উন্নয়নের দেশে নিম্নমানের জীবনমান

সম্প্রতি টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের পেছনে মানুষের দৌড় কিংবা কে কার আগে কিনবেন তার জন্য হাতাহাতি দেশের উন্নয়নকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।

সম্প্রতি টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ট্রাকের পেছনে মানুষের দৌড় কিংবা কে কার আগে কিনবেন তার জন্য হাতাহাতি দেশের উন্নয়নকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে।

দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, এটা যেমন সত্য; তেমনই সত্য যে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির মধ্যে মধ্যবিত্ত অনেকে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হয়েছেন। আর নিম্নবিত্তরা হয়েছেন দরিদ্র। চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসায় লোকসানের ফলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্গতি।

সেই দুর্গতিতে আরও গতি দিয়েছে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীনতা। একটু ভালো-মন্দ খাওয়া তো দূরে থাক, যেটা ছাড়া পেটে তরকারি যাওয়ার নয়, সেই সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন না তারা। শুধু কি ভোজ্যতেল? চাল, ডাল, পেঁয়াজ, সবজি—কোনটার দাম ঊর্ধ্বমুখী নয়?

সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরে যাওয়ার সময় একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি এই শহরে রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে মোটরসাইকেল চালান বাড়তি আয়ের জন্য। একসময় নামকরা একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তিনি চাকরি হারান। মাস ছয়েক আগে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। সেখান থেকে যে বেতন পান তাতে এখন আর সংসার চলছে না। আগে থাকতেন ইস্কাটন এলাকায়, এখন মিরপুরে। এতে বাসা ভাড়া প্রায় অর্ধেক কমেছে। কিন্তু বাসা ভাড়া কমলেও ৫ জনের সংসারে অন্য কোনো খরচ কমেনি। বরং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সংসারের খরচ বেড়েছে।

খাবার কেনা কিংবা অন্যান্য খরচে সংকোচন করলেও এখন আর মাস পার হতে চায় না। সন্তানদের পড়াশোনার ব্যয় আর ঘরের খাবারের চাহিদা মেটাতে পারছেন না। মাস দুয়েক আগে গ্রামের বাড়ি থেকে ভাতিজার অকেজো মোটরসাইকেল নিজে সারিয়ে নিয়েছেন ধারে টাকা নিয়ে। এখন সারাদিন চাকরি করার পর সন্ধ্যার দিকে সেই মোটরসাইকেল নিয়ে সড়কে নামেন সংসারের যৎসামান্য প্রয়োজনটুকুর যোগান দিতে।

তবুও তিনি অসহায় সন্তানদের কাছে, বিশেষ করে ছোট ২ সন্তানের কাছে, যখন ঘরে ফিরলে তারা দৌড়ে আসে বাবার কাছে কী এনেছে তা দেখতে। তিনি বলছিলেন, 'বিশ্বাস করেন ভাই, আমার ছোট মেয়ে ২টা এখন আর ভাত খেতে পারে না। চিকন চালের ভাত খেয়ে অভ্যস্ত, এখন মোটা চাল কিনছি।'

বাজারে মোটা চালের দাম এখন ৫০ টাকার উপরে। সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত রোববার সকালে মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সবজির বাজারও চড়া। দোকানি একটি লাউয়ের দাম চাচ্ছেন ১০০ টাকা। অথচ এখন লাউয়ের মৌসুম। দিন ১৫ আগেও লাউয়ের দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। অন্যান্য সবজির দামও অনেক বেশি।

বেশির বাজারে নিম্ন বা মধ্য আয়ের মানুষ পড়েছেন বিপদে। অনেকেই খাবারে পরিবর্তন আনছেন। খাবারের চাহিদা কমিয়েছেন। আগে মাছ-মাংস যা খেতেন, এখন অর্ধেকেরও কম খাচ্ছেন। অনেকে মাছ-মাংস খাওয়াই ছেড়েছেন। গরুর মাংসের দাম উঠেছে ৬৭০ টাকায়। বাজারের চেয়ে একটু কম দামে তেল-ডাল কিনতে অনেকেই মুখ ঢেকে টিসিবির ট্রাকের সারিতে দাঁড়িয়েছেন। যদিও বিষয়টি সহ্য হচ্ছে না অনেকের।

মন্ত্রী তো বলেই দিয়েছেন, ভালো কাপড় পরা মানুষও এখন টিসিবির লাইনে। অবশ্য টিসিবির ট্রাকের পেছনের লম্বা সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ঘাম ঝরিয়েও অনেকেই পণ্য পাচ্ছেন না। অপ্রতুল পণ্য, অথচ চাহিদা এত বেশি যে, বেশির ভাগ মানুষই পণ্য না পেয়েই শূন্য হাতে ঘরে ফিরছেন। এমনকি দিনের পর দিন দাঁড়িয়েও পণ্য পাচ্ছেন না।

১২ মার্চ প্রথম আলো এক সংবাদে জানিয়েছে, পরপর ৩ দিন টিসিবির পণ্য নিতে গিয়েও পাননি রাজধানীর সায়দাবাদ এলাকার নীলুফা বেগম। দয়াগঞ্জে টিসিবির ট্রাকের সামনে ৩-৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর তিনি জানতে পারেন, ভোজ্যতেল শেষ। তার ভাষ্য, '৩ দিন এখানে তেল নিতে আইলাম, এক দিনও পাইলাম না। আজকে ৯টা বাজে আইছি। সকাল থেকে নাশতাও খাইনি। আগের দিন আইছিলাম সকাল ১০টায়। কিন্তু কিচ্ছু পাইলাম না।'

এই যে মানুষের নিত্যদিনের খাদ্যদ্রব্যের জন্য দুর্ভোগ, তা কমাতে অবশ্য কখনই উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। মাঝে-মধ্যে দু-এক জায়গায় অভিযান চালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ব্যবসায়ীদের গোডাউনে মজুদ করা মালামাল পাওয়া যায়, জরিমানা হয়। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। আখেরে সাধারণ মানুষের লাভ হয় না। সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দেখেও না দেখার ভান করে উট পাখির মতো আচরণ করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। যেন কোথাও কিছু হয়নি।

গণ্ডারের গায়ে চুলকালে নাকি সে সঙ্গে সঙ্গে টের পায় না। তেমনই আমাদের দায়িত্বশীলরাও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন মানুষ হিমশিম খাচ্ছে, তখন ঘুমিয়ে কর্তৃপক্ষ। আবার যখন ঘুম ভাঙে, তখনও সেই বিষয়টি কর্ণপাত করে না। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা উল্টাপাল্টা বকেন। উন্নয়নের স্বপ্নে মগ্ন থেকে তারা বিশ্বাসই করতে চান না যে দাম বেড়েছে। মেনে নিলেও বলেন, উন্নয়ন হয়েছে, মানুষের আয় বেড়েছে, দাম তো বাড়বেই!

এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, দাম বাড়বেই, কিছু করার নেই। যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখনই ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে দক্ষভাবে যুক্তি উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী। আবার অদক্ষতায় ভরপুর ছ্যাবলামো কথাবার্তাও আমরা শুনতে পাই। যেমন—বিএনপির কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে; বিএনপির ব্যবসায়ীরা ষড়যন্ত্র করে দাম ঊর্ধ্বমুখী করেছে। অথচ গত ১৩ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি রাস্তায় তো দূরের কথা, ঘরেও ঠিকমতো থাকতে পারেনি। আর ১৩ বছর পর এসে ক্ষমতাসীন মন্ত্রী হাজির করেন, খাদ্যদ্রব্যে বিএনপির ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

অবশ্য মানুষও এসব শুনতে শুনতে বিরক্ত। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, তাই দেশের বাজারেও বাড়বে সেটা অনুমেয় ছিল। তবে ইউক্রেনে হামলার সঙ্গে বিএনপি জড়িত—এমন কথা যে এখন পর্যন্ত শুনতে হয়নি, সেটা অবাক হওয়ার মতো!

অবাক হওয়ার আরও একটি বিষয় আছে। সেটা হলো—ভোজ্যতেলের বিকল্প হিসেবে কিংবা দাম বাড়ায় কোনো পরামর্শ এখনও পাওয়া যায়নি। অতীতে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভাতের বদল আলু খাওয়ার পরামর্শ পাওয়া গেছে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর বলা হয়েছে, পেঁয়াজ ছাড়াই তো রান্না করা যায়। যদিও গণমাধ্যমে কম তেলে রান্নার রেসিপি পাওয়া গেছে। অভিনব কায়দায় স্যালাইনের পাইপের দিয়ে পরোটা ভাজতেও দেখা গেছে। এখন ভোজ্যতেলের বিষয়ে কোনো পরামর্শ পেলেই রক্ষা হয়!

রান্না কি তেল ছাড়া হবে নাকি তেলের কোনো বিকল্প আসবে? হয়তো এখনও ভোজ্যতেলের বিষয়টি গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। গবেষণা শেষ হলেই আলোর মুখ দেখবে। ভোজ্যতেলের মুশকিল আসান হতে পারে এই পরামর্শ। তাতে করে টিসিবির ট্রাকের পেছনেও দীর্ঘ সারি ছোট হয়ে আসবে। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন। কিন্তু ভোজ্যতেল ছাড়া অন্যান্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে কি হবে, সেটাও জানা দরকার।

এর আগেও পরিবহন খাতে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে যে নৈরাজ্য তা দেখেছি। পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে সবাই জিম্মি। তারা তো একবার প্রায় দেশ অচল করে দিয়েছিলেন সবধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে। কিছুই করতে পারেনি সরকার।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও চলছে একই নৈরাজ্য। যখন মন চাইছে, দাম বৃদ্ধি করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ তো বটেই, সরকারও তাদের কাছে জিম্মি। কোনো সুযোগ পেলেই বেড়ে যাচ্ছে দাম। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘটনায় সম্প্রতি ভোজ্যতেলে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেই তেল আমদানি করা ২ মাস আগে, কম দামে। কম দামে কেনা ভোজ্যতেল এখন বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে।

১৩ মার্চ প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, '২০২১ সালে রোজার আগে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাজারজাত হয়েছিল ১ লাখ ২১ হাজার টন সয়াবিন তেল। এ বছর একই সময়ে গতবারের চেয়ে ৪৮ হাজার টন বেশি তেল আমদানি হয়েছে। আবার গত বছরের চেয়ে এবার জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন বীজ আমদানি বেশি হয়েছে ৪০ হাজার টন। তাতে বীজ থেকে সয়াবিন উৎপাদনও আগের তুলনায় বেড়েছে। এ দুটি তথ্য প্রমাণ করে, বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়।'

অথচ দাম গত বছরের তুলনায় ঢের বেড়েছে। তেলের দাম বাড়ায় অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে অন্যান্য দ্রব্যের দামও।

সামনেই পবিত্র রমজান মাস। এই মাস এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এবার এখনই যে পরিমাণ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, আরও যদি দাম বাড়ে তাহলে কী হবে?

সবকিছুর দাম বাড়ছে, কমছে মানুষের জীবনযাপনের মান। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনীতি বড় হচ্ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, রিজার্ভ বাড়ছে, অথচ জীবনযাপনের মান কমছে। তাহলে এই উন্নয়ন, এই রিজার্ভ দিয়ে কী হবে, যদি মানুষ ঠিকমতো খাবার না পায়?

একজন মন্ত্রী কতটা অসহায় হলে বলতে পারেন, 'কিছুই করার নেই।' তাহলে তাদের কাজটা কি? দাম বাড়ছে, বাড়বেই—এসব বলেই তাদের কাজ শেষ? বাজার মনিটরিং করা কেন সম্ভব হচ্ছে না? মজুদ আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না কেন? বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা তাহলে কার ওপর? কয়েকমাস আগে শুনেছিলাম, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অথচ এখন দেখছি, মানুষ খাবারটাই ঠিকমতো খেতে পারছে না। তাহলে কিসের স্বয়ংসম্পূর্ণ?

তানজিল রিমন, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রিয়.কম

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

'All our hopes, dreams now shattered'

Says Afroza Akter, wife of worker killed in Basabo construction site

49m ago