‘মালিকরা শ্রম আইনের তোয়াক্কা করে না’

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারখানার আগুন লেগে দেশে সর্বোচ্চ ১২২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল তাজরীন ফ্যাশনসে ২০১২ সালে। এ ধরনের প্রায় সব ঘটনার সময় ভবনের গেট তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগের কথা জানা যায়।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে ৫১ জন নিহত হয়েছেন। ছবি: আনিসুর রহমান/ স্টার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কারখানার আগুন লেগে দেশে সর্বোচ্চ ১২২ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিল তাজরীন ফ্যাশনসে ২০১২ সালে। এ ধরনের প্রায় সব ঘটনার সময় ভবনের গেট তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগের কথা জানা যায়।

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৬২ (৩ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে কর্মকালীন অবস্থায় কোন কক্ষ হইতে বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকাইয়া রাখা যাইবে না এবং বহির্গমনের পথ বাধাগ্রস্থ কিংবা পথে কোন প্রতিবন্ধকতাও তৈরী করা যাইবে না।’

বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়।

(বাম দিক থেকে) শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও কামরূল আহসান। ছবি: সংগৃহীত

কারখানার গেট কেন বন্ধ করে রাখা হয় এবং একজন শ্রমিকের মৃত্যুতে কত টাকা ক্ষতিপূরণ হওয়া উচিত তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কামরূল আহসানের সঙ্গে।

জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কামরূল আহসান বলেন, ‘মালিকরা শ্রম আইনের তোয়াক্কা করে না। শ্রমিকদের দাস মনে করে। তাদের মানসিকতা প্রভুসূলভ। তারা মনে করে কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখলে তারা শ্রমিকদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এভাবে শ্রম আইন লঙ্ঘন করেন তারা।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের মারা যাওয়ার বিষয়টি সামাজিকভাবে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করে না। এই কারণে এসব ঘটনার কোনো প্রতিকার হয় না।’

কামরূল আহসান বলেন, ‘একজন শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর যে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয় তা সামাজিক সুরক্ষা জালের আওতায় পড়ে। এটি কোনো ক্ষতিপূরণ না। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা গেলে সে যত দিন বেঁচে থেকে আয় করতে পারত সেই পরিমাণ টাকা তার পরিবারকে প্রদান করতে হবে। আমাদের দেশে সরকারি কার্মচারীদের অবসরের যে বয়সসীমা, সেই বয়স পর্যন্ত একজন শ্রমিক যত টাকা আয় করত কমপক্ষে সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের দেশে কলকারখানার যে আইনগুলো আছে তা অধিকাংশই দুর্বল। আইন যে মেনে চলা দরকার বেশিরভাগ কারখানার মালিক তা মনেই করে না। কারখানা তৈরির নিময়কানুন না মানার কারণে বহু দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশে বর্তমানে অনেক কারখানা দুর্ঘটনার হুমকির মুখে আছে। সরকারের নির্দেশনা এবং প্রতিশ্রুতির সঙ্গে কারখানা পর্যায়ে সেগুলোর প্রতিপালনের কোনো সঙ্গতি নেই।’

‘মালিকরা কারখানার দরজা বন্ধ করে শ্রমিকদের একটি জেলখানায় ভরছে। তারা এটিকে জেলখানা বানিয়ে রাখে যাতে শ্রমিকরা যতক্ষণ ভিতরে থাকবে ততক্ষণই যেন কাজ করে। শ্রমিকের কাছ থেকে সাধ্য ও চুক্তির অতিরিক্ত কাজ আদায় করার জন্য গেট বন্ধ রাখা হয়। কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখার কারণে নারায়ণগঞ্জে মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছে,’ তিনি বলেন।

জাবির এই অধ্যাপক বলেন, ‘সরকার আগের ঘটনাগুলো থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি এবং মালিকরাও তাদের ভূমিকা পরিবর্তন করেনি। খুব দ্রুত মুনাফা করার জন্য কারখানার জন্য সামান্য খরচও তারা করতে চায় না। অতি মুনাফার লোভ এবং সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক দৈন্যদশার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে।’

ক্ষতিপূরণ বিষয়ে আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘জীবনের আসলে কোনো মূল্য দিয়েই ক্ষতিপূরণ হয় না। আমাদের শ্রম আইনে ক্ষতি পূরণের যে কথা উল্লেখ আছে সেটির আসলে কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ও বাড়ে। সরকারের অবসর গ্রহণের সময়সীমা পর্যন্ত একজন শ্রমিক কত টাকা আয় করতে পারত সেই হিসাব করতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে একজন শ্রমিক তার পুরো জীবনে যে আয় করত মালিকের কাছ থেকে তার দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা আদায় করে দেওয়া।’

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ‘একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য কোনোভাবে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা তো আর শ্রম আইনের বাইরে যেতে পারি না। তাই এই আইন অনুযায়ী কোনো দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক আহত বা নিহত হলে যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা রয়েছে আমরা তাই দিয়ে থাকি।’

দেশে শ্রম আইন কতটা মানা হয় এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘অনেকেই মানে, অনেকেই আবার গায়ের জোরে মানে না। যারা মানে না আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করি।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুড ফ্যাক্টরি সেই মালিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে গত ৭ জুন তাকে নোটিশ দেওয়া হয়। এর কোনো উত্তর না পাওয়ায় গত ৩০ তারিখে মামলাও দেওয়া হয়েছে। তবে করোনার কারণে কোর্ট ভার্চুয়াল হওয়ায় মামলাটির তেমন অগ্রগতি হয়নি। উনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো দুর্ঘটনাজনিত কারণে যথযাযথভাবে জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা না করা এবং ও শিশু শ্রমিকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা।’

কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই গেট কোনভাবেই আটকানো থাকার কথা না। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। কেউ আটকিয়ে রাখলে জানার পর আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করি। ওই ভবনে কমপক্ষে আরও দুই থেকে তিনটি বহির্গমন গেট থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ছিল মাত্র দুটি।’

‘হাসপাতালে ভর্তি আহতদের কাছ থেকে জানতি পারি তারা যখন বের হওয়ার পথে দৌঁড় দেয় তারা সেখানে ধোঁয়া দেখতে পায়। এর জন্য অনেকে বের হতে পারেনি,’ মন্নুজান সুফিয়ান বলেন।

Comments