ইভিএমে ভোট কারচুপির সুযোগ নেই, কতটা সঠিক এ বক্তব্য?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।
ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)।

দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ এই মর্মে মতামত প্রদান করছেন যে, ইভিএম ম্যানুপুলেট করা প্রায় অসম্ভব। অতএব, এর মাধ্যমে ভোট গ্রহণে কারো কোনো আপত্তি থাকা সমীচীন নয়। (২৬ মে ২০২২, দ্য ডেইলি স্টার)

বাস্তব চিত্রটি একটু বিস্তারিত ভাবে দেখা যাক।

ইভিএমে অংশ মূলত ২টি। একটি হার্ডওয়্যার। এতে রয়েছে মাদার বোর্ড, মাইক্রোপ্রসেসর ও ভোট গ্রহণের জন্য সংযোজিত অন্যান্য যন্ত্রপাতি। দ্বিতীয় অংশ সফটওয়্যার। এতে রয়েছে অপারেটিং সিস্টেম, ডিভাইস ড্রাইভার, বিভিন্ন ফাইল ও কম্পিউটার এপ্লিকেশন।

যেহেতু ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে, তাই এই অংশের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে তার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ।

বাংলাদেশে যে সব ইভিএম ব্যবহৃত হয় তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তাই অনেকেই মনে করছেন, যন্ত্রটি ভার্চ্যুয়ালি ম্যানুপুলেট করা অসম্ভব। এই ধারনাটি ভুল। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াও একটি কম্পিউটার সিস্টেম হ্যাক করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যন্ত্রটির ভেতরে গোপনে মোবাইল সিম জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) স্থাপন করে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

তাছাড়া ইভিএমের সঙ্গে সংযোজিত যেকোনো ইনপুট পোর্টের মাধ্যমে যন্ত্রটির ভেতর ম্যালওয়্যার (ম্যালওয়্যার-মলিকুলাস কোড) প্রবেশ করিয়ে ভোটের ফলাফল বিকৃতি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ভোটার আইডি কার্ড যেখানে স্ক্যান করা হয় তা এমনই একটি ইনপুট পোর্ট।

বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের একটি ব্যবস্থা আছে বলে শুনেছি। এই ব্যবস্থাটিও যেহেতু সফটওয়্যার চালিত, তাই সোর্স কোড সংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে।

ইলেকশন সংক্রান্ত আইনের প্রায়োগিক দিকের প্রধান শর্ত হচ্ছে পদ্ধতিটি হতে হবে স্বচ্ছ। এ কারণেই ভোটের প্রাক্কালে সব দলের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ব্যালট বাক্স খুলে দেখানো হয়। কিন্তু ইভিএম মেশিন হচ্ছে এমন একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠ যার ভেতরে আসলে কী ঘটছে তা জানা সম্ভব নয়, যদি না এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সকলের সামনে উন্মুক্ত করা হয়। তার জন্য কী করা প্রয়োজন সহজ ভাষায় তা এখানে বর্ণনা করা হলো।

১. প্রতিটি ইভিএম একই সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার দ্বারা গঠিত। ভোট গ্রহণের পূর্বে প্রত্যেক পক্ষকে একটি ইভিএম যন্ত্র বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরবরাহ করতে হবে। ভোট গ্রহণের মূল এপ্লিকেশনের সোর্স কোডসহ যন্ত্রটির অপারেটিং সিস্টেম, ডিভাইস ড্রাইভার ও অন্যান্য ফাইল ফরেনসিক ও সিস্টেম সিকিউরিটির আলোকে পরীক্ষা করতে হবে। যেকোনো স্থানে এমন ম্যালওয়্যার লুকিয়ে রাখা যায় যা ভোটের ফলাফল বদলে দিতে পারে। পরীক্ষা শেষে প্রত্যেক সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) প্রতিপক্ষ সংরক্ষণ করবেন।

২. ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন  যে কোনো গোপন যন্ত্রাংশ বা ডাটা এন্ট্রি পোর্ট সংযোগ করা হয়নি। যন্ত্রটির হার্ডওয়্যারের লিস্ট, সার্কিট ডিজাইন, হার্ড ডিস্কের ফরেনসিক কপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সবপক্ষ সংরক্ষণ করবেন। প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রত্যেক হার্ডওয়্যার ডিভাইসের ডিজিটাল ছাপ গ্রহণ করতে হবে।

৩. ভোট শুরুর আগে সবপক্ষের বিশেষজ্ঞ ভোটকেন্দ্রে স্থাপিত ইভিএমের সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ মিলিয়ে নিশ্চিত হবেন যে কোনো সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার পরিবর্তন করা হয়নি। কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে এমন কিছু গোপন স্থান সৃষ্টি করা যায় যেখানে প্রোগ্রামিং কোড লুকিয়ে রাখলে তা সাধারণ কোনো ফাইল স্ক্যানিং ডিভাইস দিয়ে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ভোট গ্রহণের পূর্বে হার্ডওয়্যারের ফরেনসিক অ্যানালাইসিস করে দেখতে হবে যে, এমন কোনো গোপন স্থান তৈরি করে সেখানে কোনো কোড লুকিয়ে রাখা হয়েছে কি না।

৪. ভোট চলাকালীন অবস্থায় কেন্দ্রের কোনো কর্মকর্তা যদি ইভিএমের কোনো সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার পরিবর্তন করেন বা অসদুদ্দেশ্যে কোনো প্রোগ্রামিং স্ক্রিপ্ট প্রবেশ করান, তাহলে কিভাবে তা বোঝা যাবে? সমাধান হলো, বাজারে এমন সফটওয়্যার পাওয়া যায় যা একটি সিস্টেমকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। সিস্টেমটি ম্যানুপুলেট করা হলে সফটওয়্যারটি এসএমএস দিয়ে সবপক্ষকে জানাতে পারে। ভোট গ্রহণের পূর্বে সবাই নিশ্চিত হবেন যে, মনিটরিং সফটওয়্যারটি চালু আছে। এই সফটওয়্যারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার হলো, কোনো কারণে এটি বন্ধ হয়ে গেলে এসএমএস দিয়ে সেটাও জনিয়ে দেয়। তাই পর্যবেক্ষণের কার্যক্রম অকার্যকর করার জন্য কোনো পক্ষ যদি সফটওয়্যারটি বন্ধ করে তা হলে সবাই তা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারবেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইভিএমের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন কি আদৌ সম্ভব? যদি নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তা হলে সম্ভব:

১. ইভিএম এমনভাবে তৈরি হতে হবে যাতে ফরেনসিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে যন্ত্রটি পরীক্ষা করা যায় এবং ভোটের দিন ডিজিটাল ছাপ মিলিয়ে মেশিনটির স্বচ্ছতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকে। তা ছাড়া, ভোট চলাকালীন অবস্থায় ইভিএমটি পর্যবেক্ষণ করার উপযুক্ত সফটওয়্যার তাতে থাকতে হবে। বাংলাদেশর ইভিএমগুলোতে কি সেই ব্যবস্থা আছে? না থাকলে নির্বাচন কমিশন কি সেই ব্যবস্থা করতে পারবে?

২. বাংলাদেশে পোলিং সেন্টারের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার এবং ইভিএমের সংখ্যা লক্ষাধিক। প্রত্যেক পক্ষেরই ভোটের দিন হাজারো কম্পিউটার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে, কারণ একই সময় প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই ইভিএমগুলো পরীক্ষা করতে হবে। ভোটের দিন এত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা কি আদৌ সম্ভব?

এত অসুবিধা থাকা স্বত্বেও কোনো কোনো দেশ কেন ইভিএম ব্যবহার করছে? এর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব একটি মাত্র পরিস্থিতিতে—যদি সকল দলের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস থাকে এবং সকলেরই সদিচ্ছা থাকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের। ওই সব দেশে হয়ত সেই বিশ্বাসের পরিস্থিতি বিরাজমান। তাই তাদের জন্য ইভিএম কোনো সমস্যা নয়, বরং তারা যন্ত্রটির সুবিধাজনক দিকগুলো উপভোগ করছে।

সাইফুর রহমান: সার্টিফাইড প্রফেশনাল অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার সোসাইটি, অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিসে জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কর্মরত

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

6h ago