টিপ নিয়ে হয়রানি ‘সংকীর্ণতা ও পশ্চাৎপদতার’ ফল

বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে নারীদের মধ্যে সাজগোজের অংশ হিসেবে কপালে টিপ পরার চল আছে। আবার শিশুকালে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যে দুটি শব্দের সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত হন, তা হলো চাঁদ ও টিপ। কারণ ছেলেভুলানো ছড়া কিংবা ঘুমপাড়ানি গান হিসেবে ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’– চরণদুটির বহুল ব্যবহারের কথা কমবেশি সবার জানা।

বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে নারীদের মধ্যে সাজগোজের অংশ হিসেবে কপালে টিপ পরার চল আছে। আবার শিশুকালে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যে দুটি শব্দের সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত হন, তা হলো চাঁদ ও টিপ। কারণ ছেলেভুলানো ছড়া কিংবা ঘুমপাড়ানি গান হিসেবে 'আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা'– চরণদুটির বহুল ব্যবহারের কথা কমবেশি সবার জানা।

পাশাপাশি গ্রামীণ, এমনকি শহুরে পরিসরেও ধর্ম-বর্ণ ও শ্রেণি নির্বিশেষে অনেক পরিবারের নবজাতক ও শিশুদের কপালে কাজলের টিপ পরানোর চল দেখা যায়। সেই অর্থে টিপের ব্যবহার এই অঞ্চলের জনসংস্কৃতির অংশও বটে।

সেই টিপ পরা নিয়েই সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় হয়রানির শিকার হন তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। এ নিয়ে গত শনিবার শেরেবাংলা নগর থানায় পুলিশের পোশাক পরা একজনের বিরুদ্ধে 'ইভটিজিং' এবং 'প্রাণনাশের চেষ্টা'র অভিযোগ করেন তিনি।

গণমাধ্যমে এই খবর আসার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। নারীরা ফেসবুকে টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। অনেক পুরুষকেও একইভাবে প্রতিবাদে অংশ নিতে দেখা যায়। এ ছাড়া নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি ও সমাবেশ করেও লতা সমাদ্দারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছেন। হেনস্তাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রোববার সংসদে দাবি জানান সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান এবং নারী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবিরের সঙ্গে।

তারা বলছেন, গত কয়েক দশকে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পশ্চাৎপদতার ফলাফলই হলো এই ঘটনা। যে পশ্চাৎপদতার কারণে এক ধরনের সামাজিক সংকীর্ণতা তৈরি হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী এই সংকীর্ণতা তৈরি করছে। যাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এই রাষ্ট্র।

এদিকে টিপকে সৌন্দর্য বর্ধনের একটি অনুষঙ্গ হিসেবে অভিহিত করে বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান বলেন, 'টিপ আমরা বাংলার মেয়েরা, বাংলাদেশি মেয়েরা জন্ম থেকেই পরে আসছি। এটার মধ্যে রিলিজিয়াস কোনো ইমপ্লিকেশনস নাই।'

তার ভাষ্য, 'টিপের ব্যাপারে আমার চাইতে বেশি সোচ্চার আর কেউ হবে না। পাকিস্তানি আমলে টেলিভিশনে একবার আমাকে বলেছিল, টিপ দেওয়া যাবে না। তখন আমি বলেছিলাম টিপ যদি না দেওয়া যায়, তাহলে আমরা গানও গাইব না। তখন অন্য মেয়েরাও আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল।'

এমন আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পিটিভির রজতয়ন্তীতে আমি পাকিস্তানে গান গাইতে গেলাম। আমি তো টিপ পরে গাইব। তখন দেখলাম প্রোডিউসাররা এটা নিয়ে ফিসফাস করছে। কেউ একজন আমাকে এটা নিয়ে প্রশ্নও করে বসলো। তখন আমি বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। টিপ তো আমি পরবোই।'

বাংলা লোকসংগীতের প্রাণপুরুষ আব্বাস উদ্দিনের মেয়ে ফেরদৌসী রহমানের টিপ বিষয়ক গল্প থামে না। তিনি বলেন, 'একটা সময় যখন আমরা পাকিস্তানে যেতাম, তখন সেখানকার মেয়েরা পাগলের মতো আমাদের কাছে দৌড়ে আসত টিপ দেখার জন্য। আমাদের কাছে টিপ চাইত। আমি যতবার পাকিস্তানে গেছি, সেখানকার পরিচিত মেয়েদের জন্য আমি বাংলাদেশ থেকে টিপ নিয়ে গিয়েছি উপহার হিসেবে।'

তাই লতা সমাদ্দারের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে সেটাকে এক ধরনের সংকীর্ণতা হিসেবে অভিহিত করে ফেরদৌসী রহমান বলেন, 'এই সংকীর্ণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে ভালো কিছু করা সম্ভব হবে না। এগুলো নিয়েই পড়ে থাকতে হবে। একটা ভালো গান হবে না, লেখা হবে না, ভালো কোনো কাজ হবে না।'

এ ব্যাপারে খুশী কবিরের ভাষ্য, 'আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি। সেটা আমরা সবসময় সবাই বলতে থাকি। একই সময়ে দেশে নেতিবাচক অনেক কিছুও সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটা অত্যন্ত রিগ্রেসিভ, ব্যাকওয়ার্ড, কম্যুনাল, কনজারভেটিভ একটা চিন্তা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, আমরা যখন তরুণ ছিলাম তখন এটা উল্টো ছিল। একটা প্রগ্রেসিভ জোয়ার ছিল। সবকিছু প্রগতিশীল ছিল। সমাজ পাল্টানো, দেশকে পাল্টানো, চিন্তা উন্মুক্ত করা, নতুন চিন্তা নিয়ে আসা, যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা এমন নানাকিছু।

'কিন্তু এখন যে পশ্চাৎপদতা চলে এসেছে, সেটা ধর্মের নামেই হোক কিংবা অন্য কিছু, এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আছে।'

খুশী কবির বলেন, 'যারা পুঁজিবাদী বাণিজ্য করছে তারাও এটাকে ধরে নিয়েছে। এক সময় হালাল সাবানের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছিল। আর কিছু না, তারা (ব্যবসায়ীরা) বাজার পেতে চেয়েছিল। তারা দেখেছিল, এখানে ধর্মীয় বিষয়গুলো মানুষ খুব সহজেই গ্রহণ করে।'

এই মানবাধিকারকর্মী বলতে থাকেন, 'এখন দেখা যাচ্ছে হিজাব শ্যাম্পু। আমি একদিন দোকানে গিয়ে হিজাব শ্যাম্পু এক হাতে নিলাম। অন্য হাতে নিলাম সাধারণ খুশকিনাশক শ্যাম্পু। আমি দুটোর উপাদানগুলো পড়লাম। হুবহু এক। সুতরাং হিজাব শ্যাম্পু ও খুশকিনাশক শ্যাম্পুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে একই শ্যাম্পুকে ওরা হিজাব শ্যাম্পু ডাকছে কেন? কারণ, খুশকিনাশক শ্যাম্পুতে ওই আকর্ষণটা আসে না। আর আমি যখন এটাকে গ্রহণ করে নিচ্ছি, মানে সেটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি।'

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'এই যে ধর্মীয় চিন্তাগুলো মানুষের মধ্যে ঢুকছে তা কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে না। ধর্মীয় কিছু রীতি-নীতি, ব্যবহার এগুলোকে কেন্দ্র করে। মানে বাহ্যিক কিছু বিষয়কেই ধর্ম বলা হচ্ছে। ধর্মের মূল ভাব নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না।

'এর পেছনেও একটা বড় কারণ থাকে। যারা প্রভাব খাটাতে চাচ্ছে, ক্ষমতা নিতে যাচ্ছে, তারা একটা বিরাট দলকে তাদের পক্ষে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। সে কারণে তারা (ধর্মীয় গোষ্ঠী) যে বার্তাগুলো দিতে থাকে, যেটা সবার মধ্যে পড়তে থাকে। আমাদের দেশের সরকার-ব্যবসায়ীরা তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে।'

এ পর্যায়ে লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে খুশী কবির বলেন, 'সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হলো, একজন পুলিশ সদস্য শুরুতেই তার নিজের দায়িত্ব পালন না করে অপরাধ করছেন। এর উপর তিনি একজন নারীকে অপমান করেছেন, সংস্কৃতিকে অপমান করেছেন, আমার একাত্তরের চেতনাকে অপমান করেছেন, আমাদের দেশের সংবিধানকে অপমান করেছেন, আমাদের চলাফেরার যে স্বাধীনতাটুকু থাকা উচিত সেটাকে রক্ষা না করে তার  বিরুদ্ধে ভূমিকা নিয়েছেন।'

খুশী কবির প্রশ্ন রাখেন, 'এই সাহসটা সে (পুলিশ সদস্য) পায় কোথায়? সাহসটা পায়, কারণ সরকার ও সমাজ এদের প্রশ্রয় দেয়।'

বিষয়গুলো নিয়ে এখনই সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে  তিনি বলেন, 'আমরা যদি এখন থেকে সচেতন না হই, তাহলে সামনের দিনগুলো আরও খারাপ হবে। কারণ এই ধরনের মন-মানসিকতার মানুষ বেশ সংগঠিত। এই ধরনের মানুষদের যখন প্রশ্রয় দেওয়া হয় বা তাদের সঙ্গে আঁতাত করা হয় কিংবা তাদের ছাড় দিয়ে দেওয়া হয় তখন তারা আরও বেশি পেয়ে বসে। তাদের নিজেদের এজেন্ডাগুলো সামনে নিয়ে আসে।'

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

6h ago