পুঁজির অভাবে পেশা ছাড়ছেন লালমনিরহাটের তাঁতিরা

পোশাক কারখানায় মেশিনে তৈরি কাপড়ের রমরমায় তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা কমে এসেছে। সুতার দাম বাড়তি। এর ওপর পুঁজির ঘাটতির কারণে লালমনিরহাটের অনেক তাঁতি তাদের পৈতৃক পেশাটি আর ধরে রাখতে পারছেন না।
পুঁজির অভাবে অলস পড়ে আছে তাঁত। ছবিটি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের মহিষামুড়ি গ্রাম থেকে সম্প্রতি তোলা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

পোশাক কারখানায় মেশিনে তৈরি কাপড়ের রমরমায় তাঁতে বোনা কাপড়ের চাহিদা কমে এসেছে। সুতার দাম বাড়তি। এর ওপর পুঁজির ঘাটতির কারণে লালমনিরহাটের অনেক তাঁতি তাদের পৈতৃক পেশাটি আর ধরে রাখতে পারছেন না।

এই পরিস্থিতিতে পুরোনা পেশা ছেড়ে কেউ কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন, কেউ বেছে নিয়েছেন রিকশা চালানো কিংবা ফেরিওয়ালার পেশা। আবার কারুর দিন কাটছে দিনমজুরি করে।

আব্দুস সাত্তার (৫৮) মূলত একজন তাঁতি। তার বাবা মৃত আমীর চাঁদও তাঁতের কাজ করতেন। তবে অভাবের কারণে সম্প্রতি নিজের তাঁতটি বিক্রি করে এখন দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

তাঁত ছাড়লেও এই পেশা পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার বাসনা নেই আব্দুস সাত্তারের। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পুঁজির সংস্থান করতে পারলে আবার তাঁতের কাজ শুরু করার আকাঙ্খা রয়েছে তার।

চরকি ঘোরাচ্ছেন মহিষামুড়ি গ্রামের এক নারী। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

একই গ্রামের আরেক তাঁতি আলিম উদ্দিনের (৫৬) দিন চলছে রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করে। তবে সাত্তারের মতো তিনি তার তাঁতটি এখনো বিক্রি করে দেননি। তাঁর আকাঙ্খাও এক রকম। পুঁজির যোগাড় হলে কোনো একদিন তিনি তার পৈতৃক পেশায় ফিরে যাবেন।

আলিম উদ্দিন তাঁতের কাজ শিখেছিলেন তার মৃত পিতা হারান আলীর কাছ থেকে। তাঁতের কাজ করেই স্বচ্ছলতা এসেছিল তাদের সংসারে। এখন দুর্দিনে স্ত্রী, ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে তাকে।

লালমনিরহাট তাঁতি সমিতির সভাপতি ফজল আলী জানান, ১০ বছর আগেও লালমনিরহাট জেলায় প্রায় দেড় হাজার তাঁত ছিলো। এখন সাকুল্যে আছে আড়াই'শ থেকে তিশ'শটির মতো। যার বেশিরভাগ রয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের মহিষামুড়ি গ্রামে। তবে এর সবগুলো আবার সচল নয়।

ফজল আলী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় আমাদের কাকিনার তাঁতের চাদর বিখ্যাত ছিলো। কিন্তু এখন সেই বাজার আর নেই। এর ওপর সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা খুব বেশি লাভবানও হতে পারছি না।'

মহিষামুড়ি গ্রোমের তাঁতি হাফিজুর রহমান (৪৪) জানান, গত বছর পর্যন্তও তিনি তার তাঁতটি চালু রেখেছিলেন। কিন্তু এ বছর আর পারেননি।

মহিষামুড়ি গ্রামের এই তাঁতির তাঁতটিও অলস পড়ে আছে। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

হাফিজুরের ভাষ্য, কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ মণ সুতা মজুত রেখে তবেই তাঁত চালু করতে হয়। এই পরিমাণ সুতা কিনে মজুত করার সামর্থ্য তার নেই। তাই তার তাঁতটি এখন ঘরে তুলে রেখেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা তাঁতে শার্ট-প্যান্টের কাপড়, গায়ের চাদর, বিছানার চাদর, গামছা, লুঙ্গি, তোয়ালে ও শাড়িসহ বিভিন্ন লেডিস আইটেম তৈরি করি। তাই যথেষ্ট পুঁজির দরকার হয়।'

মহিষামুড়ি গ্রামের আরও কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুঁজির জোগাড়ে তারা অনেক সময় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেছেন। কিন্তু এতে লাভের মুখ দেখতে পারেননি তারা।

সোহরাব আলী (৫৮) নামের এমন একজন তাঁতির ভাষ্য, সুদমুক্ত অথবা স্বল্পসুদে ঋণ পেলে তারা তাঁত টিকিয়ে রাখতে পারতেন। তিনি বলেন, '৮-১০ বছর আগেও তাঁতের চাদর প্রচুর বিক্রি হতো। এখন গার্মেন্টেসের কম্বল আসায় চাদরের চাহিদা কমে গেছে।'

একই গ্রামের রমিজ উদ্দিন (৫৬) নামের আরেক তাঁতি জানান, চালাতে না পেরে তিনি তার তাঁতটি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার বক্তব্য, নিজস্ব পুঁজি দিয়ে তাঁত চালাতে পারলে দিনে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। কিন্তু মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেটি সম্ভব হয় না।

পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করে এই তাঁতি বলেন, 'তাঁত বসিয়ে রাখলে খুব কষ্ট লাগে। একসময় বাড়িতে দিন-রাত তাঁত চলতো। তাঁতের খটখট শব্দে আমাদের প্রাণ জুড়াতো। কিন্তু সেই তাঁত এখন অলস পড়ে আছে।'

তাঁত চালানোর জন্য মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন এই তাঁতি। কিন্তু লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

কাকিনার ফরিদা বেগম নিজে (৫৫) তাঁতি পরিবারের মেয়ে। তার বিয়েও হয়েছিল আরেক তাঁতি পরিবারে। এখন তাঁত ছেড়ে তার স্বামী আলিম উদ্দিন দিনমজুরি করছেন।

ফরিদা বেগম বলেন, 'জন্ম থেকেই আমার তাঁতের সঙ্গে সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক এখন ছুটতে বসেছে।'

স্খানীয় তাঁতি ও তাঁতে তৈরি কাপড়ের ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া জানান, একসময় কাকিনার তাঁতের কাপড়ের ব্যবসাও ছিলো জমজমাট। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা আসতেন। সরকারিভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে কাকিনার তাঁতের চাদর কেনা হতো শীতার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য। গত কয়েক বছর ধরে তা হচ্ছে না।

বাবুল মিয়া মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান পেলে তাঁতিরা আবার তাদের তাঁত চালু করতে পারবেন। না হলে আগামী ৩-৪ বছরের মধ্যে লালমনিরাটের তাঁতশিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।

Comments