দুস্থ চা শ্রমিকদের অনুদানে ভাগ বসালেন ‘ধনী বাবুরা’

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানের প্রধান টিলা ক্লার্ক নিয়ামুল হোসেন চকদার। বাগান কর্তৃপক্ষের দক্ষ ও পুরাতন কর্মী তিনি। শত শত চা শ্রমিক তার নির্দেশে কাজ করেন। চা বাগানে যেকোনো সিদ্ধান্তে তার মতামত প্রয়োজন হয়।
মৌলভীবাজারের বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিক। ছবি: স্টার

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানের প্রধান টিলা ক্লার্ক নিয়ামুল হোসেন চকদার। বাগান কর্তৃপক্ষের দক্ষ ও পুরাতন কর্মী তিনি। শত শত চা শ্রমিক তার নির্দেশে কাজ করেন। চা বাগানে যেকোনো সিদ্ধান্তে তার মতামত প্রয়োজন হয়।

একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত নিয়ামুল হোসেন চকদারের বাড়ি রাজশাহীর রাজপাড়া থানার লক্ষ্মীপুর এলাকায়। সেখানে তার দোকান আছে। মাসিক আয় বেশ।

চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পে কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নে সর্বোচ্চ দুঃস্থ চা শ্রমিকদের সঙ্গে আছে নিয়ামুল হোসেন চকদারের নাম। সরকারি তালিকায় তার ক্রমিক নম্বর ২৭৯। তিনি উপজেলা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা নগদ সহায়তা পান।

টাকা প্রাপ্তির যৌক্তিকতা দাবি করে নিয়ামুল হোসেন চকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কি এ দেশের নাগরিক নই। শ্রমিকরা পাবে, আমরাও পাব। তাতে সমস্যা কী?'

শুধু তিনিই নন, তালিকায় চা বাগানের অনেক সচ্ছল কর্মীর নামও আছে। ২৮০ নম্বরে আছেন গোদাম বাবু সিরাজুল ইসলাম, ২৮১ নম্বরে টিলা ক্লার্ক বাবুরাম কৈরী, ২৮২ নম্বরে আছেন সুনছড়া চা বাগানের টিলা ক্লার্ক গোপাল চক্রবর্তী। এ ছাড়াও, চা বাগানের কম্পিউটার, অফিস ও ফ্যাক্টরি বিভাগের কর্মীদেরও নাম আছে।

নীতিমালা অনুযায়ী চা বাগানের দুঃস্থ ও সর্বোচ্চ দুঃস্থ ব্যক্তিদের এই সুবিধা পাওয়ার কথা। তালিকায় চা বাগানের সচ্ছল কর্মীদের নাম দেখে শ্রমিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। চা শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তার তালিকা যৌথভাবে করা হলেও এ বিষয়ে একে অন্যের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট বিভাগীয় সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চা বাগানের দুঃস্থ ও সর্বোচ্চ দুঃস্থ ব্যক্তিদের এ সুবিধা পাওয়ার কথা। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পে কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নে শ্রমিকদের পাশাপাশি চা বাগানের সচ্ছল কর্মীরাও সহায়তার চেক পেয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছে চা বাগানের অনেক দুঃস্থ পরিবার।'

উপজেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা গেছে, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম প্রকল্পের আওতায় সরকার চা শ্রমিকদের মধ্যে বছরে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ করে। অবহেলিত ও অনগ্রসর শ্রমিকদের পারিবারিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় 'চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম' গ্রহণ করেছে।

গত ৭ নভেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগান ও এর ফাঁড়ি সুনছড়া, কামারছড়া চা বাগানের ১ হাজার ৩৫৬ জন শ্রমিকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ৫ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ করা হয়।

আলীনগর চা বাগানের শ্রমিক সুবাশ কৈরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার পরিবারের ৩ সদস্য বাগানে কাজ করে। সবাই অসচ্ছল। অথচ একজনও এই টাকা পেল না। অথচ বাবুরা কেমনে টাকা পেল?'

একই বাগানের শিউধনী রবিদাস, সুমন বাউরী, বিমলা নায়েক, উত্তম বৈদ্য, লাকিয়া রবিদাস, অজিত কৈরী, সরস্বতী কৈরী ও পিন্টু সিনহাসহ আরও কয়েকজন শ্রমিক জানান, তাদের পরিবার খুবই অসচ্ছল। তালিকায় তাদের নাম নেই। অথচ বাগানের কর্মী থেকে শুরু করে প্রধান টিলা ক্লার্কও টাকা পাচ্ছেন।

আলীনগর চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সাধারণ সম্পাদক চন্দন বাক্তী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই তালিকা নিয়ে আমরাও সমস্যায় আছি। আইনের বিষয়টি আমরা জানতাম না।'

আলীনগর চা বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক এ জে এম রফিউল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও পঞ্চায়েত মিলে এই তালিকা তৈরি করেছে। তারা বলেছেন, তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরা সহায়তা পেতে পারেন।'

এ বিষয়ে আলীনগর ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফজলুল হক বাদশাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত তালিকা তৈরির কাজ আমার না। বাগান পঞ্চায়েত নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে অনেকেই সম্পৃক্ত আছেন। তাছাড়া, যারা তালিকা তৈরি করেছেন তাদের মতে এরা সবাই চা বাগানের বাসিন্দা এবং এই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য।'

অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুয়েব আহমদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগান পঞ্চায়েত, ম্যানেজার ও জনপ্রতিনিধিরা মিলেই তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী তাদেরকে চেক দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সচ্ছলদের নাম বাদ দেওয়া হবে।'

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশেকুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন আলীনগর ইউনিটের সভাপতি গণেশ পাত্র ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছর কয়েকজন বাবুকে এই অনুদান দেওয়া হয়। এ বছর অনুদানের তালিকায় প্রায় ২৭ জন বাবুর নাম এসেছে।'

'সরকারি অনুদান বণ্টনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। কারণ বাবুরাও বাগানে থাকেন, জনপ্রতিনিধিরাও বাগানে থাকেন। আমরা চা শ্রমিকরাও বাগানে থাকি। সুনির্দিষ্ট আইন থাকলে এ সমস্যা হতো না', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Desire for mobile data trumps all else

As one strolls along Green Road or ventures into the depths of Karwan Bazar, he or she may come across a raucous circle formed by labourers, rickshaw-pullers, and street vendors.

14h ago