আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেল প্রায় ৩৩ হাজার পরিবার

আজকে বারবার মনে পড়ছে আমার বাবার কথা: প্রধানমন্ত্রী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, ঠিকানাবিহীন থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, ঠিকানাবিহীন থাকবে না।

আজ মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে ৩২ হাজার ৯০৪টি পরিবারের মধ্যে ঘর ও জমির দলিল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় ধাপে ভূমিহীন-গৃহহীনের জন্য জমির মালিকানাসহ এই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এই ধাপে ৬৫ হাজারের বেশি পরিবার পাবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে বারবার মনে পড়ছে আমার বাবার কথা। আমার বাবা সব সময় জেলে জেলে কাটাতেন। আমার মা একদিকে যেমন আমাদের মানুষ করা, সংসার চালানো, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি পর্দার আড়ালে থেকে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। সব সময় আমার বাবার পাশে ছিলেন।

ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আব্বা শুধু একটা কথাই বলতেন, কীভাবে এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। কীভাবে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামকে সুন্দরভাবে সাজাবে। কীভাবে বাংলার মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করবেন। বাংলাদেশের মানুষ রোগে চিকিৎসা পেত না। একবেলা খাবার জোটানো তাদের জন্য কষ্টকর ছিল। শিক্ষার আলো থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন তারা করতো—যেটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে খুব কষ্ট দিতো এবং তাদের ভাগ্য পরিবর্তন ছিল তার জীবনের একটা লক্ষ্য। যে কারণে তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন কিন্তু কখনো নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুই প্রথম এ দেশের মানুষের জমির মালিকানা ১০০ বিঘা নির্ধারিত করে তার অতিরিক্ত জমি খাস করে ভূমিহীন মানুষের মধ্যে বিতরণ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, পঁচাত্তরের পর আর সেভাবে দেশের দুঃখী মানুষের দিকে কেউ তাকায়নি। আর তাকাবে কারা! সংবিধানলঙ্ঘন করে, সেনা আইন-রুলস ভঙ্গ করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা শুরু করেছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। তারা এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে আসেনি, নিজেদের ভাগ্য গড়তে এসেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যার শিকার হলো সেই বিচার বন্ধ করে দিয়ে খুনীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এখানেই থেমে থাকেনি, সেসব খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে তারা পুরস্কৃত করে। সেসব খুনীদের রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। খুনী পাশা, হুদাদের নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক দল গঠন করেন ইত্তেফাকের একজন মালিক মঈনুল হোসেন। এরপরে জিয়াউর রহমান তাদের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি দিয়ে পাঠায়, পোল্যান্ডসহ অনেক দেশ এদের দূতাবাসে গ্রহণ করেনি। কারণ তারা বঙ্গবন্ধুর খুনী। কিন্তু জিয়াউর রহমানের কাছে এরা অত্যন্ত আদরের ছিল। তাই তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্য সে দিয়েছিল। সেনা বাহিনীতেও এর প্রতিবাদ হয়েছে। ১৯টির বেশি ক্যু হয়েছিল ৭৫'র পর। একেকটা ক্যু হওয়ার পর সেনা বাহিনীর বহু অফিসার-সৈনিককে জিয়াউর রহমান হত্যা করে। আর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা তো আছেই।

এই খুনীদের পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসে তখন রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। তারা একটা দল গঠন করে। খুনী ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরও এক ধাপ উপরে যায়। খুনী কর্নেল রশীদ ও মেজর হুদাকে জনগণের ভোট চুরি করে জাতীয় সংসদের সদস্য পদ এনে দেয়। কর্নেল ফারুককেও জিতানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেখানে জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি রাজি হননি। যে কারণে ভোট চুরি করে তাকে আনতে পারেনি। দুজনকে নির্বাচিত করে পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সিটে বসায় খালেদা জিয়া, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতাবিরোধী, আল বদর, রাজাকার সৃষ্টিকারী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়েছে এবং তাদের ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিল। ৭৫'র পর যারা এ দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতো না তারাই ক্ষমতাসীন হয়। যার ফলে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। আর তারা পরিবর্তন ঘটাতেও চায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ কিন্তু এই বাংলাদেশকে আবার সেই পাকিস্তানের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালায় তারা। জিয়াউর রহমান প্রথমে আমাদের সংবিধান বন্ধ করে দিয়েছিল, এরপর যখন তার রাজনীতি করার খায়েস হয়; সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে জামায়াতে ইসলামীসহ এসব দলের রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না; সেটা বিলুপ্ত করে দিয়ে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। ৩৮ অনুচ্ছেদে যুদ্ধাপরাধীদের ভোটের অধিকার ছিল না, যাদের বিচার জাতির পিতা শুরু করেছিলেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে। তাদের মুক্তি দিয়ে বিচারের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি ৭ খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। যত খুনী, যত অপরাধী-যুদ্ধাপরাধী তাদেরকেই সে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। বাংলাদেশ যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল সেই আদর্শ থেকে পথ হারিয়ে ফেলে। একের পর এক যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রত্যেকে জনগণকে শোষণ করেছে, জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, অধিকারবঞ্চিত করেছে এবং নিজেদের ভাগ্যই গড়েছে তারা। যার কারণে এ দেশ আর সামনের দিকে এগুতে পারেনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন। প্রতিটি অঞ্চল যেন উন্নত হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। ভূমিহীনদের পুনর্বাসন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর সহযোগিতায় তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেন। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, সেই অর্জন আর ধরে রাখা হয়নি। যারা পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসেন, তারা যেন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়টাকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আদর্শকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আবার যেন এই দেশ পাকিস্তানিদের পদলেহন করে সেটাই বোধ হয় তাদের লক্ষ্য ছিল।

একুশ বছর পর যখন আমরা সরকারে আসি, তখন থেকে আমাদের প্রচেষ্টা ছিল বাংলাদেশকে আমরা এমনভাবে গড়ে তুলবো—যে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বিশ্ব দরবারে সম্মান পেয়েছিল, বিজয়ী দেশ হিসেবে যেন আমরা সেই সম্মান ফিরে পাই। কারো কাছে হাত পেতে নয়, নিজেদের পায়ে দাঁড়াবো এবং আমরা নিজেদের দেশকে উন্নত করবো। স্বাধীনতার পর পর অনেক বিদেশি সাংবাদিক জাতির পিতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এ দেশে তো কিছুই নেই। আপনি কী দিয়ে দেশকে গড়ে তুলবেন। তিনি একটি কথা বলেছিলেন—আমার মাটি আছে, মানুষ আছে। আমি এই মাটি-মানুষ দিয়েই বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। আমার মনে হয়, বিশ্বের কোনো নেতা এত বড় কথা বলতে পারেননি। এত সাহসিকতা দেখাতে পারেননি। আজকে যদি জাতির পিতাকে আমরা না হারাতাম, অনেক আগেই বাংলাদেশ; ৪০ বছর আগেই এ দেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে মর্যাদা পেত, সে বিশ্বাস আমার আছে কিন্তু সেটা আমাদের ভাগ্যে হয়নি, বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমরা চাই, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ হিসেবে। তিনি সব সময় বলতেন, প্রতিটি মানুষ অন্ন পাবে, আশ্রয় পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। আমিও জাতির পিতার সেই আদর্শ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। আমরা একটি জরিপ করে দেখেছি, ৮ লাখের বেশি ছিন্নমূল মানুষ রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে আমরা ঘর তৈরি করে দেবো। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা যাত্রা শুরু করেছি। আমরা জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক। আমি তো শুধু জাতির পিতার কন্যা না, তার আদর্শে আমি বিশ্বাস করি। আমার কাছে ক্ষমতাটা হচ্ছে, জনগণের সেবা দেওয়া। জনগণের জন্য কাজ করা। আমি আজকে সেটাই করে যাচ্ছি, বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না, ভূমিহীন থাকবে না। সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

তিনি বলেন, আমরা ৯৭ সাল থেকে শুরু করেছিলাম আশ্রয়ণ প্রকল্প। যখন ব্যাপক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। আমরা মানুষ বাঁচাতে পেরেছিলাম কিন্তু অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ঘুমিয়েছিলেন। জানতেনই না যে এ রকম হয়েছে। ৯৭ সালে আমি ঘুমাইনি। আমার স্পেনে যাওয়ার কথা ছিল একটি রাষ্ট্রীয় সফরে, আমি সেটা বাতিল করে দিয়ে সারা রাত জেগেছিলাম, খোঁজ নিয়েছিলাম কোথায় কী ক্ষতি হচ্ছে।

দলের নেতা-কর্মীদের মানুষের জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থ-সম্পদ, টাকা-পয়সা এগুলো কাজে লাগে না। করোনার সময় আপনারা দেখেছেন, হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার মালিক—কিছুই তাদের করার ছিল না। যারা বাংলাদেশে কোনোদিন চিকিৎসা নেয়নি, তাদের কিন্তু এই দেশে ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। কারণ টাকা থাকলেও কোথাও যেতে পারেননি তারা। আগে তো একটু সর্দিকাশি হলেও তারা উড়ে চলে যেতেন বিদেশে চিকিৎসার জন্য। করোনাভাইরাস কিন্তু মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছে ধন-সম্পদ-অর্থ কিছুই না। আর মরলে তো সব কিছু রেখে যেতে হবে। কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারবে না। কাজে সম্পদের পিছে ছুটে নিজেকে মানুষের কাছে অসম্মানিত করার কোনো অর্থই হয় না। বরং একটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলে সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় পাওয়া।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশ যেখানে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সেখানেও একটি ধনী দেশ যা করতে পারেনি, আমরা করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় করেছি। কেউ যদি একটা ভ্যাকসিনের দাম কত সেটা হিসাব ধরে, সেই হিসাব ধরলে কিন্তু হবে না। একটা ভ্যাকসিন দিতে আমাদের যে লোকবল লেগেছে, ভ্যাকসিন নিয়ে এসে ফ্রিজারে রাখতে হয়েছে; সেই ডিপ ফ্রিজ তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ পর্যন্ত সেগুলো আমাদের সংগ্রহ করতে হয়েছে, আমরা যেহেতু গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দিচ্ছি সেখানে এয়ার কন্ডিশনার ঘর তৈরি করতে হয়েছে। তাতেও কিন্তু একটা খরচ আছে। স্বাস্থ্যকর্মী যারা ঘরে ঘরে গিয়ে টেস্ট করছে, তাদের থাকা-খাওয়া-ভাতা, পিপিই দিতে হয়েছে তার পেছনেও কিন্তু খরচ আছে। ইনজেকশন দিতে গেলে যে সিরিঞ্জ কিনতে হয় তার পেছনেও খরচ আছে। এই সমস্ত খরচটা যদি এক করে দেখেন তাহলে হয়তো সঠিক তথ্য পাবেন কত হাজার কোটি টাকা এর পেছনে খরচ হয়েছে। আমরা কিন্তু সব বিনা পয়সায় করে দিয়েছি এ দেশের মানুষের জন্য, বলেন শেখ হাসিনা।

Comments

The Daily Star  | English

Schools, Colleges: A reopening that defies heatwave and logic too

The reopening of educational institutions amid the heatwave was marred by two teachers’ deaths and dozens of students becoming sick.

6h ago