মতামত

আটকে পড়া রোহিঙ্গা হবে না তো?

হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রথম দিকে তাদের আটকানোর চেষ্টা করা হল, সীমান্ত পাহারা জোরালো করা হল কিন্তু আস্তে আস্তে মানবিকতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেওয়া হল -- এটাই স্বাভাবিক। পার্শ্ববর্তী দেশে এরকম মানবিক বিপর্যয় হলে অন্যদেশ তাদের আশ্রয় দেয় -- এর অনেক উদাহরণ আমরা পাই। কিন্তু আমরা কি ভাবছি শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কী হতে পারে?
মিয়ানমারে নিপীড়িনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ছবি: আনিসুর রহমান

কয়েকদিন থেকেই কেমন যেন অস্থিরতায় আছি। টিভি খুললেই রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর -- হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রথম দিকে তাদের আটকানোর চেষ্টা করা হল, সীমান্ত পাহারা জোরালো করা হল কিন্তু আস্তে আস্তে মানবিকতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দেওয়া হল -- এটাই স্বাভাবিক। পার্শ্ববর্তী দেশে এরকম মানবিক বিপর্যয় হলে অন্যদেশ তাদের আশ্রয় দেয় -- এর অনেক উদাহরণ আমরা পাই। কিন্তু আমরা কি ভাবছি শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কী হতে পারে?

সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল সবখানে এখন একটাই খবর “রোহিঙ্গা”। যারা দেশের নেতৃত্বে আছেন তাদেরও এখন অন্যতম চিন্তার বিষয় “রোহিঙ্গা সংকট”। যেহেতু আমরা রাষ্ট্রীয় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করি না, যে কাজ করি টাকার বিনিময়ে করি এবং তাও অতি সংক্ষিপ্ত তাই হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যার এ দিকটা এভাবে চোখে পড়লো। প্রথমত: মিয়ানমার ইস্যুতে আমরা কি একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি না? আমাদের নিজেদের দেশেরই অনেক সমস্যার সমাধান বাকি। এত বড় জনগোষ্ঠীর নানা সমস্যা প্রতিনিয়ত উপস্থিত। এরকম কি হতে পারতো না দেশ চলবে তার স্বাভাবিক নিয়ম, গতিতে আর রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলা হবে কূটনৈতিকভাবে, দেশের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ছন্দপতন না ঘটিয়ে। আমরা কি ভাবছি আগে তাদের আশ্রয় দেই, তারপর তাদের সংকট সমাধান করা যাবে। প্রশ্ন হল আদৌ কি তা করা যাবে?

রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে সংকট তা মিয়ানমারের নিজেদের সৃষ্ট। বাইরে থেকে অন্য দেশ বা সংগঠন হয়তো সংকট সমাধানে তাদের ওপর কিছুটা চাপ প্রয়োগ করবে বা বেশিই চাপ প্রয়োগ করবে। আশেপাশের দেশগুলো কেউ এর পক্ষে যাবে কেউবা বিপক্ষে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে যখন পার্শ্ববর্তী দেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে ফেলছে তখন বিশ্ব একটা চাপ থেকে মুক্ত হয়ে আশ্রয়দাতা দেশকে বাহবা দিবে এবং কিছুটা সাহায্যও করবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সাথেও আলোচনা চলবে। এরকম পরিস্থিতি কিছুদিন চলার পর মিয়ানমার যখন কোনোভাবেই মেনে নিবে না রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক এবং বিভিন্ন প্রমাণও দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে তাদের দাবির স্বপক্ষে -- তারপর একসময় সব চুপচাপ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে প্রসঙ্গ উঠলে বিশ্বের কাছে আমরাও আমাদের যুক্তি দাঁড় করাবো, আর্জি জানাবো। এটা একটা নিয়মে পরিণত হয়ে যাবে। বিভিন্ন সংগঠন ও বিশ্বের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ একসময় অন্য কোনো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। রোহিঙ্গা ইস্যু চাপা পড়ে যাবে সময়ের আবর্তে। ফলাফল হল -- আটকে পড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানীদের ব্যানারের মত আরও একটা ব্যানার হবে -- আটকে পড়া রোহিঙ্গা।

পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে আটকে পড়া শব্দটা কখনই আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। হয়ত আমাদের দেশের কিছু সাংবাদিক রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে যাবেন, তাদের মানবেতর জীবন নিয়ে রিপোর্ট করবেন। ডকুমেন্টারি হবে, বিশ্ব তা দেখবে। পুরস্কৃত করবে আর রোহিঙ্গাদের জন্য ছুটে আসবে বিদেশি সাহায্য ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো – ব্যাস!

১৯৭১ সালের পর বিহারিদের কথা আমাদের স্মরণ রাখা দরকার। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকার সুবাদে তাদের নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নিতে নারাজ। তাদের জন্য আমাদের দেশে ক্যাম্প হল, প্রত্যেকের জন্য একটি করে রুম বরাদ্দ হল, কমন বাথরুম হল, একসারিতে নলকূপ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি। তাদের সেই এক রুমে থাকা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর রিপোর্ট হল, সবাই জানল তারা কত কষ্টে আছে। অতএব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাহায্য এল। এনজিওগুলো তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় বহনের দায়িত্ব নিল। তাতে কি হল - যেটাকে তুলে ধরা হল এক রুমের মানবেতর জীবন সেখানে তারা কিন্তু দিব্যি সংসার শুরু করলো, ৪/৫ জন করে সন্তানও এল। এদের কোনো কাজকর্ম নেই। সারাদিন রাস্তায় বসে থাকে আর আড্ডা দেয়। তারপর কেউ পানি নিয়ে, কেই রিকশার চাকায় পাম্প দেয়ার কাজ নিয়ে, কেউ ড্রেনের উপর পাটাতন করে কাবাব বিক্রি করে, আস্তে আস্তে ক্যাম্পের সাথে সাথে রাস্তাও ওদের হয়ে গেলো। তখনও কিন্তু অনেক বাঙালি খোলা আকাশের নীচে টিকে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ।

আমরা ওদের কি দেইনি! আমাদের সরকার এই বিহারীদের ভোটের অধিকার পর্যন্ত দিল। বিনিময়ে ওরা দিল এই -- বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলা হলে তারা পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে, তারা মাজার ব্যবসা গড়ে তোলে নির্ভয়ে। ওদের বাধা দিবে কে? কারণ এখন একটা  বড় অংশের ভোট তো ওদের হাতে। কিন্তু এখনো  তাদের ক্যাম্পের সামনে বড় করে লাগানো -- আটকে পড়া পাকিস্তানি। একই দেশে থেকেও ভিন্ন জাতি, ভিন্ন গোষ্ঠী, ভিন্ন ভাষা-ভাষী।এ যেন দেশের মধ্যে আরেক দেশ। আমরা গা সওয়া বাঙালি -- সবই মেনে নেই। রাস্তায় ওদের ডাক দিলে বলে -- “ক্যা হুয়া এ রাস্তা আঁপ কি ক্যায়া”।

আবার রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই তবু বলার স্বাধীনতা পুরোটা নিলাম। আজকে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছি, চিকিৎসা দিচ্ছি, থাকা খাওয়ার ন্যূনতম সুবিধা দিচ্ছি। পরের দৃশ্য কি এরকম হবে – তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়ে আমরা হয়তো কিছুটা কঠোর হলাম তখন এই বিশ্ববাসীই না আমাদের হিপোক্র্যাট আখ্যায়িত করে বলে -- মিয়ানমার বিপর্যয়ে এত মানবিক বুলি আওড়িয়ে এখন একি তোমাদের আচরণ।তোমরা এতো নীচ, এতো মীন! সারা বিশ্ব ছিঃ ছিঃ করে উঠলো, আমরা পড়লাম আরেক চক্রে।

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

6h ago