আতঙ্কে ঘুমাতে পারছেন না জেলেপল্লীর বাসিন্দারা

রংপুরের পীরগঞ্জের নন্দ রানী (৩০) ও তার পরিবার এখনো ১৭ অক্টোবর রাতের ভয়াবহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।
রংপুরের জেলেপল্লীতে দেওয়া আগুন। ছবি: সংগৃহীত

রংপুরের পীরগঞ্জের নন্দ রানী (৩০) ও তার পরিবার এখনো ১৭ অক্টোবর রাতের ভয়াবহ স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।

তিনি বলেন, 'আমার ছেলেরা এখনো অনেক ছোট। এখনো প্রতি রাতে তারা ভয়ে থাকে। তারা আর এই গ্রামে থাকতে চায় না। আমরা জানি, হিন্দু হওয়ায় আমাদের ওপর যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে। দেশের কোথাও আমরা নিরাপদ নই।'

পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক হামলার ৮ দিন পরেও বড় করিমপুর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

এই গ্রামের দুটি মহল্লায় প্রায় ১৮০ হিন্দু পরিবারের বসবাস। জগদীশ চন্দ্র দাশের মা ঊষা রানি (৬০) আগে কখনো এ ধরনের সহিংসতা নিজের চোখে দেখেননি। তিনি সেই রাতে প্রাণে বাঁচতে ধান খেতে দৌড়ে গিয়ে লুকিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, 'সব ধর্মের মানুষ আমাদের গ্রামে মিলেমিশে থাকে। আমরা সবসময় একে অপরের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়েছি। আগে কখনো অশান্তিও হয়নি। কিন্তু ১৭ অক্টোবরের ঘটনা আমাদের সবাইকে নির্বাক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে। এখনো আমি রাতে ঘুমাতে ভয় পাই।'

ননী গোপাল দাস জানান, বেশিরভাগ গ্রামবাসী পাশের আখিরা নদীতে মাছ ধরেন। তিনি বলেন, 'মাছ ধরেই বেশিরভাগ মানুষ তাদের পরিবারের খাদ্য যোগান। কিন্তু এখনো জেলেরা বাড়ি থেকে কাজে যেতে ভয় পাচ্ছেন।'

সুজন চন্দ্র দাসের একটি ছোট দোকান ছিল। সহিংসতার রাতে উত্তেজিত জনতা তার দোকান পুড়িয়ে দেয়।

তিনি জানান, 'দোকানের সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেই একটি ফ্রিজ কিনেছিলাম। সেটাও রক্ষা পায়নি। জানি না কবে আবার দোকানটি চালু করতে পারব। অবস্থা এমন হয়েছে যে অচেনা মানুষ দেখলেই ভয় লাগে।'

এই প্রেক্ষাপটে, সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। নিরাপত্তার জন্য বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তারা  নিয়মিত গ্রামের চারপাশে টহল দিচ্ছেন।

ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক।

গত বৃহস্পতিবার ব্র্যাকের রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তিনি জানান, ওই গ্রামের ৩৬ শিশুর তালিকা করা হয়েছে যারা হামলার পর ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছে।

তিনি বলেন, 'ব্র্যাক একটি মাসব্যাপী প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠতে সহায়তা করা হবে। এছাড়াও নারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের একটি দল ইতোমধ্যে গ্রামে কাজ শুরু করেছে।'

মোট ২৫টি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দল এখন সেখানে কাজ করছে।

এরকম একটি দলের সদস্য নূপুর জাহান জানান, ঘটনাটি গ্রামবাসীদের বিপর্যস্ত করেছে, বিশেষ করে শিশু এবং বয়োবৃদ্ধদের। বাচ্চাদের মুখ চেপে ধরে চুপ করিয়ে রেখেছিলেন অভিভাবকরা, যাতে লুকানো অবস্থায় তাদেরকে কেউ আবিষ্কার করতে না পারে। এই শিশুরা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যায় পড়েছে।

'এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠতে সময় লাগবে', বলেন নূপুর।

পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুরেশ চন্দ্র জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

'এই ঘটনার নেপথ্যের মূল অপরাধী সহ প্রায় ৬৪ জনকে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি গ্রামবাসীদের ভয় না পাওয়ার অনুরোধ করছি।'

উল্লেখ্য, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কথিত কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হামলার মধ্যে গত ১৭ অক্টোবর দুর্বৃত্তরা বড় করিমপুর গ্রামের মাঝিপাড়ায় হামলা করে ২১টি বাড়ি, ২টি দোকান ও ১টি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

10h ago