প্রতিটি ট্র্যাজেডির পর নতুন করে সামনে আসে কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা
যখনই পরিবহন খাতে জনমানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া মর্মান্তিক কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অযোগ্যতার হতাশাজনক একটি চিত্র উন্মোচিত হয়।
সেটা কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই হোক কিংবা লঞ্চ অথবা ফেরিডুবি বা সড়ক অথবা রেল দুর্ঘটনা, এগুলোর প্রতিটিই যখন জনসাধারণের আলোচনার বিষয়স্তু হয়ে ওঠে তখনই কেবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দৃশ্যপটে হাজির হয়। এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠনেও তারা সময় নেয় না।
প্রকৃতপক্ষে ওই কমিটি কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা তুলে আনে এবং কিছু সুপারিশ করে। কিন্তু আরেকটি বড় ঘটনা আবার না ঘটা পর্যন্ত সেগুলো ভুলে যাওয়ার জন্য তোলা থাকে।
মজার বিষয় হচ্ছে, বেশির ভাগ দুর্ঘটনার পর দায়ী চালক কিংবা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থারগুলোর নিম্ন স্তরের কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
যদিও দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থতার জন্য শীর্ষ স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের কখনো দায়ী করা হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, যা এই খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনাকেই তুলে ধরে।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর যে সেটআপ, তা ঠিকঠাক কাজ করছে না। কেবল কাগজে-কলমে আছে।'
পরিস্থিতির পরিবর্তন চাইলে কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'প্রতিবারই একেকটি বড় দুর্ঘটনার পর আমরা জানতে পারি যে, প্রক্রিয়াটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছিল। এটি মূলত জবাবদিহি না থাকার কারণে ঘটে।
আবারও ব্যর্থতার উন্মোচন
শুক্রবার ভোররাতে একটি লঞ্চে আগুন লেগে কমপক্ষে ৪১ জন নিহত ও ১০০ জনের বেশি আহত হওয়ার পর নিয়ম লঙ্ঘন আর তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
এমভি অভিযান-১০ নামে ওই লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে সুগন্ধা নদীতে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। পরে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, নিয়ম লঙ্ঘন করে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে লঞ্চটির মালিক এর দুটি ইঞ্জিন পরিবর্তন করেছিলেন।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটিও ইঞ্জিনে ত্রুটি খুঁজে পায়। তদন্ত অনুসারে, লঞ্চ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত ইঞ্জিনের চেয়ে বড় ইঞ্জিন বসানোর জন্য ইঞ্জিন রুমও পরিবর্তন করে। ঘটনার সময় যে মাস্টার ও চালক লঞ্চটি পরিচালনা করছিলেন তাদেরও ওই লঞ্চ পরিচালনার কোনো অনুমোদন ছিল না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটি সরকারি সংস্থা—নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করার কথা। কিন্তু উভয় সংস্থাই এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। গত বছরের ২৯ জুন বুড়িগঙ্গা নদীতে ময়ূর-২ নামে একটি বড় লঞ্চ মর্নিং বার্ড নামে একটি যাত্রীবাহী ছোট লঞ্চকে ধাক্কা দেয়। এতে মর্নিং বার্ড ডুবে গেলে ৩৪ জনের প্রাণহানি হয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, বড় লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন একজন শিক্ষানবীশ চালক।
বিআইডব্লিউটিএর একটি তদন্ত দল এই দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর-২ লঞ্চের ২ মাস্টার ও ২ চালককে দায়ী করে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা রোধে লঞ্চে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন এবং লঞ্চ মাস্টার ও চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণসহ ১৬ দফা সুপারিশ করে।
কিন্তু এমভি অভিযানে আগুন লাগার পর জানা যায়, এর কর্মীরা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করতে জানতেন না।
কার্যত লঞ্চটির ক্রুরা আগুন লাগার পর লঞ্চটি তীরে নোঙর না করে পালিয়ে যায়। ফলে লঞ্চটি জ্বলন্ত অবস্থায় আধা ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপর তীরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত নদীতে ভাসতে থাকে। এর ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত ২৭ অক্টোবর মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় বেশ কয়েকটি যানবাহনসহ একটি ফেরি ১ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে অর্ধনিমজ্জিত ছিল।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দেখা যায়, শাহ আমানত নামে ওই ফেরিটির কোনো হালনাগাদ ফিটনেস ছাড়পত্র ছিল না। এর আয়ুস্কালও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এ ছাড়া, সে সময় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) পরিচালিত ৫৩টি ফেরির মধ্যে ৫০টিরই ফিটনেস ছাড়পত্র হালনাগাদ ছিল না। দেখা যায়, ওই ফেরিগুলোর বেশিরভাগের আয়ুস্কালও শেষ।
সড়ক পরিবহন খাতেও এ ধরনের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও নজরদারির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের শৈথিল্যের প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে। যার ফলে সড়কে প্রায়ই প্রাণহানি ঘটছে।
নভেম্বরের শেষ দিকে ১ সপ্তাহের ব্যবধানে ২ কলেজছাত্রের মৃত্যু দেশে সড়ক নিরাপত্তার জন্য আরেকটি বড় আন্দোলনের সূত্রপাত করে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অনাবিল পরিবহনের যে বাসটি ২৯ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরায় এসএসসি পরীক্ষার্থী মাঈনউদ্দীনকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে, সেটার কোনো রুট পারমিট ও ট্যাক্স টোকেন হালনাগাদ করা ছিল না।
এর ৫ দিন আগে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান আরেক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। পরে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাঈমকে চাপা দেওয়া ময়লাবাহী ট্রাকটি চালাচ্ছিলেন।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে বিআরটিএ বলেছিল, সে সময় ৪ লাখ ৭৯ হাজার যানবাহন ফিটনেস ছাড়পত্র ছাড়াই চলছিল। বিআরটিএ সূত্র বলছে, প্রতি বছর ৮ লাখের বেশি যানবাহন ফিটনেস পরীক্ষার জন্য যোগ্য হলেও এর মধ্যে গত অর্থবছরে প্রায় ২ লাখ যানবাহন ফিটনেস টেস্ট দেয়নি।
এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা ম্যানুয়াল পদ্ধতির এই ফিটনেস টেস্টের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কারণ এই বিপুল সংখ্যক যানবাহনের ফিটনেস টেস্টের জন্য মাত্র ১০৯ জন ট্রাফিক পরিদর্শক নিয়োজিত আছেন।
যানবাহনের ফিটনেস সনদ ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান এবং নিবন্ধনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে বিআরটিএ। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে তাদের এটি নিশ্চিত করার কথা।
'কিছুই ঠিকঠাক কাজ করছে না'
অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্য, বিআইডব্লিউটিএ বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে। কারণ সংস্থাটি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ পায়, লঞ্চ মালিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ফি এবং সদরঘাট টার্মিনালে প্রবেশের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ টাকা করে আদায় করে।
'সুতরাং যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি এর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হতে হবে। আসলে যাত্রীরা নিরাপদ ভ্রমণ আশা করতে পারে। আর এই নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সদরঘাট টার্মিনালে অন্তত ৪০ জন পরিদর্শক মোতায়েন করা উচিত', বলেন তিনি।
বাস্তবে সারা দেশেই বিআইডব্লিউটিএর ট্রাফিক পরিদর্শক আছেন ২৫ জন। এর মধ্যে মাত্র ৭ জন সদরঘাটে কর্মরত। আর সূত্র মতে, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরে মোট পরিদর্শক আছেন ১৮ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ১ জন সদরঘাটে কাজ করেন।
বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান গোলাম সাদেকের কাছে তাদের বিদ্যমান ট্রাফিক পরিদর্শকের সংখ্যা যথেষ্ট কি না জানতে চাইলে তিনি এর স্পষ্ট কোনো জবাব দেননি। তিনি বলেন, 'আমরা আরও কিছু ট্রাফিক পরিদর্শক বাড়াবো। তবে লঞ্চ মালিকদেরই যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।'
আরেক প্রশ্নের জবাবে গোলাম সাদেক জানান, বার্ষিক ঘোষণাপত্রে কোনো মাস্টার ও চালকের নাম না থাকলে চালক ও মাস্টার পরিবর্তনের অনুমতি নিতে হবে। তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।'
এ ছাড়া মালিকদের তাদের জলযানের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'তারপরেও এ বিষয়ে আমরা আগামীকাল (আজ) লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করবো।'
অভিযান-১০ এর মালিক হামজালাল শেখ স্বীকার করেছেন যে, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরকে না জানিয়েই তারা লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তন করেছেন। গত শনিবার তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জরিপের সময় বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানোর কথা ছিল তাদের।
নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার মঞ্জুরুল কবিরের ভাষ্য, মালিকরা না জানালে ইঞ্জিনের নকশায় কোনো ধরনের পরিবর্তন সম্পর্কে জানাটা তাদের জন্য কঠিন। অন্যথায় বার্ষিক জরিপের সময় তারা এটা জানতে পারেন।
তিনি বলেন, 'বিষয়গুলো পরিদর্শকদের পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু বিষয়গুলো ঠিকঠাক খুঁজে বের করার কারিগরি জ্ঞান তাদের অনেকেরই নেই।'
এ ছাড়া সারা দেশের প্রায় ১৪ হাজার যাত্রী ও পণ্যবাহী নিবন্ধিত জলযান জরিপ করার জন্য অধিদপ্তরে মাত্র ৬ জন সার্ভেয়ার আছেন। তাদের একেকটি যাত্রীবাহী জলযানের ৫১টি উপাদান পরীক্ষা করতে হয়।
সব জলযান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার বিষয়টি প্রায় অসম্ভব। এ বিষয়ে একজন সার্ভেয়ার বলেন, 'অন্তত যাত্রীবাহী জলযান যথাযথভাবে পরীক্ষার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি।'
অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ
Comments