মুক্তিযুদ্ধ

৩০ আগস্ট ১৯৭১: দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩০ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন ঘোষণা করেন দিল্লিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি কে এম শেহাবউদ্দিন। লন্ডনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিশন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল দিল্লিতে চালু হওয়া বাংলাদেশ মিশনের।

ঢাকায় এদিন

৩০ আগস্ট ভোরে ঢাকার ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় সুরকার আলতাফ মাহমুদ, চিত্রশিল্পী আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ ও খাইরুল আলম বিল্লাহকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

৩০ আগস্ট ঢাকার হরিরামপুরের ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী রসদ নিয়ে লঞ্চে করে যাওয়ার সময় অপারেশন চালায় মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য হতাহত হয়। লঞ্চ রেখেই পালিয়ে যায় বাকিরা।

৩০ আগস্ট ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপন খবরের ভিত্তিতে গেরিলাদের ধোলাই খালের পাশে গোপন ঘাঁটিতে অভিযান চালায়। এসময় গেরিলারা প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুললেও ধোলাই খাল সাঁতরে নিরাপদ স্থলে পৌঁছে যায়। এসময় দুই জন গেরিলা আহত হন।

মুজিবনগরে ডিপি ধরের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ বৈঠক

৩০ আগস্ট মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রীপরিষদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন বাংলাদেশ বিষয়ক ভারতের বিশেষ দূত এবং  ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর। এসময় তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে নানা আলোচনা করেন। ডি পি ধর বলেন, 'বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন রয়েছে ভারত সরকারের।'

৩০ আগস্ট ডি পি ধর মুজিবনগরে আলোচনা শেষে কলকাতায় ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যাগুলো অবলোকন এবং বাস্তব সমাধানের জন্যই আমাদের এই আলোচনা হয়েছে। তারা বলেছেন, একমাত্র পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আমরা কোনো সমঝোতা বা আলোচনায় বসতে রাজি নয়। বাংলাদেশ যে ধরনের পদক্ষেপই নেয় না কেন ভারতের সমর্থন তাদের প্রতি থাকবে।'

ভারতে এদিন

৩০ আগস্ট বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিবের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে একদিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ, অপরদিকে ইসলামাবাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ, নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী সামরিক শাসকবর্গ। ভারতের জনগণ, সরকার ও পার্লামেন্ট বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতা ও সহানুভূতির হাত প্রসারিত করেছে।'

এ সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, 'ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেক বছর ধরে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, আমরা উভয়ে শান্তির জন্য কাজ করেছি এবং বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারী শিল্পের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের জন্য আমাদের প্রোগ্রামে সাহায্য করেছে। আমাদের জনগণ সোভিয়েত ইউনিয়নকে বন্ধু হিসেবে দেখছে। এজন্যই চুক্তি আমাদের দেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে। পাকিস্তানের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে তারা এই সমস্যাকে একটি ইন্দো-পাকিস্তান সমস্যায় রূপ দিতে চেষ্টা করছে। বিশ্বের বাকি দেশের কাছেও এমনটি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুদ্ধের হুমকি থেকে বেপরোয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমরা কী করে এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে থাকি?'

৩০ আগস্ট কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি পিটার শোর দিল্লির উদ্দেশ্যে কলকাতা ছাড়ার আগে সম্প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বলেন, 'পূর্ব বাংলার মুক্তির জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কী ধরনের আলোচনা করতে পারে তা নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, ব্রিটিশ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চায়।'

পাকিস্তানে এদিন

৩০ আগস্ট পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি প্রতিবাদ লিপি পাঠায়। প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার ও হংকং প্রশাসন সেখানে আশ্রয়প্রার্থী বাঙালি বিদ্রোহীদের প্রতি নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছে এবং বিদ্রোহীদের ব্রিটেনে থাকার অনুমতি দিয়েছে। বিদ্রোহীদের বিবিসি বেতার ও টেলিভিশন ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে। বহু ব্রিটিশ নাগরিক পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কাজ চালানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ ও অস্ত্র ক্রয় করতে বিদ্রোহীদের সাথে হাত মিলিয়েছে।'

৩০ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন কাউন্সিল মুসলীম লীগের খাজা খয়রুদ্দিন ও মওলানা শফিকুল ইসলাম।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৩০ আগস্ট লন্ডনে কূটনীতিবিদ আবুল ফতেহ বলেন, 'একমাত্র ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর কোনো বিষয়েই আমাদের মিল নেই। তারা যে ধরনের আচরণ আমাদের সঙ্গে করেছে এবং নির্মমতা চালাচ্ছে এরপর আর আমাদের একসঙ্গে থাকার প্রশ্নই আসে না। গত ২১ আগস্ট ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম আবুল ফতেহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পদত্যাগ করেছিলেন।'

৩০ আগস্ট অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক সংবাদে বলা হয় 'পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন সামরিক আদালতে বিচারপদ্ধতি সংশোধন করছে। সংশোধিত পদ্ধতি অনুযায়ী সামরিক আইনের ৮৮ ধারায় এখন বলা হয়েছে, আসামির জন্য কৌঁসুলির উপস্থিতি প্রয়োজন হবে না। সাক্ষাৎ গ্রহণের পদ্ধতিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আদালতের জন্য শুধু সাক্ষ্যের স্মারকলিপি প্রয়োজন হবে। আদালত যদি মনে করেন কোনো সাক্ষ্যে বিচার বিলম্ব হবে, তাহলে আদালত সেই সাক্ষ্য বাতিল করে দিতে পারবেন। নতুন আইনে আদালতের শুনানি মুলতবি রাখাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু বিচার ২৪ ঘণ্টার জন্য মুলতবি রাখা যেতে পারে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৩০ আগস্ট কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার চালনা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার আবদুল ওয়াহাব এবং সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জনের মুক্তিযোদ্ধার একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ১৫ জন সৈন্য ও ২৯ রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী ৭টি বড় নৌকা ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

৩০ আগস্ট কুমিল্লার লাকসাম থেকে চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এই যুদ্ধে প্রায় ২০ হানাদার সেনা নিহত হয়।

পাকসেনারা সম্মুখে অগ্রসর হতে না পেরে পিছু হটে এবং আক্রোশে রাস্তার চার দিকের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই যুদ্ধে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়।

৩০ আগস্ট ঝিনাইদহের আবাইপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আবাইপুর আক্রমণের দিকে এগিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল আগে থেকেই আলফাপুর খালের পাড়ে অবস্থান ন্যায়। এসময় মুক্তিবাহিনী তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। প্রায় ১১ ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে ৫০ জনের মতো হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

৩০ আগস্ট খুলনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৪০০ সেনা উকসা-গোবিন্দপুর মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটির উপর হামলা চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় নয় ঘন্টা ব্যাপী যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৮ হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

৩০ আগস্ট নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের সোনাপুর ও গোপালপুরের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর হামলা চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ হন।

৩০ আগস্ট সিলেটের কুমারশৈল চা বাগানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়ে বাঙ্কার তৈরির সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনী পিছু হটলে মুক্তিবাহিনী কুমারশৈল চা বাগান নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

৩০ আগস্ট পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চল মহিষপুরে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর্টিলারি হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর দুটো দল সামনের দিকে এগিয়ে গেলে মুক্তিবাহিনী গ্রামবাসীদের নিয়ে একত্রে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সেনা ও ১৪ রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৩০ আগস্ট বাগেরহাটের শরণখোলার পাকিস্তান বাজারে একটি রাজাকার দলের উপর হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় ৩ রাজাকার নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।

৩০ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল নারায়ণগঞ্জের  আড়াইহাজার থানা আক্রমণ করে। এসময় থানার দারোগা নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনী থানাটি নিজেদের দখলে নেয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, সপ্তম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ৩১ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৩১ আগস্ট ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Overview of Rooppur Nuclear Power Plant Bangladesh

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in December

Project deadline extended by 2 years, but authorities hope to complete grid line work before scheduled commissioning

11h ago