হিসাবটা শুধুই যোগ বিয়োগের নয়!

ব্যাপারটা আমার কাছে যোগ-বিয়োগের বিষয় বলেই মনে হয়েছিল; কিন্তু এখন যেভাবে লেজে-গোবরে করে ফেলা হচ্ছে তাতে মনে হয় এর মধ্যে হয়তো আরও কিছু বিষয় ঢুকে পড়েছে, নয়তো যারা এই দায়িত্বে আছেন তারা যোগ-বিয়োগের মতো সহজ অংক করতে অনিচ্ছুক।
ছবি: সংগৃহীত

ব্যাপারটা আমার কাছে যোগ-বিয়োগের বিষয় বলেই মনে হয়েছিল; কিন্তু এখন যেভাবে লেজে-গোবরে করে ফেলা হচ্ছে তাতে মনে হয় এর মধ্যে হয়তো আরও কিছু বিষয় ঢুকে পড়েছে, নয়তো যারা এই দায়িত্বে আছেন তারা যোগ-বিয়োগের মতো সহজ অংক করতে অনিচ্ছুক।

সহজভাবে যদি দেখি তবে বিষয়টি এ রকম— আপনার হাতে কতটা আছে, প্রতিদিন কতটা খরচ হচ্ছে বা দরকার হবে এবং কবে আর কতটা হাতে পাবেন। এই তিনটাই তো বিষয়, তাহলেই বোঝা সম্ভব কী করা যাবে আর কী করা যাবে না।

করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহ ও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রেও এটাই হচ্ছে মৌলিক হিসাব। যেহেতু সব মিলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাব হাতেই আছে, বয়সের হিসাবটাও জানা। বাংলাদেশে ১৮ বছরের বেশি মানুষ হচ্ছে ১৪ কোটি (সরকার ঘোষিত টিকা দেওয়ার বর্তমান বয়স ২৫ ও ২৫ বছর ঊর্ধ্ব বয়সীদের)। বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাব রাখার দায়িত্বে যারা আছেন তারা জানেন যে, এই জনসংখ্যার কত অংশ কোন বয়সী। সেই হিসাব আর সরকারের হাতে টিকার পরিমাণ ও কত টিকা কখন আসবে সেটাই টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করার জন্যে যথেষ্ট। মনে রাখতে হবে যে, এখন যাকে টিকা দেওয়া হচ্ছে তার জন্যে নির্ধারিত সময় পরে ঠিক সেই পরিমাণ টিকা দরকার হবে।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসব হিসাব ভালোভাবে না করেই টিকা দেওয়া শুরু হয়েছিল। আশা ছিল যে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকার নিয়মিত সরবরাহ আসবে। যখন সেটা ঘটেনি তখন যারা এক ডোজ টিকা নিয়েছিলেন তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছেন। কেবল আশ্বাসের ওপর ভরসা করা ঠিক হয়নি, দরকার নিশ্চয়তা। সেই অভিজ্ঞতা হলো। কিন্তু, সেই অভিজ্ঞতা থেকে কী কোনো শিক্ষা নেওয়া হয়েছে? গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে হয় এর থেকে কোনো শিক্ষাই নেওয়া হয়নি।

টিকা পাওয়া ও দেওয়ার মধ্যে সমন্বয় নেই। এক মন্ত্রী এক রকম বলেন তো আরেক মন্ত্রণালয় আরেক রকম বলেন। যার যে বিষয়ে বলার কথা নয় তিনি সে বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলেন। মহামারী মোকাবেলায় গৃহীত সব উদ্যোগেই সমন্বয়হীনতা প্রতিদিনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তা গত বছরের মার্চ থেকেই দেখা যাচ্ছে। অন্যথায় একাধিকবার গণপরিবহন বন্ধ রেখে শ্রমিকদের ঢাকামুখী করার ঘটনা ঘটতে পারে কেমন করে?

টিকা নিয়েও গত ফেব্রুয়ারি থেকে শিক্ষা নেওয়া হয়নি। হাতে টিকা আছে কিনা, কাকে কখন টিকা দেওয়া যাবে সেই হিসাব না করেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বললেন, ১১ আগস্টের পর থেকে টিকা ছাড়া ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কেউ বের হতে পারবেন না, বেরুলেই শাস্তি।

প্রশ্ন উঠলো যে যখন ২৫ বছরের ওপরের বয়সীদেরই টিকা দিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে সেই সময়ে এই কথার মানে কী! মন্ত্রী কিসের হিসাবে বললেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানাল, এ রকম কথা তারা বলেনি। মন্ত্রী তার কথা 'প্রত্যাহার' করলেন। স্বস্তি পাওয়া গেল টিকা না দিয়ে শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত বাক্সবন্দি হয়েছে।

এর মধ্যেই ঘোষণা করা হল আগস্টের ৭ তারিখ থেকে সাত দিনে ইউনিয়ন পর্যায়ে এক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হবে (বিবিসি, ৩ আগস্ট ২০২১)। নিঃসন্দেহে এটি আশার সংবাদ। বিশেষ করে এটা জানার পর যে, এখন প্রতিদিন গড়ে তিন লাখ টিকা দেওয়া হয়। ঐ এক সপ্তাহে কিভাবে টিকা দেওয়া হবে, তাও কাগজে কলমে বলা হলো। এমনকি, অনলাইনে নিবন্ধন ছাড়াও টিকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। অথচ 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছে যাওয়া এ টিকাযজ্ঞের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঠিক কিভাবে এই সাত দিন টিকাদান কর্মসূচি চলবে, তা স্পষ্ট নয় কারো কাছেই' (দেশ রূপান্তর, ৫ আগস্ট ২০১০)।

প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, '১৮ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী, নাকি ২৫ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষ টিকা পাবেন, তা পরিষ্কার নয়। আবার টিকাকেন্দ্রে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে গেলেই টিকা পাবেন, নাকি আগে থেকেই নিবন্ধন করে টিকার কার্ড নিয়ে যেতে হবে তাও স্পষ্ট নয়।'

দ্য ডেইলি স্টারে আজকের (৫ আগস্ট) প্রকাশিত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, টিকার স্বল্পতার কারণে গত রাতে সরকার টিকা দেওয়ার এই ব্যাপক উদ্যোগ ছয় দিন থেকে কমিয়ে এক দিনে এনেছে।

'৭ থেকে ১২ আগস্ট টিকাদান কর্মসূচি সীমিত করা হবে'। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করে যুগান্তর (৪ আগস্ট ২০২১) জানাচ্ছে যে টিকার স্বল্পতাই এর কারণ। তা হলে এক সপ্তাহে ১ কোটি টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা ও ঘোষণার কী হবে? কেউ কি যোগ-বিয়োগ করেননি? আন্তরিকতা থাকলে এখনো হিসাব করে অবস্থা সামাল দেওয়া যাবে, অন্যথায় টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে তা আরও ব্যাপক আকার নেবে।

আবার প্রথম আলো জানাচ্ছে, 'দেশে আগামী শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সপ্তাহব্যাপী করোনার টিকাদান কর্মসূচি। প্রথম দিন প্রায় ৩২ লাখ টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।' (প্রথম আলো, ৫ আগষ্ট ২০২১)।

এই সব পরিস্থিতি আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। মহামারী ব্যবস্থাপনা ও সরকারের দেওয়া তথ্যের ওপরে আস্থার অভাব সুস্পষ্ট। এর মধ্যে এসব অনিশ্চয়তা অবস্থার আরও অবনতিও ঘটাবে। সরকারের কাজে সমন্বয়হীনতা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব, দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও দুর্নীতির কারণে নাগরিকদের অনেক ধরনের মাশুল গুণতে হচ্ছে। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করলে তার বিপদ হবে ভয়াবহ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments