কথা হয়েছিল কিনা! আজিজ জানায়, ওইদিনের পর আর কখনোই এমন ঘটনা ঘটেনি! এটা শুনে একটু মন খারাপ হয় অনরার, কারণ সে এখনো বিশ্বাস করে রাহাত ফিরে আসবে, আজিজের সঙ্গে কথাও হবে তার! রাহাতের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে সে অন্যান্য কথার ফাঁকে সে কে বলতে ভোলে না- এভরি পসিবলওয়েতে আমি ট্রাই করছি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে, অ্যান্ড উই উইলবি টুগেদার এগেইন! বাড়ি ফিরে এখন সে ইউটিউব ঘেঁটে মেডিটেশনের সব পদ্ধতি শিখে নেয় এবং সাধনা করে। তার মনোসংযোগ প্রক্রিয়ার মূলে থাকে রাহাতের অবিন্যস্ত জিনগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করার প্রচেষ্টা। জায়েদকে নিয়ে আর ক্যালিফোর্নিয়ার দুই বিজ্ঞানী নিয়ে অনলাইন কনফারেন্স করে প্রতিনিয়ত তারা চেষ্টা করে চলেছে একটা কংক্রিট থিওরি দাঁড় করাতে। এরপর তাদেরকে দেশের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে ঘটনাটা ল্যাবরেটরিতে ঘটানোর জন্য। বোঝাই যাচ্ছে এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার আছে। তাই সে এখনো রাহাতকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তার মনোসংযোগ প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাশীল, সে জানে রাহাত ফিরে আসবে! আজকাল রাহাতের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সে রাহাতকে শুনতে পায়, খুব ক্ষীণ হলেও সে শুনতে পায় তাকে, কাউকে বলে না সে কথা! সে জানে ভালোবাসার পক্ষে পৃথিবী কোনো নিরাপদ জায়গা নয়, সঠিক ভাবনার মানুষকে এখানে পাগল বলা হয়!

দশ.
আজকাল রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব চাপে আজিজের। তার মতো পরিশ্রমী আর সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মানুষের আর যা-ই হোক বহুমূত্র রোগ হওয়ার কথা নয়। তবুও সে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে দেখেছে, কিন্তু তার ডায়াবেটিস নেই। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছে বয়স বাড়লে নানারকম মানসিক কারণেও এমন হতে পারে! আজকে রাতে এই নিয়ে চতুর্থবার সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বের হলো। গভীর রাত। সুনসান চারিদিক। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর দু-একবার শেয়াল-কুকুরের ডাক ছাড়া একেবারেই নিস্তব্ধ চারিদিক। নিজের ঘর থেকে ছয় ব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে সে সামনে এগিয়ে গেল। কিছুদূর এগোনোর পরই অনুভব করল দূরের একটা কবরে কিছু একটা নড়ছে। গোরস্তানের এই দিকটাতে আলো কম থাকায় শেয়ালের উৎপাতটা একটু বেশি। আজিজ চকিতেই টর্চ জ্বালতে গেল। কী মনে করে টর্চ না জ্বেলেই সামনে এগিয়ে গেল। যত সামনে এগোচ্ছে ততই নড়াচড়াটা স্পষ্ট হচ্ছে। সম্পূর্ণ কাছাকাছি না গিয়ে সে কাছাকাছি একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল কী ঘটে দেখার জন্য। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো পড়ছে। সাধারণত পূর্ণিমায় এমনটা হয়। আজিজ ভাবে পূর্ণিমাই হবে নিশ্চয়। সেই আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পায় দশটা মলিন পুরুষালি আঙুল কবরের কিনারায় ভর করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে! নিজের ঘর অন্ধকার করে মনোসংযোগ প্রক্রিয়ায় বসে থাকা অনরা যেন একটু কেঁপে ওঠে। আজিজ আরো একটু সামনে এগোবে কিনা ভাবতে ভাবতে দেখে দু-হাতে ভর দিয়ে অর্ধেকটা মাথা বের করে ফেলেছে সেই মুর্দা! এবারে কবরটাও চিনতে পারে আজিজ। এটা রাহাতের কবর। বছরের পর বছর যার স্ত্রী রয়েছে তার ফেরার অপেক্ষায়! নিজেকে একেবারে লুকিয়ে ফেলে আজিজ। সে ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই দৃশ্য সে দেখেনি, এবং এই ব্যাপারে কোনো বাধা সে দেবে না! শতচ্ছিন্ন কাফনের কাপড় নিয়ে সে আজিজের চোখের সামনে বেরিয়ে এলো। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চাঁদের আলোও তার কাছে তীব্র লাগছে। কপালের ওপরে হাত দিয়ে মানুষ যেভাবে রোদ সামলায়, সেভাবে সে চাঁদের আলোতে নিজেকে ধাতস্থ করতে একটু সময় নিল। দীর্ঘদিন কোমা-তে থাকা রোগীর মতো জড়ানো কণ্ঠে সে বলল, অনরা চা আনতে কোথায় চলে গেলে! নিজের অন্ধকার ঘরে বসে চমকে উঠে চোখ খুলল অনরা। এই অন্ধকারেও তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে!

এগার.
প্রতিদিনের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে তালা দিতে গেল অনরা। তারপর কী মনে করে তালা না দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। রাতে স্পষ্ট মনে হলো রাহাত তাকে ডাকল, তারপর থেকে বাড়ি থেকে বেরোতেই মন চাইছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা না থাকলে আজকে সে যেত না। মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে তার অনেক চাপ যায়। তবুও দায়িত্ব বলে তো কথা। ড্রাইভারকে বিদেয় করার পর থেকে নিজেই গাড়ি চালায় সে। গাড়ির কাছে যেতে যেতে মনে হলো, দরজা খুলে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। চুরি-ডাকাতি যে হারে বেড়েছে, বলা তো যায় না কখন কী অঘটন ঘটে! মনে পড়ল যখন তার আর রাহাতের সংসার ছিল, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তারা চাবি লুকিয়ে রাখত। যে আগে বাড়ি ফিরত সে সেখান থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলত। দরজা লক করে দিয়ে সেই গোপন জায়গাটাতে চাবি রেখে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল অনরা।
আজকে সমস্ত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচ- কর্মব্যস্ততার একটা দিন গেল। এত কষ্টের পরীক্ষার ডিউটি শেষে যদি শুনতে হয় প্রশ্ন আউট হওয়ার কারণে পরীক্ষা বাতিল তাহলে কেমন লাগে! সিন্ডিকেটের জরুরি সভা ডাকা হয়েছে বিকেল পাঁচটায়। তার আগে দফায় দফায় ডিপার্টমেন্টে মিটিং হচ্ছে। অনরা কিছুতেই মন দিতে পারছে না। বিকেলে যে গোরস্তানে না গেলেই নয়! কিন্তু সে এখনই আশঙ্কা করছে আজকে এই পরিস্থিতিতে বেরোনোর কোনো উপায় নেই! সিন্ডিকেটের মিটিং চলল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে একটা, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার আগপর্যন্ত পরীক্ষা উইথহেল্ড করা হয়েছে। মিটিং শেষে এই কথা সেই কথায় বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেল! গাড়িতে উঠেই সে গোরস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পরে নিজেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করল এই বলে যে, রাতবিরেতে তাকে গোরস্তানে দেখা গেলে, ব্যাপারটাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নেবে না। সে এমনিতেই বুঝতে পায় তার আড়ালে তাকে নিয়ে অনেকেই বলাবলি করে যে তার মানসিক সমস্যা আছে। রাতবিরেতে গোরস্তানে তাকে দেখা গেলে তাকে পরিপূর্ণ পাগল বলতে আর বাধা থাকবে না। অগত্যা গাড়ি ধানম-িতে নিজের বাড়ির উদ্দেশেই ঘোরাতে হলো। যাওয়ার পথে একটা রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার নিয়ে নিল সে। বাড়িতে গিয়ে রান্না করার শক্তি নেই আজকে। অথচ রাহাত থাকতে শত ক্লান্তি সত্ত্বেও কী আনন্দ নিয়েই না প্রতিদিন সে রান্না করত! বাড়িতে ঢোকার মুখে কালো কুচকুচে একটা কুকুরকে দেখে তাকে ব্রেক করতেই হলো। গাড়ি দেখে কুকুরের নড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। অনরা সচরাচর হর্ন বাজায় না, কুকুর যেহেতু সরছে না, হর্ন না বাজিয়ে আর উপায় থাকল না। কয়েকবার হর্ন বাজানোর পরও কুকুর নড়ল না। অনরা গাড়ির এক্সেলেটরে হালকা চাপ দিয়ে সামনে এগোতে এগোতে হর্ন বাজাল। খুব আলস্য নিয়ে একটু সরে জায়গা করে দিল কুকুর, কিন্তু ঘেউ ঘেউ তো দূরের কথা টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত সে করল না! ভেতরে ঢুকে গাড়ি পার্ক করে দরজার কাছে এসে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে চাবি নেয়ার জন্য হাত বাড়াল সে। কিন্তু সেখানে চাবি নেই! নিজের ভুল হতে পারে ভেবে নিজের ব্যাগে তন্ন তন্ন করে খুঁজল চাবি। এরপর দরজায় হাত দিতে আপনাতেই খুলে গেল দরজা! সে বুঝতে পারল মনের ভুলে ঠিকই সে দরজা খোলা রেখে চলে গেছে। মনে মনে আশ্বস্ত হলো এই ভেবেÑ ভাগ্যিস চোর-টোর ঢোকেনি! কিন্তু দরজা খুলেই তার মনে হলো টিভি চলছে। তার আত্মার মধ্যে ধুক করে উঠল! আরেকটু সামনে এগোলেই সে স্পষ্ট ফুটবল খেলার কমেন্ট্রি শুনতে পেল। অনরার হৃদস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে যখন-তখন হৃৎপি- বেরিয়ে আসবে! তবুও তার বিজ্ঞানমনস্ক মন তাকে বার বার বলছে, ডোন্ট হ্যালুসিনেট অনরা, ডোন্ট হ্যালুসিনেট। বেডরুমের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে হিম হয়ে গেল অনরার শরীর। বিছানায় ময়লা জুতো নিয়ে আয়েশ করে পা নাড়ছে কেউ! আর এক পাও সামনে বাড়ানোর শক্তি নেই অনরার। অনেকক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল সে! জীবনের সব সাহস একসঙ্গে জড়ো করে সে আরো সামনে এগোল। কমেন্ট্রি থেকে বোঝা যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার খেলা হচ্ছে। অনরা বিস্মিত হয়ে মনে মনে বলছে, এ তো হুবহু সেই রাত! সেই রাতেও বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের খেলা হচ্ছিল, বার্সেলোনা এক গোল দিয়েছিল! এক রকম টলতে টলতে ঘরের ভেতরে ঢুকল অনরা। তাকে দেখে চিন্তিত মুখে রাহাত বলল, আমি তো ভেবেছিলাম চা আনতে তুমি সিলেট চলে গেছ! এক কাপ চা বানাতে এতক্ষণ লাগে! বলতে বলতেই গোল বলে চিৎকার করে উঠল রাহাত, লিওনেল মেসি বার্সেলোনার পক্ষে একটা গোল করল। তার পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল অনরা। রাহাত তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল! কোনোরকমে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পর রাহাত দেখল জ্বরে সে পুড়ে যাচ্ছে। তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া প্যাকেটের খাবারের মধ্যে কেবল পলিথিনে মোড়ানো স্যুপটা অক্ষত আছে। সেই স্যুপ বাটিতে ঢেলে একটু একটু করে অনরার মুখে দিল সে। তারপর গভীর ঘুম। সকালে তাকে ঘুম থেকে ডাকল রাহাত। রাতের কথা কিচ্ছু মনে নেই তার। রাহাত কীভাবে তার পাশে এলো তা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই তার মাথায়! রাহাত তাকে বেশ চিন্তিত হয়ে বলল, অনরা তোমার ঘড়িতে কয়টা বাজে? অনরা লক্ষ করল বাইরের পোশাক পরেই সে ঘুমিয়ে ছিল, হাতের ঘড়িটাও খোলা হয়নি। সে দেখল ঘড়িতে ৮টা ৩৫ বাজে। রাহাত নিজের ঘড়িতে ৮টা ৩৫ মিলিয়ে নিল। তারপর উদ্বিগ্ন চোখে দেখল তার ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘুরছেÑ ৮টা ৩৫ থেকে ৩৪, ৩৩, ৩২ করতে করতে ৭টা, ৭টা থেকে ৬টা আর অনরার ঘড়িতে ৮টা ৩৫ থেকে ৩৬, ৩৭, ৩৮...৯টা...১০টা...১১টা...তারা পাশাপাশি নিশ্চুপ বসে থাকে! একজনের ঘড়ি ধাবিত হয় ভবিষ্যতের দিকে, আরেকজনের অতীত অভিমুখে!

 

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka’s Toxic Air: High levels of cancer-causing elements found

The concentration of cancer-causing arsenic, lead and cadmium in Dhaka air is almost double the permissible limit set by the World Health Organization, a new study has found.

4h ago