‘ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের কথা বলে অসদুপায়ে দাম বাড়াচ্ছে’

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্যের মধ্যে আমাদের দেশে বেশি আমদানি হয় গম, সরিষা, মসুর ডাল, মটরের ডাল ও তিসি দানা। কিন্তু এগুলো ছাড়াও দেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বর্তমান মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্যের মধ্যে আমাদের দেশে বেশি আমদানি হয় গম, সরিষা, মসুর ডাল, মটরের ডাল ও তিসি দানা। কিন্তু এগুলো ছাড়াও দেশে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বর্তমান মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।

তারা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাব থাকলেও তা আগামী ১ থেকে ২ সপ্তাহ পর বাংলাদেশের বাজারে পড়ার কথা। কিন্তু তার আগেই অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেশি বেড়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসায়ীরা সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকেন। তারা বর্তমানে যে উচ্চমূল্যে জিনিসপত্র বিক্রি করছেন তা কিন্তু অনেক আগেই আমদানি করা হয়েছে। তখন জিনিসপত্রের দাম এতো বেশি ছিল না।'

তিনি বলেন, 'ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দাম বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। বাংলাদেশের বাজারে যুদ্ধের প্রভাব আরও ১-২ সপ্তাহ পরে পড়ার কথা। ব্যবসায়ীরা যুদ্ধের কথা বলে অসদুপায়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিছু পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে।'

'আমাদের বাজার ব্যবস্থা মূলত নির্দিষ্ট কিছু মানুষ নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে প্রতিযোগিতা না বেড়ে বরং কমেছে। তা ছাড়া বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ রাখতে আমাদের যেসব উদ্যোগ নেওয়ার কথা তা তেমনভাবে নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ভালোভাবে তদারকি করা হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে অভিযানের মাধ্যমে কয়েকজনকে জরিমানা করতে দেখি। কিন্তু যারা নাটের গুরু তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছেন,' যোগ করেন তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। আমদানিকৃত পণ্যের শুল্ক, আন্তর্জাতিক মূল্য, বিনিময় মূল্য সাপেক্ষে যে দাম হওয়ার কথা তার থেকেও বেশি দাম নেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, 'বাজার ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট, মধ্যস্থতাকারী, নৈরাজ্য, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, স্টক ও প্রবাহের মধ্যে পার্থক্য, মজুদদারিসহ নানান সমস্যা আছে। বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তদারকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের যে নিয়মনীতি, তা ভালোভাবে কাজ না করলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেন। সরকারের যে স্টক আছে সেগুলো বাজারে ছাড়তে হবে। যাতে করে বাজারে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকে। বাজার তদারকি করে অগ্রিম আমদানি করতে হবে।'

আমদানি মূল্য এবং খুচরা মূল্যের যে পার্থক্য সেখানে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'সরকারের আমদানি বাড়ানো, স্টক পণ্য বাজারে ছাড়া, বাজার তদারকি, ভোক্তা অধিদপ্তরের যে কাজ তা সঠিকভাবে করা দরকার। আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তর কাজ করছে না এবং ব্যবসায়ীরা বাজার কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের যে ধরনের নজরদারি দরকার সেটি তেমনভাবে হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, যথাসময়ে আমদানি, শুল্ক, পণ্যের মজুদসহ সরকারের হাতে যেসব বিষয় আছে সেগুলোও তেমনভাবে কাজ করছে না।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উৎপাদন মূল্য বাড়লে এবং বাজারে যোগান কম থাকলে সাধারণত পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু আমরা প্রায়শই দেখি যোগান বেশি থাকলেও দাম বাড়ে। সাধারণত অর্থনীতির যে আইন বা নিয়ম সেটি এখানে আসলে কাজ করে না।'

পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'উৎপাদিত এলাকায় যে পণ্যের মূল্য সেটি ঢাকা বা ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর সঙ্গে যদি শুধু পরিবহন খরচ থাকতো তাহলে এতো বেশি দাম হতো না। সমস্যা হলো পণ্য পরিবহনের সময় বিভিন্ন এলাকায় চাঁদা ও কমিশন দিতে হয়। এই চাঁদা ও কমিশনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো চেষ্টা করছে না সরকার। পুলিশ ও সরকার দলীয় কিছু মানুষ এই চাঁদা ও কমিশনের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে উৎপাদন খরচ ও যোগানের মধ্যে সম্পর্ক না থাকলেও দাম বাড়ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'কোনো কারণ ছাড়াই যখন বিদ্যুৎ, গ্যাস পানির দাম বেড়ে যায় তার একটি প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। সরকার বাজার তদারকি, সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। পাশাপাশি সরকারের যে পলিসি সেখানেও সমস্যা আছে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।'

Comments