নিয়ন্ত্রণযোগ্য শব্দদূষণ কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না?

করোনা মহামারি শুরু হলে সন্ধ্যার পর মেয়েকে নিয়ে বাসার নিচের সড়কে হাঁটতে বের হতাম। সারাদিন বাসায় থেকে সে খুবই বিরক্ত থাকত, সড়কে বের হলে তার খুশি দেখে বোঝা যেত। তখন কেবল হাঁটতে শিখেছে। কিন্তু প্রধান সড়কের কাছাকাছি যেতেই সে দুই হাত দিয়ে তার কান চেপে ধরত। প্রথমবার আমি বুঝতে পারিনি, সে কেন কানে হাত দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছাকাছি আসতেই কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সড়কের অন্য প্রান্তে যেতেই আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি— ওর কানে হাত এবং সে আর এগুতে চাচ্ছে না।

করোনা মহামারি শুরু হলে সন্ধ্যার পর মেয়েকে নিয়ে বাসার নিচের সড়কে হাঁটতে বের হতাম। সারাদিন বাসায় থেকে সে খুবই বিরক্ত থাকত, সড়কে বের হলে তার খুশি দেখে বোঝা যেত। তখন কেবল হাঁটতে শিখেছে। কিন্তু প্রধান সড়কের কাছাকাছি যেতেই সে দুই হাত দিয়ে তার কান চেপে ধরত। প্রথমবার আমি বুঝতে পারিনি, সে কেন কানে হাত দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছাকাছি আসতেই কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো। সড়কের অন্য প্রান্তে যেতেই আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি— ওর কানে হাত এবং সে আর এগুতে চাচ্ছে না।

এবার আমি বুঝতে পারলাম, প্রধান সড়ক দিয়ে মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়িসহ যানবাহনগুলো সব হর্ন দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, আর সেই শব্দ পাওয়া মাত্রই কান চেপে ধরছে সে। আমি দ্রুত এবার পেছনের দিকে ফিরলাম। ভেতরের দিকে সড়কের যে অংশে গাড়ির হর্নের শব্দ খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না, সেই অংশে তাকে নিয়ে হাঁটতে থাকলাম। কিন্তু সেখানেও কোনো গাড়ি যাওয়া মাত্রই সে কান চেপে ধরত, এমনকি হর্ন না দিলেও। হয়তো সে ভাবছে, এখনই সে হর্ন দিবে এবং তা হয়েছেও। ফাঁকা সড়কেও হর্ন বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে গাড়িগুলো।

এই সমস্যাটি বেশ কিছুদিন ছিল। যদিও এখন খুব বেশি হর্ন না শুনলে সে কানে হাত দেয় না। কিন্তু বিরক্ত হয় খুব। বুঝতে পারি যে, বিষয়টি অনেকটাই সে সহ্য করে নিয়েছে! কী অসহায় আমরা। আমাদের শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারছি না। শব্দদূষণের কারণে মেয়েকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া বিপদ। নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও নানা কাজে তাকে নিয়ে বাইরে বের হতে হয়। আমি খুব ভালো করেই জানি, সড়কে যে শব্দদূষণ, সেটি আমাদের স্বাস্থ্যহানিকর। বড়দের চেয়েও শিশুদের জন্য এটি ভয়াবহ ক্ষতির কারণ। কিন্তু এই শহরের একটি সড়ক কি আছে, যেখানে শব্দদূষণ হয় না? শব্দদূষণের যে মানমাত্রা রয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ শব্দের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। আর এই ভয়ংকর শব্দদূষণ তৈরি করছি আমরা এই শহরের মানুষেরা। নিজেদের বিপদ নিজেরাই তৈরি করছি। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেই, প্রতিকার নেই, ব্যবস্থা নেই। উপায় একটাই আছে, সেটা হলো— সহ্য করে যাওয়া।

সম্প্রতি প্রকাশিত শব্দদূষণ নিয়ে 'ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস' শীর্ষক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শব্দের শহরের তালিকায় এক নম্বরে আছে ঢাকা। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) করা এই বৈশ্বিক প্রতিবেদনে ঢাকার তিন ধাপ পর অর্থাৎ চতুর্থ স্থানে রয়েছে রাজশাহী। অবশ্য সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ হয়তো ভেবে থাকে, প্রথম তো হয়েছি! সেটা নেতিবাচক হলেই বা কী। শীর্ষে থাকা কম কথা নয়। চাইলেও অনেক দেশ বা শহর প্রথম হতে পারবে না। কিন্তু আমরা পেরেছি। বায়ুদূষণেও আমরা বিশ্বের মধ্যে প্রথম হয়েছি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, মানুষের জন্য আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এলাকাভেদে শব্দের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করেছে। এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবেল, রাতে ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবেল, রাতে ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবেল, রাতে ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৭০ ডেসিবেল। এখানে দিন বলতে ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত রাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে শব্দের সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু এই সহনীয় মাত্রা দিন দিন ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ, গাড়িচালক ও শিশুরা। এ ছাড়াও, অসুস্থ ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী, শিক্ষার্থীসহ যারাই স্বাভাবিক কাজে বাইরে বের হচ্ছেন, সবাই এই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

বাস, ট্রাক বা যেকোনো ধরনের যানবাহনের শব্দ, আবাসিক এলাকায় বিল্ডিং তৈরির সময় ইট ভাঙার মেশিনের শব্দ, ক্যাসেটের দোকানে বা বিয়ে বাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো, মাইকে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে।

২০১৭ সালে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের শব্দের মাত্রা পরিমাপ বিষয়ক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ৮টি শহরেই ৮০ শতাংশ শব্দদূষণ করে যানবাহনের হর্ন। ২০ শতাংশ বাকিগুলো। আর ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের হর্ন।

ওই প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে ঢাকায় হর্ন বাজানোর শীর্ষস্থানের তথ্য দেওয়া হয়। হর্ন গণনার ফলাফল অনুযায়ী শ্যামলী এলাকায় নির্ধারিত স্থান হর্ন ব্যবহারের দিক থেকে সবার শীর্ষে ছিল। সেখানে ১০ মিনিটে ৫৯৮টি হর্ন বাজানো হয়, যার মধ্যে ১৫৮টি হাইড্রলিক হর্ন এবং ৪৪০টি সাধারণ হর্ন বাজানো হয়।

এখন হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার আরও বেড়েছে। যথাযথ পদক্ষেপ ও সচেতনতার অভাবে হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না। যদিও এটি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা কার্যকর করবে কে?

গত সপ্তাহে একাধিক দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, শিয়া মসজিদ এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, আসাদগেট, পান্থপথ, কাঁটাবন, শ্যামলীর ব্যস্ত সড়কে প্রায় ১৫ মিনিট করে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, যানজট বা সিগন্যালে গাড়ি থেমে থাকলেও অনেকেই হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল এগিয়ে। কখনো একজন হর্ন দিতে শুরু করলে অন্যরাও হর্ন দিতে থাকেন। আবার ফাঁকা সড়কেও হর্ন বাজান অনেকে।

এসব এলাকার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকেই এখন কানে কম শুনতে পান। সবসময় জোরে কথা বলেন। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। ৩ জন জানিয়েছেন, তারা এ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। আস্তে আস্তে কথা বললে তারা এখন আগের মতো স্পষ্ট শুনতে পান না। আর এটা হয়েছে শব্দদূষণের কারণে। প্রায় ৮ ঘণ্টারও বেশি সময় তাদের সড়কে শব্দের মাঝে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ঢাকা শহরে শব্দের যে মাত্রা, তাতে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করার পরেও যে তিনি শুনতে পাচ্ছেন, এটাই বরং আশ্চর্যের বিষয়। কারণ শব্দের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত প্রতিদিনের স্থিতিকালের চেয়ে তা কয়েকশ গুণ। সেই স্থিতিকাল অনুযায়ী, ১১৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দে প্রতিদিন ২৮ সেকেন্ড অবস্থান করা যাবে। আর ৮৫ ডেসিবেল মাত্রায় ৮ ঘণ্টা। অথচ ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল এবং এতে ২৮ সেকেন্ডের বেশি সময় অবস্থান করার অনুমতি নেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। আর এই ভয়াবহ শব্দের মধ্যেই ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। গাড়ি চালকদের তো আরও বেশি সময় থাকতে হয়। সড়কের দুই পাশে থাকা দোকান, অফিস বা ভবনের মানুষকেও দিনের বেশিরভাগ সময় অবস্থান করতে হয় এই শব্দদূষণের মধ্যে। সড়কে যারা যাতায়াত করেন, তাদেরকেও শব্দদূষণের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এ ছাড়াও, ভারী কারখানায় যারা কাজ করেন, তাদেরকেও বাধ্যতামূলক শব্দের ভেতরে থাকতে হয়। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছেন বধিরতার দিকে।

সাধারণত কোনো ধরনের শব্দ আমাদের কানে প্রবেশের দুটি স্তর রয়েছে। এর একটি পরিবহন হিসেবে কাজ করে, একে কনডাকশন বলে। অন্যটি শব্দ গ্রহণ করে মস্তিষ্কে নিয়ে যায়, যাকে পারসেপশন বলে। শব্দদূষণের ভেতরে থাকলে কানের পারসেপশন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে শব্দ শোনার ক্ষমতা হারিয়ে যায়।

শব্দদূষণ আমাদের শরীরে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে থাকে, ফলে আমরা এর ভয়াবহতা সহজে বুঝতে পারি না। ফলে যখন ক্ষতি হয়ে যায়, তখন কিছু করারও থাকে না। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পেতে একপর্যায়ে কানে শোনার ক্ষমতা সম্পূর্ণ লোপ পেতে পারে। যার কোনো ধরনের চিকিৎসা নেই বা পূর্বের অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না।

কানের সমস্যা ছাড়াও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সামান্যতেই বিরক্তিবোধ করা এবং মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ারও অন্যতম কারণ এই শব্দদূষণ। এ ছাড়াও, উচ্চ মাত্রার শব্দের কারণে হৃদরোগীর রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বেড়ে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে শিশুরা ভয় পাচ্ছে। তাদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

চলতি বছর শুরুই হয়েছে শব্দদূষণের কারণে এক শিশুর মৃত্যুর খবর দিয়ে। ২০২২ সালকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকার আকাশজুড়ে আতশবাজি ফোটানোর নামে যে শব্দদূষণ হয়, তাতেই হার্টফেল করে মারা যায় ৪ মাস বয়সী উমায়ের। আতশবাজির বিকট শব্দে একটু পরপরই সে কেঁপে উঠছিল। এই আতশবাজিতে আরও অনেকেরই অসুস্থতার খবর পাওয়া যায়। বর্ষবরণের নামে এই আতশবাজি ফোটানো বন্ধ করা জরুরি।

রাজধানীর শ্যামলী, কলেজগেট এলাকায় রয়েছে ৮টি সরকারি হাসপাতাল। সব হাসপাতালই প্রধান সড়কের পাশেই অবস্থিত। হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাকে নীরব এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাসপাতাল ছাড়াও স্কুল-কলেজ সংলগ্ন এলাকাও রয়েছে এর মধ্যে। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ আইনে বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা, যেখানে কোনো ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ এর উল্টোটাই দেখা গেছে হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজের সামনের এলাকায়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ক্লাস করা দায় হয়ে পড়ে গাড়ির হর্নের জন্য। আর হাসপাতালগুলোতে রোগীদের অবস্থা হচ্ছে আরও করুণ।

আবাসিক এলাকায় ভবন নির্মাণ কাজের জন্য ইট ভাঙার মেশিন, মিকচার মেশিন, টাইলস/থাই/রড কাটার মেশিন, ড্রিল মেশিন, পাইলিংয়ের কাজ করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে ভবন নির্মাণ কাজ হচ্ছে না। এমনকি গভীর রাতেও নির্মাণ কাজ করা হয় এবং এ কারণে আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা কেউই ঘুমাতে পারেন না, কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। অথচ আইনে বলা আছে, আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন চালানো যাবে না। একইসঙ্গে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না।

এ ছাড়াও, প্রায়ই বিয়ে বা কোনো উপলক্ষ্যে আবাসিক এলাকায় মাইকে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়। আইন অনুযায়ী, এটাও নিষেধ। কিন্তু শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে এই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। আবার এই আইনে জেনারেটরের বিষয়টিও উল্লেখ নেই।

শুধু ঢাকা বা বিভাগীয় শহর নয়, উপজেলা শহর এমনকি গ্রামেও গাড়ির হর্ন একটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোর হর্ন কান ঝালাপালা করে দেয়। গ্রামে রাতের বেলায় মাইকে উচ্চ শব্দে গান বাজানোও নিয়মিত ঘটনা।

সবমিলিয়ে শব্দদূষণ আজ ভয়ংকর মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। অথচ চাইলেই মানুষের তৈরি এই শব্দদূষণকে সহনীয় পর্যায়ে আনা যেতে পারে। নিয়ন্ত্রণযোগ্য এই পরিবেশগত সমস্যা এখনই যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বধিরতার দিকে এগিয়ে যাবে। সদিচ্ছা আর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলেই শব্দদূষণের মতো 'নীরব সন্ত্রাস'কে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

শব্দদূষণ বন্ধে যা করা যেতে পারে

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা। প্রয়োজনে আইন সংস্কার করা। জেনারেটরের মানমাত্রা নির্ধারণ ও আতশবাজি নিষিদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত করা।

গাড়ি চালকদের যথাসম্ভব হর্ন কম বাজিয়ে অথবা না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করা। গাড়ির হর্ন বন্ধে যৌথ অভিযান বা ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো। হাইড্রলিক হর্ন আমদানি ও বিক্রি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।

শব্দের মাত্রা অনুযায়ী যানবাহনের ছাড়পত্র দেওয়া। চালকদের শব্দ সচেতনতার স্তর যাচাই সাপেক্ষে লাইসেন্স প্রদান করা। ড্রাইভিং প্রতিষ্ঠান বা বাস-ট্রাক মালিক সমিতির সহায়তায় চালকদের মাঝে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ।

গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা।

পরিবেশবান্ধব যানবাহন বৃদ্ধি করা। কাছে এবং অল্প দূরে যাওয়ার জন্য বাইসাইকেল এবং পায়ে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম করা। যদিও ঢাকার বেশিরভাগ সড়কই বাইসাইকেল চালানোর উপযোগী নয়। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানানো। পাঠ্যসূচিতে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক ও সচেতনতামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা।

ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো। এতে শব্দদূষণ কমার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনাও কমে যাবে। নির্ধারিত জায়গায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠা-নামার নিয়ম করতে হবে। যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো যাবে না। একইসঙ্গে রাস্তার ওপর পার্কিং নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। যানবাহনের জন্য লেন পৃথক করা। এ ক্ষেত্রে বাইসাইকেল, রিকশা ও বাস চলাচলকে প্রাধান্য দেওয়া। বাস স্টপেজগুলো সড়কের মোড় থেকে সরিয়ে নেওয়া।

অনুমতি ব্যতীত সভা-সমিতি ও সামাজিক অনুষ্ঠান, নির্বাচনী প্রচারণা মিছিল এবং বিজ্ঞাপনের কাজে মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। মাত্রাতিরিক্ত শব্দে যেন কেউ গান না বাজায়, সেজন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা।

সাধারণ মানুষ, জনপ্রতিনিধি, পেশাজীবী, প্রশাসনের সমন্বয়ে কমিউনিটিভিত্তিক কমিটি করে শব্দদূষণ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা।

বিধিমালা কর্তৃক সংজ্ঞায়িত জোনসমূহ (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) চিহ্নিত ও অফিসিয়াল নোটিশ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের অবগত করা। নীরব ও আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো নিষেধ লেখাসহ সাইনবোর্ড স্থাপন করা এবং তা কার্যকর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আবাসিক এলাকায় ইট ভাঙার মেশিন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা।

শব্দের মানমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত শিল্প-কারখানা স্থাপনে ছাড়পত্র প্রদান না করা।

সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন, ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো। ধূমপানের ক্ষতিকর দিকটি যেভাবে প্রচারণা করা হয়, সেভাবে সব নাটকের শুরুতে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে প্রচারণা করা।

টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালগুলোতে তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট ও প্রামাণ্যচিত্র বা অনুষ্ঠান প্রচার ও প্রকাশ করা।

বর্ষবরণসহ কোনো অনুষ্ঠানে সব ধরনের আতশবাজি ফোটানো বন্ধ করা।

সচেতনতামূলক কার্যক্রমে সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা। বিশেষ কোনো হটলাইন নম্বর চালু করা, যেন সহজেই মানুষ অভিযোগ জানাতে পারে। কিংবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে শব্দদূষণ সম্পর্কে বিশেষ করে রাতের বেলায় উচ্চ শব্দে গান বাজালে, ইট ভাঙার মেশিন চালালে কিংবা অন্য যেকোনো শব্দদূষণের ক্ষেত্রে মানুষ অভিযোগ জানাতে পারে এবং সেই অভিযোগ নেওয়ার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।

সব শেষে প্রশ্ন— পরিবেশ অধিদপ্তর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে কী করছে? গত ১০ বছরের কার্যক্রম কী? আদৌ কি কোনো কাজ করছে? যদি না করে থাকে তাহলে করছে না কেন? তাদের একার পক্ষে সম্ভব না হলে কেন সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার বা ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা নিচ্ছে না? শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনটি কেন হেলায় পড়ে আছে?

তানজিল রিমন: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
What constitutes hurting religious sentiments

Column by Mahfuz Anam: What constitutes hurting religious sentiments?

The issue of religious tolerance have become a matter of great concern as we see a global rise in narrow-mindedness, prejudice and hatred.

8h ago