আশানুরূপ ফলনেও হাসি নেই বর্গাচাষিদের মুখে

নিজের ১০ শতাংশ জমির বসতভিটা ছাড়া কোনো আবাদি জমি নেই ৫৫ বছর বয়সী বর্গাচাষি আবদার হোসেনের। গত ২৫ বছর ধরে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার বত্রিশ হাজারি গ্রামের এই কৃষক।
বাজারে ধানের যে দাম তাতে ভাগে যে পরিমাণ ধান পাবেন তা বিক্রি করে খরচ উঠবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান বর্গাচাষিরা। ছবি: স্টার

নিজের ১০ শতাংশ জমির বসতভিটা ছাড়া কোনো আবাদি জমি নেই ৫৫ বছর বয়সী বর্গাচাষি আবদার হোসেনের। গত ২৫ বছর ধরে জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার বত্রিশ হাজারি গ্রামের এই কৃষক।

তার মতো বর্গাচাষিরা এ বছর আমন ধানের ফলন পেয়েছেন আশানুরূপ। তারপরেও তাদের চেহারায় হাসির বদলে দেখা যায় চিন্তার ছাপ। এখন বাজারে ধানের যে দাম তাতে ভাগে যে পরিমাণ ধান পাবেন তা বিক্রি করে খরচ উঠবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে কৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। ২ জেলায় বর্গাচাষি রয়েছেন ৯০ হাজারের বেশি।

আবদার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৬ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করছি কয়েক বছর ধরে। চুক্তি অনুযায়ী, জমিতে ফসল উৎপাদনের সব খরচ আমার। জমির মালিক উৎপাদিত ফসলের ৩ ভাগের ১ ভাগ পেয়ে থাকেন আর ২ ভাগ আমাদের।'

'এ বছর আমনের ফলন ভালো পেয়েছি। কিন্তু তারপরও আমাদের লোকসান। কারণ, এ বছর সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় পানির সেচ দিতে হয়েছে। বিঘা প্রতি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। ধান কাটার সময় জমির মালিক তার একভাগ ধান বুঝে নিয়েছেন।'

বর্গাচাষি রজনী কান্ত বর্মণ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বিঘায় প্রায় ১২ মণ ধান পেয়েছি। সব মিলিয়ে প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। আমার পরিবারের সবাই জমিতে কাজ করি। বাইরের শ্রমিক নিতে না হওয়ায় টিকে আছি। জমির মালিকরা লাভবান হলেও আমরা বর্গাচাষিরা লাভবান হচ্ছি না।'

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার গোড়কমন্ডল এলাকার বর্গাচাষি আজগর আলী (৫৩) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পানি সেচ দিয়ে আমন চাষ করায় খরচ হয়েছে বেশি। আমার বর্গা নেওয়া ৭ বিঘায় মোট ধান হয়েছে ৮৮ মণ। এর মধ্যে আমি পাবো প্রায় ৫৯ মণ।'

বর্তমানে বাজারে ধানের দাম ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা মণ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'যে ধান পেয়েছি সেগুলো বিক্রি করে খরচের টাকাটাও উঠবে কি না সন্দেহ আছে।'

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার গ্রামের বর্গাচাষি নুর ইসলাম (৫৫) বলেন, 'জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদে লাভ নেই। শুধু জমির মালিককে পুষতে হয়। নিজের জমি নেই তাই বাধ্য হয়ে বর্গাচাষ করি। উৎপাদিত ফসলের ৪ ভাগের ১ ভাগ জমির মালিক আর ৩ ভাগ বর্গাচাষিরা পেলে কিছুটা লাভ হতো।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের বিদুচরণ রায় (৬৩) জানান, তার ২৫ বিঘা আবাদি জমির সবই ৪ জনকে কৃষককে বর্গা দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রতি ধানের মৌসুমে ১০০ থেকে ১১০ মণ ধান পান।

বিদুচরণ বলেন, 'বর্গাচাষিরা নিজেরা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করলে তাদের লাভ হয়, শ্রমিক নিয়োগ করলে লোকসান হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'উৎপাদিত ফসলের ৩ ভাগের ২ ভাগ চাষির আর ১ ভাগ জমির মালিকের। এটা আমাদের অঞ্চলে দীর্ঘদিনের নিয়ম।'

এই নিয়মের বিষয়ে কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, 'উৎপাদিত ফসলের ভাগাভাগির বিষয়টি জমির মালিক ও বর্গাচাষিদের মধ্যে ব্যক্তিগত চুক্তি। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই।'

বর্গাচাষিদের জন্য সরকারি সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বর্গাচাষিরা চাষাবাদ করলেও সরকারের প্রণোদন তারা পান না। কারণ, তাদের জমির কাগজ নেই। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি হলে বর্গাচাষিরা প্রণোদনা সহায়তা পেয়ে থাকেন।'

Comments