বানর রাজ্যে খাদ্য সংকট

ব্রিটিশ আমলে ঢাকার যেসব এলাকাকে আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয় গেণ্ডারিয়া তার মধ্যে অন্যতম। এলাকাবাসী আদর করে যাকে ডাকতো ‘গ্র্যান্ড এরিয়া’ বলে। এই এলাকা দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয়ের জন্যও খ্যাতি অর্জন করে। ভেষজ ওষুধের পাশাপাশি সাধনা ঔষধালয় আরও পরিচিতি লাভ করে এখানকার বানরের জন্য।
সাধনা ঔষধালয় বানরগুলোর জন্য প্রতিদিন ১০ কেজি ছোলা বুট দেয়। ছবি: ফিরোজ আহমেদ

ব্রিটিশ আমলে ঢাকার যেসব এলাকাকে আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হয় গেণ্ডারিয়া তার মধ্যে অন্যতম। এলাকাবাসী আদর করে যাকে ডাকতো 'গ্র্যান্ড এরিয়া' বলে। এই এলাকা দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয়ের জন্যও খ্যাতি অর্জন করে। ভেষজ ওষুধের পাশাপাশি সাধনা ঔষধালয় আরও পরিচিতি লাভ করে এখানকার বানরের জন্য।

উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে গেণ্ডারিয়া এলাকায় শুরু হয় বানরের আনাগোনা। ১৯১৪ সালে সাধনা ঔষধালয় চালু হওয়ার পর এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ বানরের জন্য ছেড়ে দেন তার প্রতিষ্ঠানের গোটা একটি কক্ষও। সেই সঙ্গে নিয়মিত খাবারও দিতেন তিনি। শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে সাধনা ঔষধালয়।

তবে এখন আর আগের সেই জৌলুস নেই সাধনা ঔষধালয়ের। সেই সঙ্গে সেখানকার বানরের অবস্থাও আগের মতো ভালো নেই। চাহিদা অনুযায়ী খাবারের অভাবে অনেক বানরই এলাকা ছাড়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সাধনার গণ্ডি পেরিয়ে বানররা প্রায়শই হামলা চালাচ্ছে আশপাশের ঘরবাড়িতে। হাজারের উপরে থাকা বানরের সংখ্যাও এখন কমে হয়েছে ১০০ বা ১৫০।

অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে গেণ্ডারিয়ায় বসবাস করেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দে। তিনি বলেন, 'এক সময় এখানে বানরের অবাধ বিচরণ ছিল। হাজারের উপরে বানর এখানে থাকতো। সাধনার ওষুধ বানাতে গুড় লাগতো, সেই গুড়ের ঘ্রাণে তারা ছুটে আসতো। কিন্তু এখন সাধনার অবস্থা ভালো না। তেমনি এখানকার বানরের অবস্থাও ভালো না। ওরা ঠিক মতো খাবার পাচ্ছে না। ফলে যতদিন যাচ্ছে বানরের সংখ্যাও কমছে।'

এশিয়াটিক সোসাইটির 'এনসাইক্লোপিডিয়া অব ঢাকা' বই থেকে জানা যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র যোগেশচন্দ্র ঘোষ কলকাতা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৯১৪ সালে গেণ্ডারিয়ায় সাধনা ঔষধালয়ের ছোট কারখানা গড়ে তোলেন। ১৯১৭ সালের মধ্যে এটি একটি আধুনিক ওষুধ কারখানায় পরিণত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান, আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রেও সাধনা ঔষধালয়ের শাখা ও এজেন্সি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ নিহত হন। একই সঙ্গে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধনা ঔষধালয়। এরপর থেকেই সাধনা ঔষধালয়ের জৌলুস কমতে থাকে।

এর প্রভাব পরে এখানকার বানরের ওপরও। তবে যোগেশচন্দ্র ঘোষের উত্তরাধিকারীরা বানরের জন্য নিয়মিত খাবার দিয়ে আসছেন। সাধনার কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন ১০ কেজি ছোলা বুট দেওয়া হয় বানরের খাবারের জন্য। তবে এখানে এবং এর আশপাশের এলাকার বানরের জন্য এই খাবার অপ্রতুল।

সাধনা ঔষধালয়ে নিরাপত্তকর্মী হিসেবে ২ দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ভবতোশ দে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ৫ কেজি করে মোট ১০ কেজি ছোলা দেওয়া হয়। এখানে আগের চেয়ে বানর কমেছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে মারামারি করেও তারা আশপাশের অন্যান্য এলাকায় চলে গেছে।'

সাধনা ঔষধালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, 'আগে বিকেলে অনেক মানুষ বানরদের খাবার দিতে আসতো। বিকেলের দিকে চিড়িয়াখানার মতো অবস্থা হয়ে যেতো। তবে করোনার কারণে মানুষের খাবার দেওয়াটা কমে এসেছে।'

ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এখানকার বানরদের খাবার দেওয়া হয়। বিশেষ করে বিকেলের দিকে এলাকাবাসী, বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা বানরদের খাবার দেয়। তবে করোনাকালে মানুষের আর্থিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের খাবার দেওয়ার প্রবণতা আগের থেকে কমে এসেছে।

পুরাণ ঢাকার বিলুপ্তপ্রায় বানর রক্ষা, নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র নিশ্চিত ও সিটি করপোরেশন কর্তৃক খাবার সরবরাহের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে ঢাকা ইয়ুথ ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সোহাগ মহাজন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এখানকার বানরগুলোকে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে আসছি এবং সেটি সাধনা ঔষধালয়ের এখানেই। শুধুমাত্র বানরদেরকে পর্যাপ্ত খাবার দিলেই সেটা সম্ভব। ওরা ঠিকমতো খাবার পেলে এই এলাকার বাইরে যাবে না।'

তিনি বলেন, 'এক সময় সরকার এখানকার বানর চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরের চিন্তা করেছিল। কিন্তু সেটি সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ, এখানকার বানর মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। ওদের খাঁচার ভেতরে আটকে রাখলে বাঁচবে না।'

গত মে মাসে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে গেণ্ডারিয়া এলাকার বানরদের কলা, পাউরুটি, গাজর, শসা দেওয়া হয়। ২ সপ্তাহ ধরে চলে এই কর্মসূচী।

এ বিষয়ে জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনার সময় গেণ্ডারিয়া এলাকার বানরের দুর্দশার খবর পেয়ে আমরা উদ্যোগী হয়ে খাবার বিতরণ করেছি। আমরা সে সময় দেখেছি খাবারের জন্য বানরের কী আকুতি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বানর খাবার বিতরণের সময় এক হয়ে ছুটে এসেছিল। বোঝা যায়, তারা ক্ষুধার্ত ছিল। এ সময় এলাকাবাসীও আমাদের সাহায্য করেছেন। সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আমাদের কর্মসূচী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানরকে খাবার দিয়েছে।'

খাবার সংকটের কারণে সাধনার বানরের দল আশপাশের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গিয়ে হামলা চালানোর মতো ঘটনাও ঘটছে। অনেক এলাকাবাসী খাবার দিলেও, অনেকেই বানরের ওপরে গরম পানি ছুঁড়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। এর বাইরে বানরকে বিভিন্ন ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করার ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়া এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বানর মারা যায়।

কালের বিবর্তনে পুরাণ ঢাকায় বানরের বিলুপ্তির কারণ জানতে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বন্য প্রাণী গবেষক অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'পুরাণ ঢাকায় যেসব বানর রয়েছে সেগুলো মূলত রেসাস ম্যাকাক প্রজাতির। এই বানরগুলো গবেষণার কাজেও ব্যবহার করা হয়। আগের চেয়ে এখন বানরের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মূলত খাবারের সংকটের কারণেই বানরের সংখ্যা কমে আসছে। এর বাইরে মানুষ শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। যার কারণে তারা বানরকে আক্রমণ করছে। এ ছাড়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বানর মারা যাচ্ছে। এগুলো বানরের সংখ্যা কমে আসার অন্যতম কারণ।'

এর থেকে পরিত্রাণের উপায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, 'বানরের খাবারের সংকট মেটাতে হবে। সেটা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগেই করতে হবে। সেই সঙ্গে মানুষকেও সচেতন করতে হবে যেন, তারা বানরকে আক্রমণ না করে।'

পুরাণ ঢাকার গেণ্ডারিয়া ছাড়াও লক্ষ্মীবাজার, রায় সাহেব বাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, বনগ্রাম, তাঁতিবাজার ও সূত্রাপুরে বানরের দেখা মেলে।

Comments

The Daily Star  | English

How to get your 2024 SSC results today

The candidates can get their results online or through SMS after 11:00am

2h ago