উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবীদের একজন আহমদ ছফা

দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ মারাত্মকভাবে সংকীর্ণ। ভিন্নমত কেউ সহ্য করে না। সুযোগ পেলেই রুখে দিতে চায়। আড়াল করতে চায় বিভিন্ন তকমায়। এর মধ্য থেকেই উজ্জ্বল হন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফা। ছবি: নাসির আলী মামুন

দীর্ঘদিন বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ মারাত্মকভাবে সংকীর্ণ। ভিন্নমত কেউ সহ্য করে না। সুযোগ পেলেই রুখে দিতে চায়। আড়াল করতে চায় বিভিন্ন তকমায়। এর মধ্য থেকেই উজ্জ্বল হন আহমদ ছফা।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সময়, সমাজ নিয়ে তৎপর বুদ্ধিজীবীদের একজন তিনি। তার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার মধ্যে নিজস্বতা গুণে ও পরিমাণে। নানান ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বঞ্চিত মানুষের জন্য কথা বলেছেন তিনি। অনেকে রাগ করতেন, মেনে নিতে পরতেন না, তবু থেমে থাকেননি ছফা। ত্যাগ-তিতিক্ষায়, অনেক কষ্ট করে নির্মাণ করেছেন আপন জগত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য সদা জাগ্রত ছিল তার মানবিক বোধ।

সেই প্রেক্ষিত আবেগ আর আদর্শের কথা নিজেই এক জায়গায় লিখেছেন। এভাবে 'জীবনের কাছে আমার প্রার্থনা, হে জীবন, তুমি যদি দ্রুত ঈগলের মতো অভীষ্ট অভিমুখে বাতাসে ভর করে ছুটতে না পারো, সেইখানে থেমে যেয়ো। কর্মহীন, গর্বহীন আমাকে কেউ যেনো জীবিত দেখতে না পায়। আমি যেন লোভের কাছে, মোহের কাছে, হীনতা, পরবশ্যতা এবং আলস্যের কাছে পরাজিত না হই।' (৬ মার্চ ১৯৭৩, আহমদ ছফা ডায়েরি)

আহমদ ছফা ত্যাগে, মেধা মননে সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে প্রায় ত্রিশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আহমদ ছফা রচনাবলী তিনি জীবিত থাকতেই প্রকাশিত হয়।

নিয়মিত পত্রপত্রিকায় লিখতেন তিনি। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাঙালি মুসলমানের মন, যদ্যপি আমার গুরু। গ্যোটের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তার অসামান্য কীর্তি।

তার উপন্যাস ওঙ্কার অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। চলচ্চিত্র হয়েছে উপন্যাসটি অবলম্বনে। তার পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ উপন্যাসটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য সুলতান পাঠশালা।

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতে, 'ছফার রচনাবলী গুপ্ত ধনের খনি এবং সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে। যে জগতে যেকোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।' আহমদ শরীফ বলেন, 'সুবিধাবাদীদের a compromise তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরও কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।'

নাসির আলী মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফা বলেন, 'কতটা সাহস দীপ্ত কণ্ঠস্বর থাকলে বলতে পারেন, মানুষের মধ্যেই গোঁজামিল থাকে। কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপ। যে শেয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শেয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, শেয়ালও হইতে পারে, পাখিও হইতে পারে। মানুষেরই বিভিন্ন চরিত্র নেওয়ার ক্ষমতা আছে। বুঝছো, গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শেয়াল পাওয়া যাইতো। এগুলো নাই এখন। কারণ সাপ, শেয়াল এরা মানুষ হিসেবে জন্মাইতে আরম্ভ করছে।'

সলিমুল্লাহ খান এক প্রবন্ধে লিখেন, 'আহমদ ছফা যেদিন মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন, তাহার দুই কি তিন দিন পর লেখা একটি নিবন্ধে আমি তাহাকে "আমাদের কালের নায়ক" উপাধিতে ভূষিত করিয়াছিলাম। তাহাতে কেহ বা মৃদু আর কেহ বা অট্টহাসি হাসিয়াছিলেন। আজ প্রায় দুই দশক হইতে চলিল।'

'আমার ধারণা এখনও পরিবর্তিত হয় নাই। আহমদ ছফাই এখনও আমাদের কালের নায়ক। কি ভাবের ঘরে কি ভাষার দরবারে তাহার সহিত তুলনা দিবার মতন কোনো লেখক- অন্তত ভূ-বাংলাদেশে যাহারা বাংলায় লেখেন তাহাদের মধ্যে আমি খুঁজিয়া পাই নাই। কেহ যদি দুই চোখে আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দেখাইয়া দেন আমি চিরবাধিত থাকিব। প্রয়োজনে নিজের নামটা কাটিয়া ফেলিব।'

খ.

আহমদ ছফা ব্যক্তিগতভাবে অস্থির জীবনযাপন করলেও মাটি মানুষের বিষয়ে অটল ছিলেন। লেগে থাকার মানসিকতা তার জীবনে নেই। তবে তার রেখে যাওয়া সৃষ্টিতে বিচরণ করলেই বোঝা যায় সাহিত্যিক হিসেবে প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অন্তর্দৃষ্টি কতটা প্রখর। আর প্রান্তিক মানুষের ভাবনার সঙ্গে ঐতিহ্য সচেতনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে সাহিত্যিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে কালের চিন্তানায়কের মর্যাদায় পরিচিতি দিয়েছে।

সমাজ নায়কেরও দুঃখ থাকে, থাকে বেদনা। থাকে চারপাশের নানান ভাবনার হাহাকার। সেই চিত্র উঠে তার ডায়েরিতে। তিনি লিখেন, 'আমার জীবনটা দুঃখময়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুঃখটাকেই আমি ভুলে থাকি। বৈজ্ঞানিক নির্লিপ্ততা এবং অনপেক্ষকতা নিয়ে বেশিরভাগ সময়ে কাজ করতে পারিনে।' অন্যত্র বলেন, 'আমাকে আরও চেতনা সম্পন্ন হয়ে উঠতে হবে।' (৫ মার্চ ১৯৭৩)

'নিজেকেই প্রশ্ন করছি, এ সমাচ্ছন্ন অন্ধকারে আমি কি নিজের গন্তব্য অভিমুখে অগ্রসর হতে পারছি? এখনও তো কর্তব্যকর্মের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পারছিনে। প্রচণ্ড এতটা আমিত্ব এখনও চারদিকে বেষ্টনী রচনা করে রেখেছে। চারদিকে যশ, মান সফলতা এবং কামনার স্রোত বইছে প্রবল বেগে, অথচ আমি যেন কিছুতেই নেই। বড় ক্লান্তি বোধ করছি।'

'সমস্ত সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে সব সময় এক ধরনের নিষ্ঠুরতা আত্মগোপন করে থাকে!' (মরণবিলাস)

'জীবন সম্ভবত এ রকমই! আঘাত যতো মারাত্মক হোক, দুঃখ যতো মর্মান্তিক হোক, এক সময় জীবন সবকিছু মেনে নেয়। দুনিয়াতে সবচাইতে আশ্চর্য মানুষের জীবন।' (অলাতচক্র)

এইভাবে তার বোধ ও জীবন সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। তাছাড়া আহমদ ছফা সব সময় দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে ভাবতেন। যা দেখতেন তাই বলতেন। আড়াল করতেন না, গোঁজামিলের অন্ধকারে রাখতে চাইতেন না। চিন্তাকে পরিচ্ছন্ন করতে চাইতেন। সেই সঙ্গে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক অবস্থান বাংলাদেশের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রজন্ম তাকে প্রাত্যহিক ভাবনায় গ্রহণ করছে। গ্রহণ করছে তার আবিষ্কারকে। যেমন জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক নিয়ে তার 'যদ্যপি আমার গুরু'। গুরুর প্রতি তার যে আন্তরিকতা ও জীবনবোধের আখ্যান, তা যথাযথ।

অন্যদিকে আহমদ ছফার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান। সুলতানকে আলোচনায় নিয়ে আসেন ছফা। পাঠক যেন নতুন দিগন্ত পায়। আর দুজনেই ছিলেন বোহেমিয়ান বা ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং মোহ বিবর্জিত। ছফা বলেন, 'আমি মনে করি আমার স্বীকৃতি নিয়ে পশ্চিম বাংলা কী বলতে চায় সেটা আমার লুক আউট নয়। আমি পৃথিবীর গন্ধ এবং স্বাদ বুঝি। তুমি দেখবা আমি যখন আমেরিকায় যাবো তখন ওখানেও ঝড় তুলবো। তখন ওখানকার পণ্ডিতদের সঙ্গে দেখবে আমি কিভাবে মিশে গেছি। সুলতানের বিশালত্ব চিন্তা করো, ৭৬-এর আগে এই জায়ান্ট কোথায় ছিল? কেউ তাকে আবিষ্কার করলো না কেন? এই আমি যাকে প্রেজেন্ট করেছি, আরেকজন লোক আসুক তো এমন।'

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর। একটি রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে একজন চিন্তক অসামান্যভাবে বেড়ে উঠছেন। আমাদের পথ ও পথচারী আলাদা করে দিচ্ছেন। নিজস্ব কালচার, জীবনবোধ ও দেশপ্রেমে সমাজের দায় ও দায়িত্ব জ্ঞান করা একজন লেখককে খুঁজে পেয়েছেন পাঠক। তার অধিকাংশ কথা জাতীয় মানের ও গভীর চিন্তার। সমাজ রাজনীতি রাষ্ট্র সম্পর্কে তার ভাবনার দূরদর্শিতার প্রজ্বলন ভাবিয়ে তোলে। কারণ তিনি যা লিখতেন, তাই তিনি বিশ্বাস করতেন। অভিনয়, লোক দেখানো, কম জেনে বাড়াবাড়ি— এসব পছন্দ করতেন না। কালক্রমে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন ছফা। ফলে রচনা দেশ, সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক নিবন্ধাবলি মানুষের চিন্তার খোরাক হয়েছে। তিনি হয়েছেন বাংলা ভাষার একজন উজ্জ্বল বুদ্ধিজীবী।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka’s Toxic Air: High levels of cancer-causing elements found

The concentration of cancer-causing arsenic, lead and cadmium in Dhaka air is almost double the permissible limit set by the World Health Organization, a new study has found.

1h ago