চরম বিপদে পড়া বাংলাদেশকে জেতালেন সাকিব

হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিতেছে ৩ উইকেটে।
Shakib Al Hasan
ছবি: সংগ্রহ

অনেকদিন থেকেই সাকিব আল হাসানের ব্যাটে ছিল রানখরা। প্রতিযোগিতামূলক কোনো ক্রিকেটেই রান আসছিল না। চরম এই দুঃসময় সাকিব কাটালেন দলের ভীষণ বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে। হারের শঙ্কায় পড়া দলকে টেনে নিলেন একাই। তার রানে ফেরার দিনে ২০০৯ সালের পর জিম্বাবুয়ের মাটিতে খেলতে গিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জিতল বাংলাদেশ।

রোববার হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ম্যাচের শেষ ওভারে বাংলাদেশ জিতেছে ৩ উইকেটে। আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ২৪০ রান করেছিল জিম্বাবুয়ে। সহজ এই লক্ষ্য পেরুতে এক পর্যায়ে ৭৫ রানে ৪ উইকেট হারানো সফরকারীরা পড়ে যায় বিপদে। পরে ১৭৩ রানে ৭ উইকেট পড়ে গেলে তা বেড়ে যায় আরও। সবটা সাকিব সামলালেন দারুণ মুন্সিয়ানায়। শেষ পর্যন্ত ৫ বল আগে জিম্বাবুয়ের রান পেরিয়ে এক ওয়ানডে হাতে রেখে তিন ম্যাচের সিরিজ নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ।

অল্পের জন্য সেঞ্চুরি না পেলেও বাংলাদেশের সফলতম ক্রিকেটার অপরাজিত থাকেন ৯৬ রানে। অষ্টম উইকেটে তার সঙ্গে ম্যাচ জেতানো অবিচ্ছিন্ন ৬৯ রানের জুটি গড়া মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন অপরাজিত থাকেন ২৮ রানে।

সহজ রান তাড়ায় নেমে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল-লিটন দাস আনেন অতি সতর্ক শুরু। থিতু হতে দুজনেই নেন বাড়তি সময়। তামিম একবার ক্যাচ দিয়ে বাঁচার পর দিচ্ছিলেন ভালো কিছুর আভাস। কিন্তু দশম ওভারে দলের ৩৯ রানে বিদায় হয় তার। ৩৪ বলে ২০ করা বাংলাদেশ অধিনায়কের উইকেট পেয়েছেন লুক জঙ্গুই। কিন্তু বড় কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন সিকান্দার রাজা। পয়েন্টে ঝাঁপিয়ে চোখ ধাঁধানো ক্যাচ নেন তিনি।

সময় নিয়ে খেলছিলেন লিটন। টেন্ডাই চাতারাকে টানা তিন চার মেরে খোলস থেকে বেরিয়ে আসার আভাস দিচ্ছিলেন। কিন্তু হয়নি। দুবার চোট পেয়ে মনোযোগ যেন একটু সরে যায়।

রিচার্ড এনগারাভার বলে পুল করতে গিয়ে সোজা উঠিয়ে দেন ক্যাচ। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ানের ব্যাট থেকে এদিন আসে ৩৩ বলে ২১।

চারে নেমে মোহাম্মদ মিঠুন আগের ম্যাচের মতো এদিনও সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। জঙ্গুইর অনেক বাইরের বল তাড়া করে কাভারে দেন ক্যাচ। ৫০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে হঠাৎ পথ হারানো বাংলাদেশের হাল ধরেন সাকিব। ক্রিজে এসে প্রথমে ধুঁকছিলেন। লম্বা সময় রান না পাওয়ায় চাপেও ছিলেন তিনি।

চতুর্থ উইকেটে মোসাদ্দেক হোসেনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। ২৫ রানের জুটি থেমেছে দুর্ভাগ্যজনক রান আউটে। এনগারাভার ওয়াইড বল উইকেটকিপার রেজিস চাকাবা ঠিকমতো ধরতে পারেননি। সুযোগে রান নিতে গিয়ে চাকাবারই সরাসরি থ্রোতে কাটা পড়েন মাত্র ৫ রান করা মোসাদ্দেক।

৭৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন যেন ব্যাকফুটেই বাংলাদেশ। এই অবস্থা সরে যায় মাহমুদউল্লাহ সাকিবের সঙ্গে জমে যাওয়ায়। সহজেই রান বের করতে পারছিলেন তারা। জিম্বাবুয়ের বোলাররাও চাপ রাখতে পারছিলেন না। স্পিনারদের আক্রমণে আনায় আরও সহজ হয়ে যায় দুজনের জন্য।

৫৫ রানের এই জুটি পরে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে থামিয়েছেন ব্লেসিং মুজারাবানি। তার বাড়তি বাউন্সের বল কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ধরা দেন ৩৫ বলে ২৬ করা মাহমুদউল্লাহ।

তবে সাকিব ক্রমেই চলে আসেন নিজের সেরা অবস্থায়। ৫৯ বলে তুলে নেন ফিফটি। মেহেদী হাসান মিরাজকে পাঠানো হয়েছিল আফিফ হোসেনের আগে। তিনি সেই সিদ্ধান্তের দাম দিতে পারেননি। ১৫ বলে ৬ রান করে বাজে শটে আত্মাহুতি দিয়ে ফেরেন। আফিফ পরে সাকিবের সঙ্গে জুটি বাঁধেন।

রানরেটের চাপ ছিল না। এক, দুই করে নিলেই হতো। এগুচ্ছিলেনও এমন করেই। তবে আচমকা রাজার বলে বেরিয়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে আফিফ স্টাম্পড হন ২৩ বলে ১৫ করে। বাংলাদেশ ১৭৩ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলায় কিছুটা শঙ্কা জাগে।

কিন্তু লম্বা ব্যাটিং লাইনআপের ফল পাওয়া যায় আরেকবার। সাইফুদ্দিন দাঁড়িয়ে যান সাকিবের সঙ্গে। অবিচ্ছিন্ন জুটিতে তারাই শেষ করেন খেলা। প্রতিপক্ষের চাপ তারা সামাল দেন স্থির মাথায়। একদম তাড়াহুড়ো না করে সাকিব খেলা নিয়ে যান শেষ দিকে। তাতে ম্যাচের সমীকরণ সহজ হয়ে যাওয়ায় বাগে পেয়েও বাংলাদেশকে হারাতে পারেনি স্বাগতিক জিম্বাবুয়ে।

অবশ্য এই জুটি ভাঙার কাছে গিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। এনগারাভার বলে সাইফুদ্দিনের দেওয়া কঠিন ক্যাচ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও জমাতে পারেননি চাকাবা। জঙ্গুইর বলে শর্ট থার্ড ম্যানে ৮৫ রানে থাকা সাকিবের কঠিন ক্যাচ হাতে জমাতে পারেননি এনগারাভা। 

এর আগে টস জিতে ব্যাট করতে গিয়ে শুরুটা ভালো হয়নি জিম্বাবুয়ের। একাদশে এসে সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারেননি টিনাশে কামুনহুকামুয়ে। তাসকিন আহমেদের প্রথম ওভারেই পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন তিনি।

৩ রানে প্রথম উইকেট হারানো দল দিশা পাচ্ছিল তিনে নামা চাকাবার ব্যাটে। আরেক ওপেনার টাডিওয়ানশে মারুমানি দুইবার ক্যাচ দিয়ে বেঁচেও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। ৩০ রানের জুটির পর মারুমানি আত্মাহুতি দেন মিরাজের বলে। স্লগ সুইপ করতে গিয়ে খোয়ান স্টাম্প। ১৮ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান।

অধিনায়ক টেইলর নেমে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। চাকাবাও ছিলেন সতর্ক। তৃতীয় উইকেটে তাই দুজনে পেয়ে যান জুটি। ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থাও পায় জিম্বাবুয়ে।

বড় কোন সমস্যাই ছাড়াই এগুচ্ছিলেন তারা। চাকাবা থিতু হয়ে ভুল করেন সাকিবের আর্মার পড়তে। জিম্বাবুয়ের কিপার-ব্যাটসম্যান ৩২ বলে ২৬ করে বোল্ড হয়ে গেলে ভাঙে ৪৭ রানের জুটি।

তবে টেইলর খেলছিলেন দারুণ। দলে আশা-ভরসা হয়ে টিকেছিলেন তিনিই। ডিওন মায়ার্সকে নিয়ে চতুর্থ উইকেটেও যোগ করে ফেলেছিলেন ৩১ রান। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিদায় হয় তার।

পেসার শরিফুল ইসলামের বাউন্সে আপার কাট করতে গিয়ে মিস করেন। বল কিপারের কাছে যাওয়ার পর শ্যাডো করছিলেন। তা করতে গিয়ে ক্যাজুয়ালভাবে ব্যাট স্পর্শ করে স্টাম্প।

টিভি আম্পায়ার হিট উইকেটের রায় দিলে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে যান। বল ডেড হওয়ার পরে ব্যাট স্টাম্পে লেগেছে কিনা এই প্রশ্নের সুযোগ ছিল অনেক।

হঠৎ ছন্দপতনের পর হাল ধরেন ওয়েসলি মাধভেরে। মায়ার্সের সঙ্গে আসে ভালো জুটি। প্রথম ফিফটির দিকে এগুতে থাকা মায়ার্স সাবলীল খেলেও ভুল করে বসেন বাজে শটে। সাকিবের অনেক শর্ট বল পুল করতে গিয়ে ধরা পড়েন ওয়াইড লং অনে।

৫৯ বলে ৩৪ করে মায়ার্স ফিরলে ভেঙে যায় ৩৫ রানের জুটি। এরপর রাজাকে নিয়ে দারুণ এক জুটি পান মাধভেরে। ৬ষ্ঠ উইকেটে আসে ৬৩ রান। যার ৪১ রানই আসে মাধেভেরের ব্যাটে। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ও বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ফিফটি করে তিনিই দেখাচ্ছিলেন লড়াইয়ের পুঁজি পাওয়ার আশা।

স্পিনারদের বল ভালোভাবে সামলানোর পর স্লগ ওভারে মাধেভেরে আশায় ছিলেন ঝড় তোলার। সেই চেষ্টায় গিয়ে শরিফুলের বলে হাঁকাতে গিয়ে তামিমের দারুণ ক্যাচে পরিণত হন তিনি। লং অফ থেকে অনেকখানি ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ জমান বাংলাদেশ অধিনায়ক। মাধভেরে ফিরে যান ৬৩ বলে ৫৬ করে।

জিম্বাবুয়ের শক্ত পুঁজির আশাও মিইয়ে যায়। জঙ্গুই আর মুজারাবানি মারতে গিয়ে পরপর শিকার হন শরিফুলের। রাজা শেষ ওভার পর্যন্ত থাকলে আরও কিছু রান হতে পারত। কিন্তু তিনি অনেকটা সময় নিয়েও পারেননি। লম্বা সময় পর ফেরার জড়তা দেখা গেছে তার ব্যাটে। ৪৮তম ওভারে সাইফুদ্দিনের বলে আউট হওয়ার আগে করেন ৩০ রান। দ্রুত রান আনার পরিস্থিতিতে এই রান করতে তিনি লাগিয়ে দেন ৪৪ বল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

জিম্বাবুয়ে: ৫০ ওভারে ২৪০/৯ (কামুনহুকামুয়ে ১, মারুমানি ১৩, চাকাবা ২৬, টেইলর  ৪৬, মায়ার্স ৩৪, মাধভেরে ৫৬, সিকান্দার ৩০, জঙ্গুই ৮, মুজারাবানি ০, চাতারা ৪*, এনগারাভা ৭*; তাসকিন ১/৩৮, সাইফুদ্দিন ১/৫৪, মিরাজ ১/৩৪, শরিফুল ৪/৪৬, সাকিব ২/৪২, মোসাদ্দেক ০/৭, আফিফ ০/১১ )

বাংলাদেশ: ৪৯.১ ওভারে ২৪২/৭ (তামিম ২০, লিটন ২১, সাকিব  ৯৬*, মিঠুন ২, মোসাদ্দেক ৫, মাহমুদউল্লাহ ২৬, মিরাজ ৬, আফিফ ১৫, সাইফুদ্দিন ২৮*; মুজারাবানি ১/৩১, চাতারা ০/৫২, জঙ্গুই ২/৪৬ , এনগারাভা ১/৩৩, মাধভেরে ১/৩৯ , রাজা ১/৩৩)

ফল: বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয়ী।

সিরিজ: তিন ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সাকিব আল হাসান।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Bank headquarters is seen in Dhaka

Will BB steps build up reserves? Not so soon

Bangladesh Bank’s steps to boost the country’s foreign currency reserves will not yield any positive results overnight.

12h ago