দুটি ইনহেলার কিনতেই ভাতার ৫০০ টাকা শেষ শামসুল হুদার

হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ায় চায়ের দোকানটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। কারণ মাটির চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে অসুবিধা হতো তার। এ কারণে বহুবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে।
shamsul_old_age1.jpg

সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা দুস্থ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধ মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির একজন সুবিধাভোগী শামসুল হুদা রাজশাহীর পবা উপজেলার নবগঙ্গা এলাকায় একটি ছোট টিনের ঝুপড়িতে বসবাস করেন।

'ঘর' নামে ওই জীর্ণ কাঠামোটির সামনে রাখা একটি মাটির চুলা ও দুটি বাঁশের বেঞ্চ সাজানো দেখে তা একটি দোকানের মতোই দেখায়। এটি যে কারো থাকার জায়গা হতে পারে, তা কোনোভাবেই মনে হয় না।

পরে অবশ্য শামসুল হুদার সঙ্গে কথোপকথনে বিষয়টি স্পষ্ট হলো। তিনি জানালেন, এক সময় এটি একটি দোকানই ছিল। তিনি এখানে চা ও শুকনো খাবার বিক্রি করতেন।

অশীতিপর ওই বৃদ্ধ বললেন, 'আমি এখানেই থাকি। এটাই আমার বাড়ি।'

২০০৫ সাল থেকে শামসুল হুদা সরকারের বয়স্ক ভাতার সুবিধা পেয়ে আসছেন। তখন তার বয়স ছিল ৬৫ বছর।

হুদা জানান, শুরুর দিকে নিজের দোকান থেকে তার কিছু আয় আসতো। পাশাপাশি ছেলেরাও তাকে কিছুটা সহযোগিতা করতো। সব মিলিয়ে কোনোভাবে দিন চলে যেত তার।

কিন্তু এখন আর দিন চলে না এই বৃদ্ধের।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে শামসুল হুদার মাসিক ভাতা ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। এর মধ্যে তার বয়স আরও বেড়েছে। থাকার ঘরটির মতো তার শরীরও জীর্ণ হয়েছে ধীরে ধীরে।

শামসুল হুদা জানান, হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ায় চায়ের দোকানটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। কারণ মাটির চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে অসুবিধা হতো তার। এ কারণে বহুবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। হাঁপানির জন্য প্রতি মাসে দুটি ইনহেলার কিনতেই তার ভাতার পুরো ৫০০ টাকাই ব্যয় হয়ে যায়। যেহেতু ৩ মাসের ভাতা একসঙ্গে দেওয়া হয়, তাই ওষুধের দোকানে বাকিও রাখতে হয় তাকে।

এ ছাড়া ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষার কারণে প্রায়ই তার ছেলেদের বা অন্য কারো সহায়তা নিতে হয় এই বৃদ্ধকে।

শামসুল হুদা বলেন, '৫০০ টাকা দিয়ে এখন কী হয়? এই টাকা হাতে আসার আগেই শেষ হয়ে যায়। আর ইনহেলার তো আমার একমাত্র ওষুধ না।'

বিদ্যমান শারীরিক অবস্থার কারণে স্থানীয় চিকিৎসকরা শামসুল হুদাকে আরও উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আর্থিক অসঙ্গতি সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান জীবনের ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটি।

হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, 'আমি কম খরচে ইনহেলার নিয়ে কোনোভাবে শ্বাসের যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যাচ্ছি। একমাত্র মৃত্যুই আমার সব সমস্যার সমাধান করতে পারে।'

কিছু না পাওয়ার চেয়ে ভাতার অল্প পরিমাণ টাকা পাওয়াও ভালো মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'ভাতা দেওয়ার উদ্দেশ্যকে সফল করতে এর অর্থের পরিমাণ অবশ্যই বাড়ানো উচিত।'

রাজশাহীর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে জেলায় প্রায় ৯৬ হাজার ৬৩৫ জন বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন।

এ ছাড়া ৩৯ হাজার ৩৪৯ জন বিধবা ও নিঃস্ব নারী এবং ৪৫ হাজার ২৪৯ জন আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই ভাতা পান।

এর বাইরে প্রায় ১৮৩ জন হিজড়া ও ৩৯৩ জন বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।

চলতি অর্থবছরে মহামারির মধ্যে 'জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর' বাজেটে প্রথমবারের মতো সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই খাতে বরাদ্দ ১ লাখ ৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা বিতরণে নিয়োজিত আছে সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা।

এর মধ্যে নগদ স্থানান্তর কর্মসূচির (বয়স্ক ভাতা, বিধবা-দুস্থ ও অসহায় নারীদের জন্য ভাতা এবং আর্থিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাতা) জন্য সরকার ৩৯ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়, যার মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য পেনশনও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। সরকার এ অর্থবছরে দেশের ৫৭ লাখ প্রবীণ নাগরিককে এই অর্থ প্রদানের লক্ষ্য নিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।

একইভাবে বিধবা, দুঃস্থ ও অসহায় নারীদের জন্য ভাতার অর্থ ১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। প্রাপকের সংখ্যা ২০ শতাংশ বেড়ে ২৪ লাখ ৭৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

রাজশাহীতে সরকারের এসব বিভিন্ন ভাতার সুবিধাভোগী অন্তত ১৭ জন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকের। তবে তাদের সবার গল্প মোটামুটি শামসুল হুদার মতোই।

তিনি সম্প্রতি ঈদুল ফিতরের কয়েক দিন আগে তার ভাতার টাকা তোলেন। টাকাটা হাতে পেয়েই তিনি তা তার ছোট ছেলের হাতে তুলে দিতে চান ঈদের খরচের জন্য। কিন্তু তার ছেলে ওই টাকা নিতে অস্বীকার করেন।

হুদা বলেন, 'শেষ পর্যন্ত ওই টাকা দিয়ে আমি একটি শার্ট ও লুঙ্গি কিনেছি। বাকি অর্থ দিয়ে ওষুধের বাকি শোধ করেছি।'

কিন্তু ভাতার সুবিধাভোগীদের সবাই শামসুল হুদার মতো পরিবারের সহযোগিতা পান না।

ভাতার সুবিধাভোগী কয়েকজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগের নিজের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে ৪৮ বছর বয়সী এমন একজন সুবিধাভোগী বলেন, 'আমার পরিবার আমার সঙ্গে ৩ মাসে মাত্র ৩ দিন ভালো ব্যবহার করে। ভাতার টাকা উত্তোলনের আগের দিন, উত্তোলনের দিন আর তার পরের দিন।'

তিনি আরও বলেন, '৩ বেলা খাবারের বিনিময়ে তারা (পরিবারের সদস্যরা) আমার পুরো টাকাটা রেখে দেয়।'

প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিতরণের জন্য সরকার এ বছর মোট ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

উল্লিখিত প্রতিবন্ধী মানুষটি জীবিকা নির্বাহের জন্য এক সময় বাদাম বিক্রি করতেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে ক্রমাগত অপমানিত হতে থাকায় এবং ক্রেতারা চুরি করে খাওয়ার কারণে তিনি ওই কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

এ ব্যাপারে জেলার বন্ধন প্রতিবন্ধী সংস্থার সভাপতি শেখ আবু তারেক মুকুলের ভাষ্য, 'ভাতার অর্থের পরিমাণ যথেষ্ট হলে প্রতিবন্ধীদের অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো না।'

বয়স্ক ভাতা পাওয়া নবগঙ্গা এলাকার আরেক বাসিন্দা রিজিয়া বেগমের মতে, তার কাছে ভাতার অর্থ সমুদ্রের ১ ফোঁটা পানির মতো। তিনি বলেন, 'এটা বলা যাবে না যে, এই ভাতা আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে না। কিন্তু মোটামুটি সম্মানজনক জীবন যাপনের জন্য এর অর্থের পরিমাণ আরও বাড়ানো দরকার।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশাও বলছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকা প্রত্যেক সুবিধাভোগীর বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তার ভাষ্য, বর্তমান মূল্যস্ফীতির যে হার, তা বিবেচনায় নিলে নিন্ম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাবের জন্য বিদ্যমান ভাতার পরিমাণ অপ্রতুল।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।

সিপিডির ভাষ্য, মূল্যস্ফীতির উচ্চ মাত্রা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরকারের উচিত এই ভাতা বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে বয়স্ক, বিধবা ও প্রান্তিক নারীদের জন্য।

এ জন্য ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা এবং এর আওতায় আরও ২০ লাখ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে সিপিডি।

একইসঙ্গে শহর এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের এর আওতায় আনা ও তাদের জন্য সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর সুপারিশও করে সংস্থাটি।

Comments

The Daily Star  | English

Fire at Mutual Trust Bank in Dholaikhal

Five units are working to bring the fire under control

33m ago